।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় সেঁওতি গুপ

ভালবাসা

পিং করে মোবাইলে একটা মেসেজ ঢুকল তিথির। হোয়াটসআ্যাপ মেসেজ, একটা আননোন নাম্বার থেকে। অফিস থেকে সবে ঘরে ফিরেছে। ইচ্ছে করল না এখনই দেখতে। অনিশ কে কফি করে দিয়ে নিজেও এককাপ নিল তিথি। ব্যালকনির রকিং চেয়ারে শরীর টা ছেড়ে দিল আরাম করে। তিন্নি এসে মা কে জড়িয়ে ধরল।
” কি রে কি হল?
” মা আজ টেস্টের খাতা দিয়েছে, আমি হায়েস্ট নাম্বার গেন করেছি”
” ও মা তাই? গুড গার্ল, ”
” মা আজ রাতে বিরিয়ানি, প্লিজ”
” আজই? আচ্ছা দেখছি”
তিন্নি চলে গেল। তিথি স্বামী কে গিয়ে বলে, ” মেয়েটার কথা শুনলে?”
অনিশ ” হ্যা, বিরিয়ানি? তাই তো? ওকে আমি জোম্যাটো তে অর্ডার করে দিচ্ছি” সিরাজ না অন্য কারো?”
” সিরাজ ই বল”।
চটপট অনিশ বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ অর্ডার দিল। তিথি হাল্কা করে এসি চালিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করে ফেলল। তিনজনে জমিয়ে ডিনার করল। তিন্নি দারুন খুশি। মা বাবা কে আদর করে ঘুমাতে গেল। তারো অনেক পরে তিথি শুতে এল। অনিশ ততখনে ঘুমিয়ে কাদা। মেয়ে জড়িয়ে আছে পাপা কে। রাতে শুতে যাবার আগে একবার মোবাইল টা চেক করে তিথি। আজ সে কি দেখছে? সে নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারল না। তন্ময়? এতদিন পর? তার হাত কাপতে লাগল উত্তেজনা য়।
তন্ময় আর তিথি কলেজের জনপ্রিয় জুটি। সবাই জানত এরা একে অপরের পরিপূরক। কলেজের ডিবেট কি কুইজ কি প্রোগাম আ্যারেঞ্জ করা সব কিছুতে তারা একসাথে। তাদের জুটি কে ডিবেট কি কুইজ এ হারানো সহজ নয়। সেই তন্ময় কলেজে দুর্ধর্ষ রেজাল্ট করে পড়তে চলে গেল আমেরিকা। আর তিথি? কলকাতায় এম এ তে ভর্তি হল।
তারপর লং ডিসন্ট্যাস রিলেশনশিপ চলল প্রায় ২ বছর। এরপর তন্ময় কলকাতায় এল। তিথি সেদিন রিসিভ করতে গেছিল। তন্ময় ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরল। আর তিথি সেদিন আবিষ্কার করল তন্ময় কে ছাড়া সে অচল। সে বার দুমাস ছিল তন্ময়, দুমাসে একদিনও তিথি দেখা করেনি হয়নি। তন্ময় তিথির মা বাবা সব জানতেন। চারহাত এক করতে তারা উঠে পড়ে লাগলেন। কিন্তু বাধ সাধল তন্ময়। সে বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। আরো কিছু সময় চায়। তখন তিথি বোঝেনি, বুঝল পরের বার, ২য় বার যখন তন্ময় দেশে এল।
সেবার আসার পর আবার যখন বিয়ের কথা হল তন্ময় তখন রাজী ছিল। কিন্তু আসল গল্প অন্য। বিয়ের আগের দিন কাউকে কিছু না বলে সবাইকে লুকিয়ে তন্ময় আমেরিকা চলে গেল। আর তিথির জন্য রেখে গেল একটা চিঠি। পরদিন তিথি আর তার মা বাবা যখন খবর পেল ততক্ষনে তন্ময় অনেক দূরে। সেই চিঠি পড়ে তিথি জেনেছিল, তন্ময় একটি ফরাসি মেয়েকে ভালবেসেছে। তাই সে তিথিকে বিয়ে করতে অপারগ।
জানতে পেরে তিথি কোন কথা বলেনি। সে আরও শিক্ষিত হয়ে চাকরি জয়েন করে। পরে তার বস অনিশ কে সে ভালবেসে বিয়ে করে।এখন তার মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার।
কিন্তু এই সময় তন্ময়? কেন? তিথি কিছুতেই ভেবে উঠতে পারে না। আর তার নাম্বার পেল কি করে তন্ময়? এই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। পরদিন সকালে অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে সে নিজের মন কে শক্ত করে একটা মেসেজ করল তন্ময় কে। দুঘণ্টা গেল না, ফোন করল তন্ময়।
” কি রে, কেমন আছিস? কি করিস?
প্রায় ১০ বছর পর তন্ময় এর গলা শুনে তিথি ভাবল সে কি সত্যি শুনছে?
তিথি চাপাগলায় শুধু বলল সে অফিসে।
তন্ময় এর উত্তর ” তোর অফিস কোথায় বল? আমি যাচ্ছি”
সংক্ষেপে ঠিকানা দিয়ে তিথি কাজে যোগ দিল।
ঠিক ৬ টায় অফিসের গেটে এসে দাড়াল তন্ময়। তিথি সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। তন্ময় কে দেখে তিথি যেন ভুত দেখল। একি চেহারা তন্ময়এর? দশ বছর আগের তন্ময় এর সাথে কিছুই মিলছে না। কি রোগা হয়ে গেছে? আর মুখ দেখেই বুঝতে পারছে তিথি বড় কোন ঝড় বয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে।
ওরা গিয়ে বসল একটা কফি সপে। তিথি জানল তন্ময় ডিভোর্সি। সে প্রতারনার শিকার। ওর বউ এমিল বিয়ের দুমাসের মধ্যেই ভালবাসল অন্য একজন কে। সেই থেকেই তন্ময় একা। সে একমাসের জন্য কলকাতা এসেছে শুধু তিথি কে খুঁজতে। মা বাবার কাছ থেকে তিথি বিবাহিত জানতে পেরেও সে তাকে পাগলের মত খুজেছে। তাদের কমন ফ্রেন্ড রিমির কাছ থেকে ফোন নাম্বার জোগাড় করেছে। কারন সে জানে তিথি ছাড়া আর কেউ পারবে না তাকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে। তিথি এই কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ভুলে যায় সে কারো মা, কারো বউ, তন্ময় তাকে কি ভাবে ঠকিয়েছে সব ভুলে গেল। তিন ঘন্টা পর তারা আগের মতই প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে গেল। কফিসপে যারা ঢুকেছিল আর যারা বেরোল তারা দুটো আলাদা মানুষ।
রাতে খাবার টেবিলে অনিশের প্রমোশনের আনন্দ আর তিন্নির একা একা হোমটাস্ক করার আনন্দ কিছুই তাকে ছুঁয়ে গেল না। সে যন্ত্রের মত ডিনার শেষ করে মোবাইলে তন্ময় এর সাথে চ্যাটে মগ্ন হয়ে গেল।
এইভাবে একমাসের দুসপ্তাহ কেটে গেল। এই দুসপ্তাহে তারা আরো একাত্ম হয়েছে। তাদের মধ্যে দৈহিক মিলন এখন নিত্যকার ব্যাপার। কিন্তু তন্ময় চায় অন্য কিছু। সে তিথি কে সম্পূর্ণ রূপে পেতে চায়। তাই সে তিথি র কাছে আবদার করল অনিশের কাছ থেকে ডিভোর্স। কিন্তু তিন্নি র কি হবে? এই চিন্তা করল তিথি। তন্ময় তিন্নির দায়িত্ব নিতে রাজী। অনিশ কে সব বলতে হবে, তিথি নিজের মনকে প্রস্তুত করল।
এরমধ্যে একমাস কেটে যায়। তন্ময় যাবার আগে বলে যায় তিথি তার ছিল, তারই থাকবে।
একদিন তিথি অফিস থেকে অনিশকে মেসেজ করল সে বাইরে দেখা করবে। কিছু কথা আছে। তারা মিট করল। কফি কাপেই পরে থাকল। এই সময়ে ও যারা ঢুকছিল আর যারা বেরোল দুটো আলাদা মানুষ। তিথি রাতেই তন্ময় কে জানাল অনিশ রাজী। এখন তিথি আর অনিশ দুটো আলাদা শিবির এ বাস করে। তিথি প্রয়োজন ছাড়া অনিশের সাথে কথা বলে না। দুজনের এখন রোজকার কাজ উকিলের কাছে যাওয়া। সব কাজ সেরে তারা যখন হাক্লান্ত হয়ে বাড়ী ফেরে অর্ধেকদিন তিন্নি তখন না খেয়ে ঘুমিয়ে পরে। এইসব দেখে অনিশ ভাবে কি ভাবে তার সাধের সংসার তিথির জেদের কাছে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর তিথি মনে মনে বলে ” একটু কষ্ট কর মা, আর কদিন পর শুধু সুখ আর সুখ”, তোকে জেতার আইনী লড়াইটা লড়ে নি”।
নির্দিষ্ট দিনে অনিশ আর তিথি আলাদা হয়ে গেল। তিথি মেয়ে নিয়ে মাবাবার কাছে চলে গেল। তিথির মাবাবাও মেয়ের এই জেদে বিরক্ত। তিন্নি ও মায়ের ওপর রেগে আছে। সে তার পাপা কে খুব মিস করে। স্কুল ফেরত সে প্রায়দিন পাপার সাথে দেখা করে মাকে লুকিয়ে। এদিকে তন্ময় তিথি কে ফোনে বলে আর ৬ মাস পর সে আসছে তাদের নিয়ে যেতে।
তিথি র এখন দিন গোনার পালা। ৬ মাস পর তন্ময় আসে। তিথির সাথে দেখা হয়। ঠিক হয় আরো একমাস পর সে তাদের নিয়ে যাবে। তন্ময় তিথি কে বলে সে যেন মেয়ে নিয়ে এয়ারপোর্ট এ চলে যায়। যাওয়ার দিন এগিয়ে আসে।
নির্ধারিত দিনে তিন্নি খুব ভোরে উঠে পাপা কে ফোন করে। তিথি মেয়ে নিয়ে দুপুরবেলা বেড়োয়। তিথির মাবাবা তার সাথে যেতে চাইলে সে না বলে। এয়ারপোর্ট এ পৌছে তিথি তন্ময় কে ফোন করে। ফোন আনরিচেবল। সে ভাবে হয়তো কোন কারনে দেরী হচ্ছে। তন্ময় ঠিকই চলে আসবে। কিন্তু সময় পেড়িয়ে যায় তন্ময় আসে না।প্লেন আসার আ্যানাউন্স শুরু হলে তিথি পাগলের মত মেয়ের হাত ধরে লাউঞ্জ এর এদিকওদিক দৌড়তে থাকে। ঠিক তখনই তিথির মোবাইলে একটা মেসেজ আসে- ” I am in Dubai, sorry”. তন্ময় জানায় তিথিকে। তিথি আবার ও ফোন করে কিন্তু পায় না। সে কাঁদতে থাকে।
পরাজিত হয়ে সে মেয়ে নিয়ে এয়ারপোর্ট র বাইরে বেড়িয়ে আসে। ঠিক তখনই একটা মারুতি জেন তার গাঘেঁষে দাড়ায়। তিথির একটুও চিনতে ভুল হয় না, গাড়ী টা অনিশের। দরজা খুলে অনিশ নেমে এল। তিন্নি পাপা বলে অনিশ কে জড়িয়ে ধরে। অনিশ তিথির হাত ধরে গাড়ীতে উঠতে বলে। গাড়ী এসে দাড়ায় তাদের ফ্ল্যাট এ। ঘরে ঢুকে তিথি অনিশ কে প্রশ্ন করে সে কি করে জানল আজ তিথি চলে যাবে? অনিশ তিন্নির দিকে তাকিয়ে হাসে। তিন্নি বলে সেই পাপাকে সব জানিয়েছে। আর অনিশ বলে আসলে খবর পেয়ে অনিশ আজ মেয়েকে শেষবার এর মত দেখতে গেছিল আর তন্ময় এর না আসাটা মিরাকেল।

তিথি এবার অনিশ কে জড়িয়ে ধরে। আর অনিশ বলে ” আরে আরে চল চল, বিয়েটা করতে হবে তো!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।