।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় আকাশ কর্মকার

প্রেমিক

রাত আড়াইটে। শুনশান রাস্তা দিয়ে লালবাতিওয়ালা গাড়িটা নিঃশব্দে ওই শ্মশানটার ঈশান কোণে গিয়ে দাঁড়ালো। শীতকালের রাত, ঘন কুয়াশায় আবছা হয়ে আছে চারিপাশ। দু’চারটে কুকুর আর ঝিঁঝিঁর শব্দ ছাড়া বাকি সবাই নিশ্চুপ।
হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে এক খাঁকি উর্দি পরা বাবু আটচালাটার দিকে এগিয়ে এসে বললেন- “হারু.. এই হারু! ঘুমোচ্ছিস নাকি? আহা, সাড়া দিসনা কেন?”
হারু এই শ্মশানেরই এক হরিজন।
পুলিশ বাবুর হাঁক-ডাকে ছোট্ট ভাঙ্গা ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো এক পঁচিশোর্ধ যুবক।
বাঁ হাত দিয়ে চোখ রগড়ে সে বলল -“আজ্ঞে, বলুন”
পুলিশ বাবু হারুর একটু কাছে গিয়ে বললেন-” ওই যে দেখছিস; নে তাড়াতাড়ি কাজ সার!”
মাথা চুলকে হারু বললে-” আজ্ঞে পুরুষ না মহিলা? ” এবার অত্যন্ত বিরক্ত প্রকাশ করে বাবু বললেন -“বেওয়ারিশ লাশের কোনো লিঙ্গও হয়না আর কোনো ঠিকানা ও হয়না। যাও এবার কাজটা সেরে আমাকে উদ্ধার করো.. “
হারু এগিয়ে মৃতদেহের মুখ থেকে কাপড়টা সরাতেই শিউরে উঠলো!
অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়া বীভৎস একটা নারী দেহ; তার হাতের আগুনে চোখের নিমেষে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী রূপ নিয়ে ক্রমশ বিলীন হতে লাগলো পঞ্চভূতে। হারু বাকী রাতটুকু আটচালাটার খুঁটিতে এলিয়েই কাটিয়ে দিল।
ভোর হয়ে এলো। নির্জন রাস্তাটা আবার গমগম করে উঠেছে। প্রতিদিনের মত আজকের দিনটা শুরু হলো না কারণ আজ এক বিশেষ দিন। আজ মালতির জন্মদিন। কথায় বলে সময়ের কাঁটা সর্বদাই প্রবাহমান, কিন্তু বাপ-মা হারা হারুর জীবনে সময়ের কাঁটা যেন স্থির। তাই চব্বিশ বছর পূর্বের এই অনাথ শিশুটির ঠাঁই মেলে এপাড়ার শ্মশানে। ছোটবেলার আবদারে মাখা দুষ্টুমিতে হারু মন জয় করেছিল সবার। তবে শৈশবের ঘোর কাটিয়ে তার শুষ্ক হৃদয়ে অকালবর্ষণের কারণ মালতি। অনেকটা সেই সেলফিশ জায়েন্টের বাগানের মত।
পাড়ার শিব মন্দিরের পাশে দোতলা বাড়িটার নিচের তলার এক্কেবারে কোণার ঘরটা হলো মালতির। বছর দুয়েক আগের কোনো পথ দুর্ঘটনায় এক পৃথিবী দায়িত্ব আর ছোট ভাইকে মালতির কাছে রেখে তার বাবা-মা যাত্রা করেন চির শান্তির পথে। তখন থেকেই শুরু মালতির জীবনযুদ্ধ..
কাকুর ভিটেতে অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত মেয়েটি বাড়ি বাড়ি কাজ করে ফেরে। মাসের শেষের সমস্ত টাকার অংকের কিছুটা অংশ ছোট ভাইয়ের জন্য সরিয়ে রেখে বাকিটুকু কাকিমার হাতে তুলে দেয়। ছোট ভাইটাকে দাঁড় করাবে নিজের পায়ে, মালতির জীবনের যেনো এই একটাই লক্ষ্য। এই বেরঙিন ছন্নছাড়া জীবনটার একমাত্র ভরসার হাত দুটো ছিল হারুর। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির শেষে একটু দূরে ওই ঝিলের পাড়ে একান্তে সময় কাটায় ওরা। কালবৈশাখীতে ভেঙ্গে যাবার নিশ্চয়তা জেনেও ঠিক যেমন বাবুইরা তিল তিল করে গড়ে তোলে তাদের বাসা; ওদের ভালোবাসাটাও ছিল ঠিক এরকমই। না ছিল ভবিষ্যতের বাসা গড়ার স্বপ্ন, না ছিল আগামীকালের নিশ্চয়তা! শুধু একবুক ভালোবাসার মোড়কে দুটো মানুষ তাদের সবটুকু দূরত্ব হাওয়ায় মিলিয়ে দিতো।
-“কাকু ওই লাল গোলাপ গুলো কত করে? আমায় দুটো দাও তো!” প্রতিবছরের মতো পাড়ার মোড়ের নবীন কাকার ফুলের দোকানটা থেকে দুটো গোলাপ কিনে, সেই পরিচিত জায়গাটায় হারু অপেক্ষা করতে লাগলো।
কিন্তু অপেক্ষার প্রহর ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো। এখন বিকেল গড়িয়ে গোধূলির আলোয় কমলা হয়ে উঠছে চারিপাশ। বহু যত্নে হাতে ধরা গোলাপগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে হারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এমন একটা বিশেষ দিনে প্রেয়সীর অনুপস্থিতি নিজেরই অজান্তে তার মনে অভিমানের কালো মেঘ জমাতে লাগলো। অবশেষে শহরজুড়ে আরেকটা সন্ধে নামলো। হারু হাঁটা দিল গন্তব্যের পথে.. হাজারো প্রশ্ন আর একরাশ অভিমানে অধিকারবোধের গল্পটা যেন কোথাও ছাইচাপা রয়ে গেল। উদাসীন মনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে সামনে তাকিয়ে দেখে, খানিকটা দূরে একটি নয়-দশ বছর বয়সী ছেলে রাস্তায় বসে গুমরে গুমরে কাঁদছে। হারু এবার শীঘ্র পা চালালো। তার কাছে যেতে একপ্রকার চমকে উঠলো..
আরে, এ তো মালতির ভাই!
আরেকটু কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে হারু বলল-” রাত হচ্ছে, এখানে বসে কাঁদছিস কেন? দিদি বকেছে বুঝি?”
শার্টের কলারে চোখের জলটা মুছে কাঁপা কাঁপা গলায় সে উত্তর দিলে -” না! কাকু বার করে দিয়েছে তার বাড়ি থেকে”
এবার বেশ বিরক্তির সুরে হারু বলল-” কেন তোর দিদি কোথায়? সে কিছু বলেনি? “
ছেলেটা আবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তখন তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল হারু। খানিক সামলে নিয়ে তার দিকে চোখ তুলে ছেলেটা বললে-” দিদি তো নেই, দিদি মরে গেছে!”
-“কি……!!” আঁতকে উঠল হারু। তার পায়ের নিচের মাটিটা যেন একটু একটু করে যেনো চোরাবালিতে পরিণত হতে লাগল। এই পাড়ার সমস্ত মৃতদেহ আজ অব্দি সেই দাহ করে এসেছে, তবে মালতি..! কোথায় সে? সে তো আর উদ্বায়ী বস্তু নয় যে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে!
হারুর মনে এক নিমেষে ঘুরতে গেল হাজার হাজার রাসায়নিক সমীকরণ।
-” না না বিশ্বাস করি না! এ আমি বিশ্বাস করিনা..!” এই বলে সে হাঁটতে হাঁটতে দূর রাস্তার কুয়াশায় মিশে গেল।
কিন্তু তার মনের উদ্বেগ আর শান্ত হবার নয়.. হাতের মুঠোতে থাকা গোলাপগুলো কাঁটা হয়ে রক্ত ঝরাচ্ছে। তার মনের অস্থিরতা যেন ক্রমশ চূড়ান্ত রূপ নিতে লাগল। গুরু মস্তিষ্কের ভেতর নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতে এক দৌড়ে সে সদর দরজায় এসে উপস্থিত হলো।
থানার বড়বাবু ওরফে মতিলাল মুখুজ্জে ছোটবেলা থেকেই হারুকে ভীষণ স্নেহ করতেন। অসময়ে হঠাৎ উসকো খুসকো চুলে ফ্যাকাশে মুখের হারুকে দেখে সটানে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন -” কি..কি হয়েছে রে? হাঁপাচ্ছিস কেন? বস এখানে..
এই কে আছো একটু জল দাও !
হ্যাঁ কি হয়েছে বল তো?”
হারু কিঞ্চিত দম নিয়ে- “মালতি..!” বলে আবার হাঁপাতে লাগলো।
-” হ্যাঁ কি হয়েছে তার?” বলে মুখুজ্জে বাবু জলের গ্লাসটা হারুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
হারু বল্লো-” সে নিখোঁজ.. তার ভাই ভিক্ষের বাটি হাতে রাস্তায় বসে, সে বল্লো মালতি নেই!! কোথায় সে? কোথায়?”
হারুকে শান্ত করে বাবু বললেন -“আচ্ছা দেখছি আমি তুই ফিরে যা, আমি ঠিক একটা খবর নিয়ে তোকে জানাবো..”
রাত বেশ গভীর। শীতের চাদরমোড়া রাতে, এই জনমানবহীন রাস্তায় একটা উন্মাদপ্রায়, ক্লান্ত প্রেমিক ছাড়া আজ আর কেউ নেই।
মালতির ডালাভর্তি স্মৃতির ঝলকানিতে হারুর নেশাগ্রস্থ শরীরটা শিউরে উঠছে বারবার।
নিশ্চুপ স্মশানটায় আজ একটাও চিতা জ্বললো না। ক্লান্ত চোখটা আজ যতবারই বুজে আসছে, ততবারই মালতির হাসিটা যেনো ঝলকে উঠছে।
রাত তিনটে। আবার শ্মশানটার সামনে কালকের বড়ো গাড়িটা দাঁড়ালো। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মুখুজ্জে বাবু। হারুকে দেখতে পেয়ে মাথা নিচু করে তার দিকে এগিয়ে গেলেন।
নেশায় অসাড় শরীরে হারু নড়ে চড়ে বসলো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবার বড়োবাবু বললেন-” সমাজ বড় নিষ্ঠুর, বাস্তব বড় কঠিন, আর ভবিষ্যৎ; অন্ধকার অরণ্যে এক পথহারা পথিকের মতো। সামনে ওৎ পেতে থাকে বিপদ, যার আভাস পেলেও সম্মুখীন হওয়া দুষ্কর”
এত জটিল শব্দছকের মায়াজালে হারুর নিষ্পাপ সরল মনটা ছটপটিয়ে উঠলো। চোখভর্তি হাজারো প্রশ্নের কান্না চেপে সে বলল -“আমার মালতি কই?”
মাথা থেকে খাঁকিরঙা পুলিশ টুপিটা খুলে বড়বাবু হারুর পাশে বসলেন। হারুর চোখে চোখ মেলাতে পারলেন না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন-” অনিমেষ সান্যাল। পাশের পাড়ার এক বিত্তশালী ব্যবসায়ী। তার শখানেক দাস-দাসীর মধ্যে একজন ছিল মালতি.. হ্যাঁ তোর মালতি!
বড়োলোক বাপের একমাত্র ছেলের চরিত্রের স্বভাবদোষে, তার চোখে পড়ে যায় এই নিরীহ মেয়েটা। মালতি কিছু বুঝে উঠবার আগেই… ” এই বলে বড়বাবু একবারে চোখ বুঝলেন, তারপর আবার বললেন-” আগেই তার হিংস্র লালসার থাবা পড়ে মালতির ওপর। তাকে একলা ঘরে পেয়ে কাপুরুষের মত ধর্ষণ করে খুন করে ওই জানোয়ার টা..”
এবার হারুর চোখ দুটো যেন পাথর হয়ে গেল..
বড়বাবু বলতে লাগলেন-” পরিচয় লোপাটের উদ্দেশ্যে এক তীব্র অ্যাসিড নষ্ট করে দেয় মালতির চেহারা। আর …. কাল রাতে তুই যার চিতায় আগুন দিয়েছিস সে আর কেউ নয় রে…. সে… “
এই বলে মুখুজ্জেবাবু পকেট থেকে রুমালটা বার করে চোখ মুছতে মুছতে গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলেন, হয়তো হারুর থেকে চোখের জল আড়াল করলেন..!
গাড়ির আলোটা জ্বলে উঠলো, আস্তে আস্তে দূরের কুয়াশায় মিলিয়ে গেলো।
বেচেঁ থাকার শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে আবছা চোখে হাতড়ে হাতড়ে হারু সেই জায়গাটায় এলো,যেখানের মাটির প্রত্যেকটা কনায় মিশে আছে এক প্রেমিকের অধিকার..
সেই মাটির কাছে দুটো গোলাপ নামিয়ে, তার বুকে আছড়ে হারু চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। এই বুকফাটা কান্নার আওয়াজ হয়তো আজ মালতির কাছে ঠিক পৌঁছে যাচ্ছে..!
বাকি থাকা কথাগুলো আর বলা হয়ে উঠলো না..
মালতি চলে গেছে। যেতে যেতে সে হারুকে দিয়ে গেছে এক আকাশ অধিকার। যে অধিকারে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে পার্থিব মায়াজাল থেকে মুক্ত করতে পারে, সেই অধিকারে একজন প্রেমিকও তার প্রেমিকার মুক্তি লিখতে পারে..!
হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। গোলাপের পাঁপড়ি গুলো বৃষ্টির রোশে যেনো মাটিতে মিশে যেতে লাগলো। শেষ উপহারটাও মালতির বেশ পছন্দ ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।