সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ৬০)

সীমানা ছাড়িয়ে

বলছেন, যুগে যুগে একটা নিয়ম চালু আছে। দেখবে প্রথম স্তরের গুড স্টুডেন্ট ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়র হন। দ্বিতীয় স্তরে এস,ডিও,বা বিডিও হন। তারা প্রথম স্তরকে শাসন করেন। মানে ডাক্তাররা বা ইঞ্জিনিয়ররা তাদের খুব ‘স্যার স্যার’ করেন প্রথম শ্রেণীর হয়েও। আবার তৃতীয় স্তরের স্টুডেন্ট নেতা হয়। তারা অর্ডার করে বি,ডি,ও বা উঁচু স্তরের অফিসারদের। আর চতুর্থ শ্রেণীর স্টুডেন্টরা হয় সাধুবাবার দল। নেতারা সব লুটিয়ে পরে তাদের চরণতলে।ভোট এলেই বাবার পুজো দিয়ে আশীর্বাদ নিতে আসেন গণ্য মান্য নেতার দল। তাই বলে কি সংসারে সাধু লোক নাই। নিশ্চয় আছে। তারা সংসারে আছেন গোপন সাধনায়। লোক দেখানো ভড়ং তাদের নাই। আর মন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে মিনিমাম রেগুলার মাষ্টার ডিগ্রী থাকা আবশ্যিক করুক সরকার।আর ভোট দেওয়া হোক বাড়িতে বসে আধার কার্ড লিঙ্ক করে। জালিয়াতি দূর হোক। সবাই বলো, জয় সাধুবাবা। নবীন বললো, আপনি ঠাকুরের নাম ছেড়ে,জয় সাধুবাবা বলেন কেন?
—-আরে বাবা দেখবি মানুষের কিছু মুদ্রা দোষ থাকে। ধরে নে তাই।

— না না আপনি এড়িয়ে যেচেন। বলুন কেনে।

—- তাহলে শোন। এখন সাধু মানুষ, কোটিতে গুটি। সব সং সাজা সাধুু। তাই যারা সত্যিকারের সাধু তাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে জয়ধ্বনি দিয়ে থাকি। ওই যে, মহাপুরুষের বাণী শোনো নাই।” সাধু হও, সাধু সাজিও না। সংসারী সাজিও, সংসারী হইও না। ”
— কাকা, আপনি আচেন বলেই কঠিন কথা সহজ করে বুঝতে পারি। তা না হলে কিছুই জানা হতো না।

— শুধু জানলেই হবে না। বাস্তবে,কাজে, কম্মে ব্যবহার দিয়ে দেখিয়ে দাও দিকিনি বাছা। তবেই বলবো বাহাদুর বাবা। খুবএকটা সহজ নয় বাবা।

আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে কাকা সবাইকে বললেন,তাহলে কি হলো ব্যাপারটা।আগের কথায় ফিরে যাই। ম্যান মেড ফ্ল্যাড। আর নয়, আধুনিক কবিতার মতো বাকিটা বুঝে নাও। বলো, জয় সাধুবাবা।সবাই বললো, জয় সাধুবাবা।

মানুষ মরছে বানে।আর উনি জয় সাধুবাবা বলে পাড়া মাত করছেন।আপন মনে বললো, পাড়ার শিবু কায়েত।শিবু কায়েত শিবে বলেই পরিচিত।

হঠাৎ কুটুম জনা বলে উঠলেন,দেখুন, ওই গোরের ঘাটে কে বসে । কাকা বললেন, তুমি জানো না কিন্তু আর সবাই জানে। ও হলো মানে মাল। ওকে শিবে, বলেই পাড়ার লোকে ডাকে। বুদ্ধি খুব। কথায় বলে না, কায়েতি কায়দা। বোঝে রসের রসিক। তুমি আমি ছারপোকা। বললেন মদন কাকা। ছোটো থেকেই চালাকি বুদ্ধি ছিলো তার অসম্ভব। লাষ্ট বেন্চের ছেলে। বড়োদের সম্মান করতো না। তাদের সামনেই সিগারেট ফুঁকে বাহাদুরি দেখাতো শিবে। বাবা, মা বড়ো আশা করে তাকে স্কুল পাঠান। কিন্তু স্কুলে র নাম করে সে মানুষকে জ্বালাতন করতো দিন রাত। তার জ্বালায় সকলেই বিরক্ত। এমনি করেই সে বয়সে বড়ো হলো। তার বাবা, মা একে একে মরে গেলো। এখন সে একা। তবু তার স্বভাব পাল্টাল না।

শিবু কায়েত বানের পরে সেই যে কোথায় নিরুদ্দেশ হলো কেউ জানে না। মদন কাকা বলেন, আমি জানি কিন্তু প্রকাশিত হবে ক্রমশ। একবারে নয়। আমি যেদিন স্তরবিন্যাস করেছিলাম, সেদিন শিবে চুপ কোরে গোরের ঘাটে বসে ছিলো। হুঁ, হুঁ বাবা আমি দেকেচি।ও আড়ালে আবডালে সুযোগ খোঁজে। আলোকে ওই বেটা ভয় পায়। আমাদের কায়েত বংশের কুলাঙ্গার। ভালো হলে আমরা আছি। আর খারাপ হলে মানুষ ছাড়বে না বাবা। তোমার সব সাত চোঙার বুদ্ধি এক চোঙায় যাবে। বাদ দাও, বাদ দাও। বলো, জয় ভবা, জয় সাধুবাবা।
সকলেই বললো, জয় ভবা, জয় সাধুবাবা।
মদন কাকা বানের পরে ক্ষতিপূরণবাবদ কিছু টাকা পেয়েছলেন। গ্রামের সকলেই পেয়েছিলেন।সেই টাকাতেই সকলের বছরটা চলেছিলো। নীচুএলাকা বলে খরার চাষটা এখানে ভালোই হয়।আর বর্ষাকালে ভরসা নাই। অজয়ের গাবায় চলে যায় বর্ষার ফসল। সেইজন্যে অনেকে নামলা করে চাষ দেয়। আর তাহলে কিছু ধান ঘরে ঢোকে। যতই বান বন্যা হোক চেষ্টাতো করতেই হবে। কঁথায় বলে, আশায় বাঁচে চাষা। মনে মনে কত স্বপ্ন,গাথা। জমি ফেলে রাখলে বাঁজা হয়ে যাবে। তাই গ্রামের কোনো মানুষ হাল ছাড়ে না সহজে।

কাকা গ্রামে সকালবেলা হাঁটতে বেড়োন। আর সকলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে কথা বলেন। কাকা হঠাৎ সকালে একদিন গ্রামে চুল দাড়ি ওয়ালাএক সাধুবাবাকে ষষ্টিতলার বোল গাছের নীচে তার আসন পাততে দেখলেন। সাধুকে সকলেই বিশ্বাস ক’রে চালটা, কলাটাএনে তার ঝুলি ভরলেন। খাবার সময় হলে খাবার পেয়ে যান। কোনো অসুবিধা তার হয় না।আর সাধুবাবা গ্রাম ছাড়েন না। কাকার সন্দেহ হয়। খুব চেনা চেনা মনে হয়। কিন্তু স্থিতধি মানুষ তো। তাই ভাবেন পরিবর্তনশীল এই জগতে অসম্ভব কিছু নয়। শুভ হোক সকলের। এই কথাই সকলের জন্য বলতেন। তাই বেশ খুশি মনে মদনকাকা বিকেল হলেইএকবার সাধুবাবার কাছে আসতেন। বসে নিজে কথা বলতেন আবার সাধুবাবার কথাও শুনতেন। কাকা শুধু ধর্মের কথা নয় অন্য কথাও বলেন। ভন্ডামি তার অসহ্য। কাকা বলছেন বর্ডারগুলো একেবারে কি যে হয়েছে। বলে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন। গরু পাচার, মানুষ পাচার, রত্ন পাচার কোনো আইন বা কাঁটতার আটকাতে পারছে কি? কোটি টাকার প্রশ্ন হে। সর্ষের ভেতর ভূত থাকলে কোন ভূত দেশ ছাড়বে বলো। খুব চিন্তায় তিনি। সাধুবাবা বললেন, জয় জয় জয়। কাকা বললেন কার জয়। সাধুবাবা ওইটুকু বলেন। বাকি কথা বুঝে নেয় মানুষ। নিশ্চয় ওর কথার মধ্যে কিছু আনন্দ আভাষ আছে। সাধুবাবার ভক্তসংখ্যা বেড়েই চলেছে। একদিন হরিনাম হলো। গ্রামের মানুষজন সকলেই মচ্ছব খেলো। কাকা বলেন, মহোৎসব থেকে মচ্ছব কথাটা এসেছে।
সুমিত বললো, আপনি তো ক্লাস সেভেন অবধি পড়েছেন।এত খবর কি করে রাখেন।
কাকা বলেন,আরে ক্লাসে পাশ না করেও বড়ো মানুষ হওয়া যায় রে মূর্খ। শুধু ভেতরের আলোটা জ্বেলে রাখবি। প্রদীপটা কোনো মতেই নিভতে দিলে হবে না বুঝলি।

সাধুবাবা জোরে হাঁক দিলেন, জয় জয় জয়। মানে কাউকে ডাকছেন।

সাধুবাবা আর কোনো মন্দিরে বা মসজিদে যান না
তিনি বালুবাড়ির কাঁদরের ধারে আস্তানা গেড়েছেন। নিজের মূর্তি মাটি দিয়ে বানিয়েছেন
।যোগাসন বিদ্যা, যৌনবিদ্যা সব কিছুতেই পারদর্শী বাবা। বললো অসীম। আর বলবি বল কাকার সামনে। কাকা শুধোলেন, তুই কি করে জানলি হতভাগা,ঘাটের মড়া। মার খাবি যে শিষ্যদের হাতে। সাধু আবার যৌন কারবারে কি করবে? যত সব বাজে কথা। কিন্তু সাধুবাবা যে কোন রসের রসিক তার তল পাওয়া সাধারণ লোকের সাধ্যের বাইরে।

সাধুবাবা দুর্বল চরিত্রের মানুষ নির্বাচন করেন প্রথমে । তারপর তাকে দিয়ে বিভিন্ন কাজ করিয়ে নেন। একদিন ডোমপাড়ার বিজয় ওরফে বেজা এসে সাধুবাবার চরণতলে পরলো। সাধুবাবা বললেন, বল্ কি বিপদ তোর। বেজা বললো, বাবা অনেক চেষ্টা করেও সন্তান হলো না। বাবা বললেন,তোর চেষ্টায় ত্রুটি আছে। তারপর হাজার রকমের কাজ দিয়ে বেজার মগজ বোঝাই করে দিলেন। বনে যাবি।উলঙ্গ হয়ে প্রতি শনিবার জবা ফুলের কুঁড়ি খাবি। জলে গোবোর গুলে খাবি। স্ত্রীর মুখদর্শন করবি না ছয়মাস। তারপর একবছর পরে দেখবি ঘর আলো করে আসবে আনন্দের ফেরিওয়ালা। তোর বংশের প্রদীপ। তবে হ্যাঁ, আর একটা কঠিন কাজ আছে। করতে পারবি।
বেজা বলে, বলুন, যত কঠিন হোক করবো আমি। সাধুবাবা বললো,সন্ধ্যা হলেই আমার আশ্রমে ওই পিটুলি গাছের পাতা তোর বউ দেবে আমার হাতে। কিন্তু কেউ জানবে না। তোর কথা শোনে বউ।
বেজা বলে, না না একেবারেই না। শুধু ঝগড়া করে। সাধুবাবার মুখ হাসিতে ভরে গেলো। তিনি বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। যা যা আমার কথা বল গিয়ে। তারপর আর মুখদর্শন করবি না।

তারপর থেকে বেজার বউ আসে রোজ রাতে। ভোর হলেই চলে যায় ক্ষেতে। গ্রামের লোক ভাবে, জমিতে কাজ করে।

প্রথম যে রাতে বেজার বউ সাধুর আশ্রমে আসে সেই রাতে সাধু বললে, সব শুনেছি। আমার কথা শোন। ওই খাটে বস। সে সরল বিশ্বাসে বসেছিলো। সাধু অন্ধকার ঘরে বলে, সন্তান তো এমনি এমনি হয় না। তোকে রাতে রোজ শুতে হবে। আমার সঙ্গে।
বেজার বৌ বলে, আপনি সাধু হয়ে কি কথা বলছেন।
— ঠিক বলছি, যা বলছি তাই কর। তা না হলে তোর স্বামীর মৃত্যু নিশ্চিত।
তারপর জোর করে ধর্ষণ করে সাধুবাবা, বেজার বৌকে।বেজার বৌ আর বাধা দেয় নি।
কিন্তু পরের দিন আসার জন্যে সাধু জোর করে নি। তবু বেজার বৌ এসেছিলো। সাধু হেসে বলেছিলো, রোজ আসবি তো ?

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।