T3 || আমার উমা || বিশেষ সংখ্যায় সুদীপ ঘোষাল

কৃষিকাজ

রাজু অর্থের অভাবে, ছেলে আর তার স্ত্রী লিলিকে ছেড়ে চলে গেল কাজের জায়গা কেরালায়। ছোট মোবাইলে কথা হয় দুজনার।
– আবার কবে আসবে?
– ছুটি পেলেই চলে আসব।
– তোমাকে খুব মিস করছি
-না না আমি যাব তাড়াতাড়ি
– এবার এসে আমাকে নিয়ে যাবে বলে দিলাম।
— হুম এবার তোমাকে নিয়ে আসব। একটা আলাদা ঘর নেব। শুধু তুমি আর আমি আর ছেলেটা।
তারপর দুদিন পরে করোনা মহামারীতে দেশ ছেয়ে গেল। শয়ে শয়ে মানুষ মরতে লাগল বিশ্বজুড়ে। দেশে লকডাউন চালু হল। ঘরে থাকতে হবে। সমস্ত যানবাহন বন্ধ।
রাজুকে মোবাইলে কল করেও পায় না কেউ। কারণ রাজু করোনা পজিটিভ হয়ে আইসোলেশনে আছে।রাজুর বাড়ির কেউ জানল না রাজু একটা সংখ্যা হয়ে উড়ে গেছে পরিযায়ী পাখির মত….
রাজুর স্ত্রী বাজারে গেছিলেন আজ। দোকানে দড়ি দিয়ে মেপে এক মিটার দূরে ইঁট পাতা আছে।লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গ্রাহকরা,।পুলিশ পর্যবেক্ষণ করছেন বাজার, রাস্তা। জরুরি অবস্থায় সকলে চিন্তিত। কি করে একুশ দিন কাটবে। কাটবে ঠিকই। আবার ফুটবে ফুল। আবার হাসবে শিশু পৃথিবী। আজ ঘুম থেকে একটু দেরি করে উঠলাম।এখন সকাল নয়টা বাজে ঘড়িতে। চা মুড়ি আর প্রেশারের ওষুধটা খেলাম। সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছি অবশ্যই।খবরের কাগজ পেলাম।হেডিং -ভালবাসার দেশ কিউবা।করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে ইতালিতে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল পাঠিয়েছে কিউবা। দেশটি জানিয়েছে, ইতালির অনুরোধে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সের একটি ব্রিগেড রওনা হয়ে গেছে। করোনায় জর্জরিত ইতালির লমবার্দি অঞ্চলে কাজ করবে তারা।রাজুর স্ত্রীকে মহিলা পুলিশ ধরেছিলেন। তিনি বললেন, এই যে মাস্ক পরেন নি কেন?
– না মানে নেই
– রুমাল আছে তো
– হ্যাঁ, তা আছে
– জড়ান, নাকে মুখে
– ঠিক আছে
এইভাবে পুলিশের দল কাজ করছে।
দুজন পুলিশ কথা বলছে। একজন প্রথমে বলল,
-সমাজ সচেতন লোক যারা তারা বেরোয় না বাইরে। আর একজন উত্তর দিলো,
-দিন আনে দিন খায় তাদের তো বেরোতে হবে
– তাদের ঘরে খাবার দিয়ে আসতে হবে
– কিন্তু সবাই কি পাবে। জঙ্গলমহলে, প্রত্যন্ত গ্রামে যারা থাকে তারা কি পাবে।দুজন পুলিশের আলোচনা শুনে একজন অন্ধলোক এগিয়ে এসে বললেন, আমার এই পাঁচশ টাকা দয়া করে সেবার কাজে লাগান প্লিজ। তার মুখে মাস্ক।
রাজুর স্ত্রী লিলি বাকরুদ্ধ হয়ে দাগের ওপারে বসে আছে আর ভাবছে কত লোককে নতুন করে চিনলাম। এই মারণ রোগ না এলে মানুষ চেনা বাকি থেকে যেত সকলের।লিলি দেখছে দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধা তার স্বামীকে নিয়ে টোটো খুঁজছেন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। তারপর তারা মাস্ক পরে রাস্তা পেরোলেন। একজন পুলিশের আই সি বললেন, আপনারা বাইরে কেন? বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, আমরা দুদিন না খেয়ে আছি। আমি না খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু আমার স্বামী পারে না।বৃদ্ধ বলেন, হাসপাতালে ভরতি হলে খাবারটা তো পাব।অফিসার বললেন, বাড়ি চলুন। আমি আপনাদের ছেলের মত। আমি দেব আপনাদের খাবার।বাড়িতে এসে তিনি দিয়ে গেলেন চাল, ডাল আর আলু। এক প্যাকেট সন্দেশও দিলেন তাদের।বৃদ্ধ বললেন, তোমার কল্যাণ হোক।বৃদ্ধা কোন কথা বলতে পারলেন না। তার চোখে তখন জল…লিলির ছেলেটা ছেলেটা পূর্ণিমা পুকুরের জ্যোৎস্না ভিজে চাঁদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতো সে চাঁদ ছুঁতে পারেনি।বাবাকে মনে করত আর ঠিক তখনই অভাবের কথায় সমস্ত যোগ্যতার ফানুস সে উড়িয়ে দিয়েছিলো ঘাসের শিশিরে,বাতসের খেলায়।হেলায় সে হয়েছিলো ফাঁকা মাঠের রাজা।আলপথের মাটির গন্ধে তার যোগ্য সম্মানের ঘ্রাণ নিতো প্রাণভরে তার বাবার মত। সমস্ত চাওয়া পাওয়ার বাইরে অনুভূতির জগতে তার আসা যাওয়া।বন্ধু বলতো,তোর ধনী হতে ইচ্ছে হয় না?ছেলেটি হেসে বলে, তার আপন জগতে সে শুধু রাজা নয়, সম্রাট।সে চাষ করা ঠিক করলো। তাই সে দুবিঘে জমিতে যাপন করতো সাধারণ জীবন।সে জানে তার মত ধনী কমই আছে।বাতাসের রেণু,আকাশের হৃদয় আর সবুজের হাতছানিতে সে ছুটে চলে যেতো।সেখানে গিয়ে সে কথা বলতো আপন মগ্নতায়।তার কথাগুলো হয়ে যেতো কবিতার পান্ডুলিপি…। কিন্তু কবিতায় পেট ভরে না। সে বন্ধুদের নিয়ে কৃষিকাজে মন দিলো। কিন্তু বার বার লকডাউনের সময় বেরোনোর ফলে সে করোনা পজিটিভ হল। কিন্তু কি আশ্চর্য সে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল। অনেকে সুস্থ হচ্ছে। বন্ধুদের ও তার মায়ের খুব আনন্দ হলো।
করোনা আক্রান্ত হয়ে স্বামী মরে যাওয়ার খবর পায় নি লিলি। তারপরে একদম একা হয়ে পরেছিলেন, লিলি। মনে পরতো ফুলশয্যা, আদর। কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয়। একটা ঘুঘু পাখি তার স্বামী চলে যাওয়ার পর থেকেই এবাড়িতে আসে। আম গাছের ডালে বসে আপন মনে কত কথা বলে। ঘুঘুর ঘু,ঘুঘুর ঘু। লিলি আর পাখিটার খুব ভাব।তার মনে হয় স্বামী, ঘুঘুর রূপ ধরে আসেন। তিনি আম গাছের তলায় খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেন। ঘুঘু পাখিটা খায় আর গলা তুলে লিলিকে দেখে । কিছু বলতে চায়। তিনি বোঝেন। আর আপনমনেই পাখিটার সঙ্গে বকবক করেন। পুরোনো দিনের কথা বলেন। ছেলে বলে, মা বাবা এখানে নেই। প্রতিবেশীরা অতশত বোঝে না। হাসাহাসি করে। শুধু তার ছেলে বোঝে মায়ের অন্তরের কথা, ব্যথা। ঘুঘু পাখিটা সারাদিন ডেকে চলে। এবার আয়, এবার আয়।
লকডাউনের সময় লিলি আক্রান্ত হলো করোনা রোগে। স্ক্রিনিং হলো পরিবারের সকলের। লিলিকে আইসোলেশনে রাখা হলো। কোয়ারান্টাইনে থাকলো ছেলেটা। লিলি মরে গেলো। তাকে বাঁচানো গেলো না। ডাক্তারবাবু ও নার্সদের পরিশ্রমে অনেক রোগী সেরে উঠছে।

লিলির ছেলে এখন চাষ করে গ্রামের মাঠে। সে লক্ষ্য করে, ঘুঘু পাখিটা আর আসে না।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।