T3 || ভ্যালেন্টাইনস ডে ও সরস্বতী পুজো || স্পেশাল এ সুদীপ ঘোষাল

সরস্বতী পুজো ও শ্যামলের মা

 

আজ সরস্বতীপুজো। রাতে অনুষ্ঠানে হারমোনিয়াম নিয়ে উঠতি সংগীত শিল্পী, শ্যামল পরপর পাঁচটি গান সরস্বতী মা’কে শোনালো। গান শুনে শ্যামলের গর্ভধারিণী মায়ের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। শ্যামলের কণ্ঠে সংগীত শুনলেই তার মা সবসময় আবেগে আপ্লুত হয়ে যান। শেষ গানটি ” সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে ” গানটি শোনার পরে মা শ্যামলকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন।

শ্যামল নিচে নেমে মায়ের কাছে এলো।তার মা জীবনে অনেক কষ্ট করে ছেলেদের মানুষ করেছেন।
দুবছর আগে শ্যামলের বাবা আকাশের তারা হয়ে গেছেন। সেই থেকে মায়ের মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ সব খাওয়া বন্ধ। কালো পাড় সাদা শাড়ি পরে থাকেন । শ্যামল তার মাকে বলে, আমরা নাকি আধুনিক হয়েছি। শুধু বইয়ের পাতায়, স্টোজে নেতার বক্তৃতায়। বাস্তবে অন্য ছবি। করে ঘুচবে ভারতের এই দুর্দশা। শ্যামল মায়ের সঙ্গে বসে রোজ এবেলা ওবেলা দু’বার আর মনের কথা বলে। যত কাজই থাকুক শ্যামল মায়ের সঙ্গে সময় কাটাবেই।তার মা বলেন,সমাজে থাকতে গেলে সহ্যশক্তি বাড়াতে হয়, দেখবি একদিন মানুষ সব বুঝবে।খাওয়া ব্যাপারটা একান্ত নিজস্ব।এতে এত সংকীর্ণ মনোভাব রাখা উচিত নয়।শ্যামলের মা খাওয়ার পর অভ্যাসমতো উঠে আসেন। আসন গুটিয়ে রেখে দেন।
আজ সরস্বতী পুজো। বাড়িতে পুজো করে শ্যামল নিজে। সে ব্রাহ্মণ নয় তো কী হয়েছে।শ্যামলের মা বলেন, নিজের মনের মন্দিরে পূজার অর্ঘ্য যদি ভক্তি হয়, তাহলে অন্য কাউকে প্রয়োজন হয় না। নিজেই করা যায় সবকিছু। ‘আত্মবৎ সর্বভূতেষু’ – এই আপ্তবাক্যটি শ্যামলের জীবনের এখন প্রধান মন্ত্র। তাই তার কারও সঙ্গে ঝগড়া হয় না। মনোমালিন্য হয় না। আজীবন গান করেই জীবন কাটাতে চায়। আর মা। গান আর মা। এই হলো তার জীবনের বড় পাওনা। সরস্বতী পূজার পরে শ্যামল প্রতিবেশীদের ডেকে প্রসাদ বিতরণ করল। তারপর বাড়ির লোকেদের দিলো। তারপর মাকে প্রণাম করার পরে নিজে খেলো। তার এই আদর্শ দেখে অনেকে তার মতো পথ চলতে চায়, কিন্তু ক’জনে পারে?
তারপর শ্যামলের মা দোতলার ঘরে চলে এলেন। বয়স হয়েছে, দুজনে ধরে নিয়ে গেলেন।

আজ নেতাজি সংঘের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সরস্বতী পুজোয় হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছেন। দশজন বিখ্যাত লোককে আজ সম্মাননা জানানো হবে। তারপর গান ও নাটক। এলাহি ব্যাপার। উদ্বোধনী সংগীত শুরু করলো শ্যামল। শ্যামলের গানের পর একে একে সভার নিয়ম অনুযায়ী সব কাজ করতে শুরু করলো। শ্যামল এসে বসল নীচে অধীরের পাশে। অধীর এপাড়ার বুদ্ধিমান ছেলে। সে শশব্যস্তে শ্যামলের পাশে বসে কথা বলতে শুরু করলো। এতবড় বিখ্যাত শিল্পী, যে তার পাশে বসতে পারে তা সে চিন্তা করতে পারেনি। অধীর বলল, “শ্যামলদা আপনি চেয়ারে বসুন।

-নারে, আমার নীচে বসতেই ভালো লাগে।

-আমার কেমন কেমন করছে।

-কিছু ব্যাপার না। তুই চুপ করে বসে অনুষ্ঠান দেখ। অধীর দেখল একটি লোক শ্যামলের দিকে এগিয়ে আসছে। কি তার উদ্দেশ্যে বোঝা যাচ্ছে না। কাছে এলে লোকটি বলল,’ শ্যামলবাবু, একবার শুনুন

—রমেনদা আমাকে কিছু বলছেন?

হ্যাঁ, একটা কথা আছে।

– কি বলুন।

রমেনবাবু আমতা আমতা করছেন। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। কি করে কথাটা শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না। শ্যামল প্রতিবেশী রমেনবাবুকে চেনেন। শান্তশিষ্ট, পরোপকারী এই লোকটাকে শ্যামলের খুব ভালো না তো। সাহস দিয়ে বললেন, ‘বলুন না কি হয়েছে বলুন??

-না, আপনি বাড়ি চলুন।

-আরে বলুন না। এখানেই বলুন।

-আপনার মা-মা, মানে মা আর নেই।

-কখন কীভাবে?

–সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে হার্টফেল করেছেন।

শ্যামল ছবির মতো স্থির হয়ে গেলো। মাথাটা বনবন করে। ঘুরতে শুরু করলো। তারপর আর কিছু মনে নেই। এদিকে

অনুষ্ঠান হচ্ছে। সকলের দৃষ্টি সেই দিকে। চারজন ছেলেকে নিয়ো রমেনবাবু শ্যামলকে পথের একটি বাড়ির বারান্দায় শোয়ালেন। মাথায় জল দিলেন, সবাই হাওয়া দিলেন হাতপাখা ঘুরিয়ে। মিনিট দশেক পরে শ্যামলের জ্ঞান হলো। জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু এতবড় বাক্কা সামলানো মুখের কথা নয়। মা অন্তপ্রাণ শ্যামলবাবু কাঁদতে শুরু করলেন। চারজন ছেলে ও রমেনবাবু ধরে শ্যামলকে বাড়ি নিয়ে চললেন। শ্যামলের এখন একটাও শ্যামাসংগীত মনে আসছে না। একিহলো তার বিপদে আপনে কোনদিন এরকমতো হয়নি। শ্যামল ক্লান্ত পায়ে পথ চলেছে। বাড়ি আর আসছে না। যত দেরি হয় ততই ভালো। মায়ের মরা মুখ দেখতে চায় না। কি করে দেখবে। যে মায়ের সঙ্গে দু’বেলা কথা না বললে আর ঘুম হয় না। সে কি করে আজ মায়ের সামনে দাঁড়াবে। হঠাৎ সে ঘুরে দাঁড়ালো। নাঃ বাড়ি যাবো না।” শ্যামল দৌড়চ্ছে, পালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ অমল দেখতে পেল শ্যামলকে। জড়িয়ে ধরে ফেলল শ্যামলকে, ‘কি হয়েছে তোর?’ পাগলের মতো করছিস। কেন?’ইতিমধ্যে পিছন পিছন রমেনবাবু এসেছেন, অমলকে দেখে শাস্ত হলেন। বললেন, ‘শ্যামলের মা আর নেই। তা উনি বাড়ি না গিয়ে এদিকে ছুটছেন।’বাল্যবন্ধু শ্যামল সবকিছু বুঝতে পারলো এক লহমায়। বাল্যবন্ধুরা একবার দেখলেই বন্ধুর মনের ছবি দেখতে পায়। এবার অমল ও রমেনবাবু বরে ধরে শ্যামলকে বাড়ি নিয়ে আসছেন। শ্যামল বোবা হয়ে গিয়েছে। এখন কোনো কথা বলছে না। শুধু দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। বাড়ির কাছে যেতেই দেখতে পেল অনেক মানুষের ভিড়। মাঝে দেখা যাচ্ছে না। ভাই, ভ্রাতৃবধূ ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে। শুধু একটা কান্নার সুর ভেসে আসছে। আর মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। মা বেঁচে থাকতে বলতেন, সত্যকে সব সময় সহজভাবে নিবি। কোনো কিছুর বিনিময়ে সত্যকে ত্যাগ করবি না। তুই এখন বয়সে ছোটো কিন্তু এখন থেকেই দুঃখ আর সুখকে সহজভাবে মানতে শিখতে হবে।তবেই তুমি প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারবে।

শ্যামল এগিয়ে যায় সামেনের দিকে, একটা কালো ঘোড়া দাবিয়ে বেড়াচ্ছে তার মনে।এখন মা সরস্বতীর মুখ আর তার মায়ের মুখের ছবি একত্রে মিশে যাচ্ছে তার নয়নজলে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।