|| পঁচাত্তরে পা, সাবালক হলো না? || T3 বিশেষ সংখ্যায় সুদীপ ঘোষাল

মাষ্টারদা সূর্য সেন, এক সাধকের পরিক্রমা

সূর্য সেন ১৮৯৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় বাবা, মা কে হারান তিনি।পরিবারের গন্ডির মধ্যে বড় হন।তিনি খুব মনোযোগী ছাত্র ছিলেন।তার বন্ধুরা তাকে খুব পছন্দ করত।ছোটথেকেই তিনি,সাঁতারকাটা,লাঠিখেলা এবং দলগঠন করে কবাডি খেলতেন। সূর্য সেন ও তার দলবলের স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস নোয়াপাড়া গ্রামে থাকতেই হয়েছিলো।
সূর্য র বন্ধু বলেন,দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক স্কুলে অভিভাবকদের সঙ্গে যেদিন আমরা দুই বন্ধু স্কুলে ভরতি হতে গেলাম তার বিবরণ শুনলে ভাল লাগবে।বাড়ির ছোটো ভাই সূর্য একদম ছোটো। স্কুলে দিদিমণি সহজ পাঠের প্রথম পাতা খুলে বললেন,এটা কি? সূর্য বলল,অ, য়ে অজগর আসছে ধেয়ে।
স্যার আবার বই বন্ধ করলেন। তারপর আবার ওই পাতাটা খুলে আমাকে বললেন,এটা কি?আমি ভাবলাম,আমি তো বললাম এখনি। চুপ করে আছি। ঘাবড়ে গেছি। সূূূর্যের বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে আমিও স্কুলে ভর্তি হলাম।

সূর্য ও তার বন্ধু স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলো। তারপর গ্রামের বাড়িতে জীবন যাপন। সুবিধা অসুবিধার মাঝে বড়ো হতে লাগলাম। তাদের খেলার সঙ্গি ছিলো অনেক।

তাঁর প্রথম স্কুল ছিল দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে তিনি নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি ন্যাশনাল হাই স্কুলে ভর্তি হন। সূর্য সেন ১৯১২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকাননে অবস্থিত হরিশদত্তের ন্যাশনাল স্কুল থেকে প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে এফ. এ.-তে ভর্তি হন। সে সময় আই.এ বা বর্তমানের উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার পরিবর্তে ফার্স্ট আর্টস বা এফ. এ. পরীক্ষার নিয়ম ছিল। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফ.

সূর্য বলত, ন্যাশানাল হাই স্কুলে পড়ার সময়, লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করা ছাড়া, রাস্তা ছিলো না। লাইনের কাঠের পাটার উপর দিয়ে হেঁটে যেতাম। কতজন ট্রেনে কাটা পরে যেতো তার হিসাব নেই। তারপর ওয়াগন ব্রেকাররা মালগাড়ি এলেই চুরি করতো রেলের সম্পত্তি। কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতো আমাদের লেখাপড়া।এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই।

মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি ন্যাশানাল হাই স্কুুুলে পড়েছি। গ্রামে কাকীমা ও বোনরা আছেন ।

সূর্যরা চারজন বন্ধু । মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন।আবার ন্যাশানাল হাই স্কুলে পরীক্ষা হলো। হেড মাষ্টারমশাই সূর্যকে বললেন,বাঃ, ভালো লিখেছ পরীক্ষার খাতায়। পত্রলিখনে বিজয়া প্রণামের আগে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছো। কজনে জানে।সূর্য প্রণাম করল হেড স্যারকে।

সূর্য ভাবত, আত্মবিশ্লেষণ করত।সে জানত, সংসারে সং সেজে দিবারাতি নিজেকে ঠকিয়ে কোন ঠিকানায় ঠাঁই হবে আমার মত অনাথ ছেলের ।নিজেকে নিজের প্রশ্ন কুরে কুরে কবর দেয় আমার অন্তরের গোপন স্বপ্ন । জানি রাত শেষ হলেই ভোরের পাখিদের আনাগোনা আরম্ভ হয় খোলা আকাশে । আমার মাসিকে অনেকে অভিশাপ দিতো । আমি দেখেছি ধৈর্য্য কাকে বলে । আজ কালের কাঠগোড়ায় তিনি রাজলক্ষ্মী প্রমাণিত হয়েছেন । কালের বিচারক কোনোদিন ঘুষ খান না । তাই তাঁর বিচারের আশায় দিন গোনে শিশুর শব, সব অবিচার ,অনাচার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে আগামী পৃথিবীর ভাবি শিশু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। অপেক্ষায় প্রহর গোনে নিজের অন্তরের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে । সাবধান খুনীর দল ,একবার হলেও অন্তত নিজের সন্তানের জন্য শান্ত পৃথিবী রেখে যা । ঋতু পরিবর্তন কিন্তু তোর হত্যালীলায় বন্ধ হবে না নির্বোধ ।শান্ত হোক হত্যার শাণিত তরবারি ।নেমে আসুক শান্তির অবিরল ধারা। রক্ত রঙের রাত শেষে আলো রঙের নতুন পৃথিবী আগামী অঙ্কুরের অপেক্ষায়।

 

ছোটথেকেই সূর্য সেনের আত্ম বিশ্লেষণের শক্তি সকলকে অবাক করে দিত।রাউজান উপজেলার সর্ব-দক্ষিণে নোয়াপাড়া ইউনিয়নের অবস্থান। উপজেলা সদর থেকে এ ইউনিয়নের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। এ ইউনিয়নের পূর্বে বাগোয়ান ইউনিয়ন; উত্তরে পূর্ব গুজরা ইউনিয়ন ও পশ্চিম গুজরা ইউনিয়ন; পশ্চিমে উরকিরচর ইউনিয়ন, হালদা নদী ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৫নং মোহরা ওয়ার্ড এবং দক্ষিণে কর্ণফুলী নদী ও বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ ইউনিয়ন ও কধুরখীল ইউনিয়ন অবস্থিত।তাঁর প্রথম স্কুল ছিল দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে তিনি নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি ন্যাশনাল হাই স্কুলে ভর্তি হন। সূর্য সেন ১৯১২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকাননে অবস্থিত হরিশদত্তের ন্যাশনাল স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে এফ. এ.-তে ভর্তি হন। সে সময় আই.এ বা বর্তমানের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরিবর্তে ফার্স্ট আর্টস বা এফ. এ. পরীক্ষার নিয়ম ছিল। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফ. এ. পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করে তিনি একই কলেজে বি.এ-তে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু তৃতীয় বর্ষের কোন এক সাময়িক পরীক্ষায় ভুলক্রমে টেবিলে পাঠ্যবই রাখার কারণে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিতাড়িত হন। ফলে, তাকে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বি.এ পড়তে যেতে হয়। ১৯১৮ সালে তিনি মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন এবং চট্টগ্রামে ফিরে এসে ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য্য হরিশ দত্তের জাতীয় স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেওয়ানবাজারে বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত অধুনালুপ্ত ‘উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে’ অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এসময় বিপ্লবী দলের সাথে তাঁর সম্পর্ক গভীরতর হয়ে ওঠে এবং শিক্ষকতা করার কারণে তিনি ‘মাস্টারদা’ হিসেবে পরিচিত হন।কলেজে পড়বার সময়ে কলকাতার বিপ্লবী কর্মীদের সংস্পর্শে এসে বিপ্লবী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হন। চট্টগ্রামে বিপ্লবী দলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনে তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। বি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার কিছুকাল পর তিনি ন্যাশনাল হাইস্কুলে সিনিয়র গ্রাজুয়েট শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২০ সালে কংগ্রেস কর্মী হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯২১ সালে অসহযোগের আহবানে সমর্থন জানিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় পদত্যাগ করে তরুণদের দেশাত্মবোধ শিক্ষা দেবার জন্য ‘সাম্য আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন। কর্ণফুলি নদীর বন্যায় যখন এলাকার লোক ভেসে যাচ্ছে তখন সূর্য ও তার বন্ধু রা প্রাণপণে তাদের রক্ষা করেন। বন্যার সময় নৌকা করে মানুষের খাবার জোগাড় করতে চড়খী গ্রামে গিয়েছিল সূর্য র বন্ধু দল।। চিড়ের বস্তা,গুড়ের বস্তা নিয়ে নদীর ব্রীজে হাজির,সেখান থেকে ওরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায় তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে হয় না। সূর্য বললো, এখন এটা সকলের সম্পত্তি। যা হবে সকলের সামনে হবে। কেউ হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বন্যা বাড়ছে। সূর্য দাঁড় টানে আর বন্ধুরা সবাই সাহায্য করে নৌ্কা ও খাবার নিয়ে চলে এল নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো সূর্য । তারপর সকলে বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। সূর্য বললো, কাকীমা অনেক পেঁপে গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। সূর্য ভাবে আমাদের গ্রাম কর্ণফুলী নদীর ধারে। গ্রামগুলিও খুব নীচুস্থানে অবস্থিত। নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেতো। জল যখন কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেতো। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি, শুশুনি তুলতো। খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম, তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো পেট ভরে। মাঠেই পাওয়া যেতো বেশির ভাগ শাক, সব্জী। , খলসে, ওআরও নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াতো। বেলে, তে চোখো,চ্যাঙ,ছিঙুরি,গচিমাছ ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া তাল কাঁকড়া পাওয়া যেতো। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনরকবার তআল কাঁকড়া বের করে আমাদের দেখিয়েছে। পাঁকাল,গুঁতে,কৈ,মাগুর,ল্যাটা প্রভৃতি অসংখ্য মাছ। বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে।সূর্য বলছে, খাল কেটে মাঝখানে বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো। টানা জাল,পাতা জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের জায়গায বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী।। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে বাউরীবউ মুড়ি নিয় আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের টাটকা শাক সবাই নিতো জলের দরে। আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু, স্বর্ণ যুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায়চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমার কাকিমা বলতেন,ছোটো থাকাই ভালো রে,সংসার অসার। তিনি বলতেন,এখন সংসাররূপ চিতায় জ্বলে মরছি মরণের পরে প্রকৃত চিতায় পুড়ে যাবে আদরের দেহ…স্বজন বন্ধুরা বলবে. আর কত সময় লাগবে শেষ হতে…একটু দ্রুত করো ভাই…তবে কিসের এত অহংকার…কেন এত লোভ … ভালোবাসায় কৃপণতা। কে ধনী… টাকায় চিতা সাজালেও পরিণতি একই..।দেশপ্রেমে, ধনী যেজন নিজ ধামে ফেরে সেজন..।

কলেজে পড়ার সময়ও সূর্য একটা বন্ধুদল গঠন করেছিল।বন্ধুরা একত্রে সমাজ সেবার প্রচেষ্টায় ছিল । রাস্তার অভুক্ত মানুষের মুখে একটু নুনভাত জোগানোর জন্য ওরা ভিক্ষা করে, জীবনমুখী গান শুনিয়ে । অসীম গান করে,বিচ্ছু একতারা বাজায় । অমিত আর অনিন্দিতা সুরে সুর মিলিয়ে স্বপ্ন দেখে । ওরা এখনও স্বপ্ন দেখে । হয়তো চিরকাল দেখে যাবে থমকা লাগা স্ট্যাচুর পলক..

সূর্যর মনে পড়ত চট্টগ্রামের নোয়াপাড়া গ্রামের রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে । এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে । ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে । হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা । কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি ।এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে । রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে ।ভালো থেকো বাল্য অনুভব । চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ ।আমার স্বপ্নের সুন্দর গ্রামের রাস্তা বাস থেকে নেমেই লাল মোড়াম দিয়ে শুরু ।দুদিকে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস রাস্তায় পরম আদরে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে । কত রকমের পাখি স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে । রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বেজি , শেয়াল আরও অনেক রকমের জীবজন্তু।.চেনা আত্মীয় র মতো অতিথির কাছাকাছি তাদের আনাগোনা । হাঁটতে হাঁটতে এসে যাবে কদতলার মাঠ। তারপর গোকুল পুকুরের জমি, চাঁপপুকুর, সর্দার পাড়া,বেনেপুকুর । ক্রমশ চলে আসবে নতুন পুকুর, ডেঙাপাড়া ,পুজোবাড়ি, দরজা ঘাট, কালী তলা । এখানেই আমার চোদ্দপুরুষের ভিটে । তারপর ষষ্টিতলা ,মঙ্গল চন্ডীর উঠোন , দুর্গা তলার নাটমন্দির । এদিকে গোপালের মন্দির, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, তামালের দোকান, সুব্রতর দোকান পেরিয়ে ষষ্ঠী গোরে, রাধা মাধবতলা । গোস্বামী বাড়ি পেরিয়ে মন্ডপতলা । এই মন্ডপতলায় ছোটোবেলায় গাজনের সময় রাক্ষস দেখে ভয় পেয়েছিলাম । সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাক্ষস আর ফিরে আসবে না ।কেঁয়াপুকুর,কেষ্টপুকুরের পাড় । তারপর বাজারে পাড়া ,শিব তলা,পেরিয়ে নাপিত পাড়া । এখন নাপিত পাড়াগুলো সেলুনে চলে গেছে । সাতন জেঠু দুপায়ের ফাঁকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরতেন মাথা ,তারপর চুল বাটি ছাঁটে ফাঁকা । কত আদর আর আব্দারে ভরা থাকতো চুল কাটার বেলা ।এখন সব কিছুই যান্ত্রিক । মাঝে মাঝে কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে রোবোট মনে হয় । মুখে হাসি নেই । বেশ জেঠু জেঠু ভাব ।সর্বশেষে বড়পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে ভুলকুড়ি । আর মন্ডপতলার পর রাস্তা চলে গেছে খাঁ পাড়া , কাঁদরের ধার ধরে রায়পাড়া । সেখানেও আছে চন্ডীমন্ডপতলা , কলা বা গান, দুর্গা তলার নাটমন্দির সব কিছুই । পুজোবাড়িতে গোলা পায়রা দেখতে গেলে হাততালি দিই ।শয়ে শয়ে দেশি পায়রার দল উড়ে এসে উৎসব লাগিয়ে দেয়। পুরোনো দিনের বাড়িগুলি এই গ্রামের প্রাণ ।এই গ্রামে ই আমার সবকিছু , আমার ভালোবাসা, আমার গান।ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো । পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় । বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল । তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর । পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে । কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত । একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব । তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না । মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না ।তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ । মা বাবার সাবধান বাণী ,ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি । হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে , আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে । এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে । পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে । মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না । শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না । পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই । জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন । মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে । তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম । প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে ।আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত ,ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম । সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ ,ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম । পরের দিন দধিকর্মা । খই আর দই । পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল । তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে ।এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন । কাছেই একটা পুকুর । রাত হলে সিদ্ধিলাভে(দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচ তে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো । মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন ।তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনত দুদিন ধরে।সুমন্ত ভট্টাচার্য শুধু একজন যোগ্য বিজ্ঞানী নন। তিনি একাধারে চিকিৎসক, সন্ধানী গোয়েন্দা আবার কিশোর মনো বিজ্ঞান পত্রিকার সহ সম্পাদক । তিনি এক বনেদী পরিবারের সন্তান । পূর্ব বর্ধমান জেলায় পূর্ব পুরুষ রা বাস করতেন । অই বংশের একাংশ আবার জলপাইগুড়ি তে বাস করতেন । কিন্তু কালের প্রবাহে কোনো কিছুই স্থির নয় । এখন কে কোথায় ছিটকে পৃথিবীর কোন জায়গায় আছেন তার সন্ধান করা সহজ কাজ নয় । জয়ন্ত দা বসে বসে এইসব ভাবছেন আর মনে মনে প্রার্থনা করছেন, যে যেখানেই থাকুন, তারা যেনো সবাই সুখে শান্তিতে থাকেন ।অসহযোগ আন্দোলন শেষে তিনি ১৯২৩ সালে চট্টগ্রামের দেওয়ান বাজারে অবস্থিত উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। এ সময় থেকে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিকট মাস্টারদা নামেই অধিক পরিচিত হয়ে উঠেন। মাষ্টারদার বিয়ে করেন তারপর ফুলশয্যা। কিন্তু এই বিবাহের রীতি তিনি মেনে চলেন নি। ফুুলশয্যা না করেই এই সাধক গ্রাম ছাড়েন আর কোনদিন স্ত্রীর মুখ দেখেন নি।

তারপর ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি গোপনে কয়েকবার কলকাতা গিয়ে যুগান্তর দলের কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করেন। চট্টগ্রামে কিভাবে চরমপন্থী কার্যকলাপ আরও শক্তিশালী করা যায় এটাই তাঁর লক্ষ্য হয়ে উঠে। তাঁর কার্যকলাপ তখন পুলিশের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ে। ১৯২৬ সালে ১নং বেঙ্গল অর্ডিনেন্স অনুসারে কলকাতায় তিনি গ্রেফতার হন এবং তাঁকে জেলে আটক রাখা হয়। কিছুদিন পরে তাঁকে রত্নগিরি জেলে স্থানান্তর করা হয়। ১৯২৮ সালে অসুস্থ স্ত্রীকে দেখবার জন্য তাঁকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয় কিন্তু কিছুদিন পরেই তাঁর স্ত্রী বিয়োগ ঘটে। ১৯২৮ সালের শেষের দিকে তিনি জেলা থেকে মুক্তি পান। মুক্তিলাভের পরেই তিনি কলকাতা ও চন্দনগরের বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে চট্টগ্রামে বিপ্লবী সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ঐ বছরের ডিসেম্বর মাসে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে চট্টগ্রাম থেকে যোগদানকারী প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করেন। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ বছরের মে মাসে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস সম্মেলনের তিনি প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। মাস্টারদা এবং তাঁর অনুসারীরা চট্টগ্রামে একটা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিষয় নিয়ে সুভাষ বসুর সাথে একান্তে আলোচনা করেন। ১৯৩০ সালে কংগ্রেসের আহবানে আইন অমান্য আন্দোলন মাস্টারদার দলের পক্ষে সুযোগ সৃষ্টি করে। অনন্ত সিং, গনেশ ঘোষ প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তরুণদের অস্ত্র চালনা শিক্ষা এবং অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তৎপর হয়ে উঠেন। এপ্রিল মাসে গোপনে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি গঠিত হয় এবং বিপ্লবীরা সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পরিকল্পনা মতে ১৮ এপ্রিল বিদ্রোহের ঘোষণা পত্র জারি করা হয়। এই তারিখের রাত্রেই তাঁরই নেতৃত্বে ও নির্দেশে প্রায় একই সঙ্গে বিপ্লবীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ধূম স্টেশনে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, টেলিফোন ভবন আক্রমণ, পুলিশ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, অক্সিলিয়ারী অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ প্রভৃতি সংঘটিত করে। এ সকল আক্রমণ পরিচালনার পর বিপ্লবীরা উত্তর দিকে অবস্থিত জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। ২২ এপ্রিল সরকারি সৈন্য জালালাবাদ পাহাড় আক্রমণ করলে বিপ্লবীদের সাথে ইংরেজদের সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জালালাবাদ সংঘর্ষের পর মাস্টারদার নির্দেশে বিপ্লবীরা নূতন রণ কৌশল গ্রহণ করেন।

নূতন রণ কৌশলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেওয়া, অধিক সংখ্যায় তরুণদের ভর্তি করা এবং ইউরোপীয় ও পুলিশদের উপর অতর্কিত আক্রমণ পরিচালনা করা। ১৯৩২ সালে পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে পুলিশের সাথে সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীদের সংঘর্ষ হয়। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এর নেতৃত্বে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি দল ১৯৩২ সালে ১৩ জুন বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল ঘিরে ফেলে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ক্যামেরন মারা যান এবং সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

মাষ্টারদা বললেন, ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো সাধনার সময়। বন্ধুরুপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এইতো সময়। চলে যাওয়া দিনগুলোকে স্মরণ করার এই তো সময়। কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। প্রিয় আমার ভাই-বোনেরা আমার এই জীবনের একঘেয়েমিকে ভেঙে দাও তোমরা। উৎসাহ দাও আমাকে। এই আনন্দময়, পবিত্র, ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত আমি তোমাদের জন্য কি রেখে গেলাম? মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার স্বপ্ন, একটি সোনালী স্বপ্ন। স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। কী শুভ মুহূর্ত ছিল সেই টি যখন আমি এই স্বপ্ন দেখেছিলাম। বিগত জীবনে আগ্রহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটেছি। জানিনা কতটা সফল হতে পেরেছি। জানিনা কোথায় সেই অনুসরণ, আজ থামিয়ে দিতে হবে আমাকে। লক্ষে পোঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল তোমাদের স্পশ করলে তোমরা অনুগামীদের হাতে এই অন্বেষণ এর ভার তুলে দেবে-যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। প্রিয় বন্ধুরা-এগিয়ে চল-কখনো পিছিয়ে যেও না।ওই দেখা যাচ্ছে স্বাধীণতার নবারুণ। উঠে-পড়ে লাগো। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।১৯৩০ সনের ১৮ এপ্রিলের চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনদিন ভুলো না। জালালাবাদ, জুলদা, চন্দননগর, ও ধলঘাট সংগ্রামের কথা সবসময় স্পষ্ট মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যেসব দেশপ্রেমিক তাঁদের জীবন দান করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো। আমাদের সংগঠনে যেন বিভেদ না আসে — এই আমার একান্ত আবেদন তোমাদের কাছে।

তথ্য সংগৃহীত।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।