হৈচৈ ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী তে ঈশানী রায়চৌধুরী (পর্ব – ১৩)

চললুম ইউরোপ

জারম‍্যাট শহরে পৌঁছালাম, তখন স্টেশন সংলগ্ন বাজার দোকান হোটেল আলোয় ঝলমল করছে। বৃষ্টি পড়ছে, পাথরের রাস্তা তাই আমরা পা টিপে টিপে হাঁটছি। ছোট একটা নদীর ওপর ব্রীজে দাঁড়ালাম। বরফপড়া এখন গা সওয়া হয়ে গেছে তবে ক্রীসমাস ট্রী সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা এমনতো ছুঁয়ে দেখিনি আগে….. সো ক্লিক! বাবাই শুধু সাবধান করছে ‘ সামলে মা,পিছলে যাওয়ার চান্স আছে। জানো এই জায়গার উচ্চতা ১৬০৪ মিটার। এর চারপাশে সুইতজারল‍্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গগুলো দেখা যায়।মাত্র ১০ কিমি দূরে ইতালি “। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হাঁটছি, চোখে পড়ল এখানকার গ্র‍্যান্ড হোটেল জারম‍্যাটারহফ। প্রি-ক্রিসমাস আলোর ফোয়ারায় এক্কেবারে কনেবউ ! কম্পাউন্ডের ভেতর একটা গোল স্ট্রাকচার করা আছে.. সেখানে সবাই ছবি তুলছে অগত‍্যা আমিও। ছোট জনপদ তাই বেশি সময় লাগল না ঘুরতে , একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে প্রথমবার আইরিশ কফির স্বাদ নিলাম। সফর শেষে স্টেশনে ফিরলাম আমরা কারণ আমাদের আজ রাতের আস্তানা পাশের শহর তাস (Tasch) এ। স্টেশনের খুব কাছে আমাদের একরাতের ঠিকানা Tasherhof থ্রি স্টার হোটেল। বাসস্টেশন টাও আমাদের সামনে বরফের চূড়া মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে। রাতের অন্ধকারে ট্রেন আর বাস স্টেশনের মাথায় জমে থাকা প্রায় একফুট বরফের গা থেকে এমন উজ্জ্বল সাদা আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে যে মনে হচ্ছে মৃদু আলোয় ভরে আছে চারপাশ… কোথাও টুকরো বরফ খসে পড়ছে। সমতলের অনভ‍্যস্ত মানুষদের চোখ যেন চন্দ্রাহত করে দিল এই দৃশ‍্য।
শুনেছি এখানে একটা দুর্দান্ত
গলফ কোর্স আছে, আবার শীতকালে ক্রসকান্ট্রি স্কীয়িং চলে। নিজেকে টানতে টানতে রুমে এসে আমরা অবাক…. এত চমৎকার যে মনে হল আমরা রাজঅতিথি! ছবি তুলে আর আশ মিটছে না। বুঝলাম ছেলে যথাসাধ‍্য আরামে রাখতে চায় আমাদের। বাবা ছেলে গিয়ে স্প‍্যাগেটি খেয়ে এল ডিনারে…. আমি ড্রপ টায়ার্ড তাই নো নড়ন চড়ন। সকাল হতেই এক অন‍্য পৃথিবী! পর্দা সরিয়ে রূপসী তাসের চেহারা বিমুগ্ধ করে দিল… রজতশুভ্র তুষার এমন স্বর্গীয় আবহ তৈরি করেছে যে শান্ত আনন্দে ভরে উঠছে মন। ঘনঘন বরফ সাফাই করার যন্ত্র আসছে যার একটা দিক এমন কাত করা যে বরফ একপাশে জড়ো হয়ে যাচ্ছে। চারদিক সাদার মধ‍্যে রাস্তার কালো রং খুব মনে ধরছে তবে বেশিক্ষণ নয় ২০-২৫ মিনিটের মধ‍্যে বরফ আবার দখল করে নিচ্ছে তার এলাকা….. ছোট হ‍্যান্ড ড্রেজার দিয়ে ফুটপাথ পরিষ্কার হচ্ছে ঘনঘন। এখানে পেট্রল বা ডিজেল গাড়ি চলে না, চলে ইলেকট্রিক ভ‍্যান। ঠিক পাশেই একটা পাহাড় সবুজে সাদায় মনোরম। এমন জ‍্যান্ত তুষারের রাজ‍্যে আমার মিষ্টারও আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না…. ভিডিও কল করে বন্ধু বান্ধবদের দেখাচ্ছেন কমেন্ট্রি সহযোগে ; যদিও এমন আদিখ‍্যেতা তিনি সচরাচর করেন না। আমার মনে শুধু লতাজীর সেই তীক্ষ্ম সুরেলা স্বর ভেসে আসছে… ” এ কঁহা আ গয়ে হাম “।

জীবনের সঞ্চয় পথপ্রান্ত থেকে কুড়িয়ে নিতে নিতে আবার নতুন পথে এগিয়ে যাওয়া। ২৩/১২ তারিখে ভিস্প জেলার তাস স্টেশন থেকে এসে ভিস্প ( Visp ) স্টেশন হয়ে আবার মন্ত্র । এবার আমরা এ‍্যাভেল করব গোল্ডেন পাস ট্রেন…এটা স্বপ্নের দেশের অনেক ট্রেজার লুকিয়ে রেখেছে নিজের ভেতর। এই অভিঞ্জতা এক একটা ঋতুতে একেকরকম। একটা দিগন্তজোড়া চালচিত্র যেন দমবন্ধ করে বসিয়ে রাখে এখানে। তিনটে পার্বত‍্য পাসের মধ‍্যে দিয়ে যেতে হয় এই পথে। ৪০০০ মিটার উচ্চতায় আলপাইন শৃঙ্গ, আর আটখানা লেকের প্রাকৃতিক নৈবেদ‍্য সাজানো আছে এই রেলযাত্রায়। টিপিক‍্যাল সুইস সবুজ উপত‍্যকা আর আঙ্গুরখেত দেখতে দেখতে যাত্রীরা অবিস্মরণীয় অভিঞ্জতা নিয়ে ফেরেন। এই যাত্রা শুরু হয় জার্মানভাষী লুসার্ণ (Lucerne ) থেকে আর শেষ হয় ফ্রেঞ্চভাষী মন্ত্র (Montreux ) তে। আমরা মন্ত্র থেকে ট্রেনে উঠে নামলাম Zweisimen বা জুইসমেনে। বাবাই সুইস পাস করে রেখেছে তিন দিনের জন‍্যে। ২২০ ইউরো ইচ। এই টিকেটে ট্রেন, বাস, লঞ্চ সবই ব‍্যবহার করা যায় কেবল কার ছাড়া । তবে আমরা শুধু ট্রেনে সফর করছি। তাই আমরা পছন্দমত স্টেশনে নামছি আবার পরের গন্তব‍্যের জন‍্য ট্রেনে উঠে পড়ছি।
আমরা স্টেশনের লাগোয়া কিয়স্কে গিয়ে বাদাম আর কফি খেলাম। ঘুরেফিরে আবার ট্রেনে। পরের ডেস্টিনেশন (Spiez ) স্পীজ। থুন লেকের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত এই শহর আঙ্গুর বাগানের জন‍্যেও প্রসিদ্ধ। আর স্বাভাবিকভাবে অসামান‍্য ওয়াইন তৈরি হয় এখানে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তার ওপারে দাঁড়ালে নিচে একটা অসামান্য ছবি পাওয়া যায়। ছবির মত চার্চ, ঘরবাড়ি গাছপালা দিয়ে সাজানো একটা নিখুঁত ছবি। আশ মেটে না তাই ক‍্যামেরার লেন্সে নিয়ে রাখি। এখানে ক‍্যাসলও আছে তবে আমাদের আগ্রহ নেই। আবার রেলযাত্রা আর পথ এসে মিশল ইন্টারলেকেন ওয়েস্টে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।