|| কালির আঁচড় পাতা ভরে কালী মেয়ে এলো ঘরে || T3 বিশেষ সংখ্যায় সুদীপ ঘোষাল

চ্যালেঞ্জ

বাবুল ছোটো থেকেই একরোখা জেদি ছেলে।কোনো ভয়ডর তার হৃদয়ে নেই।এক ডুবে সাঁতরে পুকুর পার হওয়া,গাছে ওঠা সবেতেই সে সিদ্ধহস্ত। সব বন্ধুরা তার বশ্যতা স্বীকার করে নিত অনায়াসে।তবু দেখতো বাবুল,দু একজন বন্ধু তার পিছনে নিন্দা করছে। একদিন রবি এসে বললো,জানিস বাবুল তোর নামে হিরু খুব খারাপ কথা বলে। বাবুল বললো,তোকে বিশ্বাস করে হিরু যা বলার বলেছে। তুই আবার কেন সেই কথাগুলো প্রকাশ করছিস।রবি লজ্জিত হলো, বললো,আর কখনও এরকম ভুল হবে না। তোর কাছে মস্ত শিক্ষা পেলুম।

বাবুল বাড়িতে দেখেছে, তার বাবার দাপট। বাড়িতে একটু দেরি করে ঢুকলেই তার কৈফিয়ৎ দিতে হতো হাজারটা। বাবার দুবেলা তিন ঘন্টা করে মোট ছ ঘন্টা আহ্নিকের সময় সবাইকে চুপ করে থাকতে হতো।কথা না বলে ধীরে সব কাজ সারতে হত মাকে। বাবুল পড়তে বসে হারিয়ে যেত বইয়ের ছবিতে। ওর চোখে ভেসে উঠত আমেরিকার ঝলমলে শরীর,টরেন্টোর বিলাস বহুল শহুরে আদব কায়দা। মাঝে মাঝে সে ঘুমের ঘোরে বলে উঠত, আমি যাবো, আমি যাবো, আমেরিকা,টরেন্টো। তার মা ডেকে বলতেন,কি সব বলছিস তুই। কোথায় যাবি?আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবি তুই।

তারপর সুখে,দুখে,শোকে কেটে গেছে অনেকটা সময়। বাবুল হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় স্টার মার্কস পেয়ে পাশ করেছে। সবাই খুব আনন্দিত। কিন্তু বাবুলের মনে অন্য চিন্তা। সে একদিন রাতে মায়ের আলমারি খুলে সব গহনা হাতিয়ে নিলো। তারপর রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো বাবুল। তার মা সকালে উঠে দেখলেন,আলমারি হাট করে খোলা। কোথাও কিছু নেই। সোনাদানা, টাকা পয়সার থেকেও দামি তার সোনার ছেলে বাবুলও কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। বাবুলের মা, বাবা পরামর্শ করলেন, চুরি যাওয়ার ঘটনা চেপে যেতে হবে।

তারা একটা চিঠি পেলেন টেবিলের উপর। তাতে লেখা,

মা ও বাবা,তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না। আমি পড়াশোনার জন্য বিদেশ চললাম। বাবা যেতে দেবেন না বলে আমি নিজেই ম্লেচ্ছ হতে যাচ্ছি। তোমাদের নেওয়া জিনিসের আমি সদ্ব্যবহার করবো। তোমরা আমার জন্য দুঃখ কোরো না। ভালো থেকো।

ইতি —তোমাদের বাবলু।

তারপর সময়ের স্রোতে কেটে গেলো অনেকগুলো বছর। কিন্তু বাবলুর কোনো খবর পাওয়া গেলো না।

এদিকে বাবলু সোনাদানা,টাকা পয়সা নিয়ে চলে এলো কলকাতায়। সেখানে সোনাদানাগুলো সোনাপট্টিতে বিক্রি করলো। তারপর একটা ঘর ভাড়া করলো। তার সঙ্গে পার্ক স্ট্রীটের এক ইংরেজ মহিলার সঙ্গে পরিচয় হলো। পড়াশোনার জন্য সে বিদেশ যেতে চায় শুনে মহিলাটি তাকে সব রকমের সাহায্য করলেন। বাবলু সময় ঠিক করে একদিন সুইজারল্যান্ডে পাড়ি দিলো। সেদিন তার খুব আনন্দের দিন। জাহাজে তার সঙ্গে পরিচয় হলো এক ভদ্রলোকের। তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝেই কলকাতা আসেন। বাবলু বললো,আপনি আমাকে একটা কাজ দেবেন। আপনার কাজ করে দেবো। ভদ্রলোক বললেন, সুইজারল্যান্ডে তার হোটেল আছে। সেখানে তাকে একটা কাজ নিশ্চয় দেওয়া হবে।

বাবলু ভাবতে পারে নি, এত সহজে সব কাজ হয়ে যাবে। জাহাজের বাইরে পাটাতনে বসে বাবলু সমুদ্র দেখছে।এক নীল অসীম সমুদ্রের হাতছানিতে তার হৃদয় দুলে দুলে ওঠে। বাঙালী ঘরের ছেলে হলেও অন্তর তার শক্ত। এখন তার আর মায়ের মমতা কিংবা বাবার শাসন কিছুই মনে পড়ছে না। এগিয়ে যাওয়ার এক নেশায় সে মশগুল।

জাহাজ নোঙর বাঁধলো। চলে এলো অন্যদেশে,অচিনপাড়ে। জাহাজের সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক বাবলুকে নিয়ে চলে এলেন নিজের বাসভূমিতে।বাবলু কাজের ছেলে।নিজের ঘরটা বুঝে নিয়ে মালপত্তর দু চারটে যা ছিলো গুছিয়ে রাখলো।প্যান্টের পকেটে টাকাগুলো রাখলো। এখন টাকাই বল, ভরসা। এখানে তো আর টাকা চলবে না। ভদ্রলোক বললেন, ব্যাংকে গিয়ে এক্সচেঞ্জ করিয়ে নেবেন। খাওয়াদাওয়ার পরে একঘুমে সকাল। তারপর কাজ আর কাজ।

এই কাজের দেশে এসে বাবলু বুঝে গেছে কাজ করতে পারলে সুইজারল্যান্ডে খাওয়ার অভাব হয় না। ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের কাছে জেনেছে সে,কেউ কারও দাসত্ব করে না এদেশে। খাটো খাও মৌজ করো। রাতে কলেজে পড়াশোনা করে বাবলু। পড়াশোনার জন্যই এখানে আসা তার, সেকথা সে ভোলে নি।

আজ পাঁচ বছর কেটে গেলো বাবলুর স্বপ্নের মত। একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী সে হাসিল করেছে এতদিনে। আর তাকে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। একটা বড় কম্পানী তাকে চাকরী দিয়েছে। ফ্ল্যাট দিয়েছে। মাইনে অনেক টাকা। আর তার কোনো চিন্তাই নেই। এক বড়লোক মহিলাকে সে বিবাহ করেছে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য।বিশাল সম্পত্তির মালকিন সেই মহিলা। একদিন গাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় মহিলার আ্যক্সিডেন্ট হয়। একদম স্পট ডেথ।তখন বাবলু অফিসে ছিলো। এসেই দেখলো চারদিকে পুলিশের ভিড়। বাবলুর চোখে জল রক্ত দেখে।বড় ভালোবাসতো মহিলাটি তাকে। তার স্ত্রী আজ আর নেই। হিসেবমত বডি সৎকারের কাজকর্ম মিটে গেলে সম্পত্তির একমাত্র মালিক হলো বাবলু।

বাবলু লোভি নয়। সে এখন ভালোই রোজগার করে। তবে হাতের সম্পত্তি তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। বাবলুর অই বাড়িতে আর ভালো লাগতো না। একটা কান্না ঘুরে বেড়াতো বাড়িটা জুড়ে। তাই সে বাড়িটা বিক্রি করে দিলো।গাড়িটাও বিক্রি করে দিলো। সব টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত করে রেখে দিলো। তারপর একটা কম বয়সী মেয়ে দেখে আবার বিয়ে করলো। বছর দুই পরে ফুটফুটে একটি মেয়ে হোলো।

দেখতে দেখতে মেয়ে দশ বছরের হয়ে গেলো।বাবলুর এবার একবার দেশের বাড়ি যাবার ইচ্ছে হলো। সবাইকে নিয়ে চলে এলো নিজের দেশ ভারতবর্ষে। দেশের মাটিতে পা দিয়েই বাবলু একমুঠো ধুলো গায়ে হাতে পায়ে মেখে নিলো। বললো,আঃ কি সুন্দর গন্ধ।পৃথিবীর কোনো পারফিউম এর থেকে সুন্দর নয়। বাবলুর দেখাদেখি মেমসাহেব আর মেয়ে ধুলো নিয়ে গন্ধ শুঁকলো।কিন্তু তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হোলো না। হবে কি করে? তারা তো আর এই মাটির গর্ভে মানুষ হয় নি। তারপর কোলকাতা থেকে সোজা মায়ের কাছে চলে এলো বাবলু।

বাবলুকে দেখে মা কেঁদেই আকুল। মা বললেন,তোর বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। আমি তোকে একবার শেষ দেখা দেখবো বলে বেঁচে আছি। বাবলু বললো,এই নাও মা তোমার সব গহনা,টাকা, পয়সা সব। আমাকে ক্ষমা করে দিও মা। মা বললেন,তুই মানুষের মত মানুষ হয়েছিস। আমার আর কোনো দুঃখ নেই। তুই আমাকে কলকাতার বাড়িতে তোর ভাইয়ের কাছে রেখে যা। আর এই বাড়ি গ্রামের স্কুল গড়ার কাজে দান করে দে। তোর বাবার নামে এই স্কুলের নাম হবে, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ। বাবলু বললো,তাই হবে মা। তোমার কথার অন্যথা হবে না। তারপর সেই বাড়ি আজ বিরাট বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।

প্রায় ছমাস ভারতে কাটিয়ে আবার ফিরে এলো সুইজারল্যান্ডে।বৃষ্টিভেজা এই দেশে সবুজের সমারোহ।টইটম্বুর জলাধার মনে দাগ কাটে।শীতের মরশুমে জানালার কাঁচে রেখে যায় বরফের ছাপ।এদেশের বেশির ভাগ বাড়ির চাল ঢালু। বৃষ্টি বা বরফ গড়িয়ে পড়ে।কিছু ঐতিহাসিক স্থান দেখে মন জুড়িয়ে যায়। এদেশে থাকতে থাকতে বাবলুর কেমন একটা ভালোবাসা জন্মে গেছে মনে।

বাবলু সেদিন অফিসে গেছে। রাতে ফিরে এলে তার সুখের সংসারে আগুন লাগলো।বাবলু দেখলো তার স্ত্রী ও মেয়ে একসাথে এক অপরূপ সুন্দর যুবকের সাথে যৌনক্রিড়ায় মত্ত। বাবলুর মেয়ে কুড়ি বছরের। বৌ এর বয়স বিয়াল্লিশ। আর বাবলুর বয়স আটান্ন।বাবলু ভারতবর্ষের ছেলে। সেখানকার সভ্যতা তার মনে প্রাণে। এই দৃশ্য দেখার পরে সে আর বাড়ি ঢোকে নি। অন্য এক বাড়ি ভাড়া করে ছিলো কয়েকবছর। তারপর ডিভোর্স দিয়ে ছাড়াছাড়ি করে নেয় তাদের সম্পর্ক। মেয়ে থেকে যায় মায়ের কাছে। বাবলুর আর কোনো বাধা নেই। এবার সে ভারতবর্ষে বাকি জীবনটা কাটাবে শান্তিতে।ভারতবর্ষের মাটির গন্ধ সে ভুলতে পারে নি।ফোর জি বা ফাইভ জির সুবিধা, আরাম তাকে দেশের মাটির গন্ধ ভোলাতে পারে নি।

চলে এলো বর্ধমানের গাংপুরে। তার মা, বাবা কেউ আর বেঁচে নেই। ভাইরা নিজের নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বাবলু দশটা কাজের ছেলে রাখলো আর পাঁচটা কাজের মেয়ে। প্রায় কুড়ি বিঘে জমির উপর পুকুর,বাড়ি,বাগান। এসব দেখাশোনার জন্যই সে এত লোক রাখলো।আর নিজে অবসর কাটানোর জন্য প্রচুর পড়াশুনা করে। বিগত জীবনের কোনো মায়া তাকে আটকে রাখতে পারে না। বাবলু এখন দেখতে পায় আলোর ফুলকি। ফুলকিগুলো লাল,সবুজ,নীল হরেক রঙের আলো ছড়িয়ে নিরাকার এক মূর্তি মনে তৈরি করে। বাবলু এখন তার সাধনায় পরশ পাথরের খোঁজ করে। একদিন হয়ত তার সন্ধান পাবে…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।