ক্যাফে ধারাবাহিক গল্পে সুবল দত্ত (পর্ব – ৫)

হন্যতে

আজ একটু আগেই বেরিয়েছে উল্লাস। উত্‍পলা ছাদের সিঁড়ির দিকে তাকায়। কিন্তু এখন ছাদে গিয়ে কি হবে? কটাশগুলো তো ঠিক সময় বুঝে তিনটের সময় আসে। উত্‍পলার নাকে ব্লিচিং এর ঝাঁঝালো গন্ধ এলো। দেখল উল্লাসের দরজা খোলা। ইতস্তত করে ঢুকেই পড়ে উল্লাসের ঘরে। দু তিনবার হাঁচি হয়। এত ব্লিচিং আর ফরম্যালডিহাইডের গন্ধে ও কাজ করে কি করে? অথচ ঘর বেশ ছিমছাম পরিষ্কার।টেবিল জুড়ে সিপিইউ আর মনিটরের প্যানেল,মাউস কী বোর্ড।একটা বুক সেল্ফ। শুধু সফটওয়ারের বই।এর মাঝে একটা মোটা মেডিক্যাল বই। হিউম্যান এনাটমি এন্ড পোস্টমর্টেম। এই বই পড়ে কি করবে উল্লাস? ঘরটা বেশ বড়। একপাশে আছে ওয়াশ বেসিন ও বাথরুম। সেটাতে তালা দেওয়া। উত্পলার ধন্দ লাগে। ঘর হাটকরে খোলা কিন্তু বাথরুমে তালা মারা? এগিয়ে এসে দেখে তালাটা আধুনিক নাম্বার লক। তিনটে নম্বরের রিং আছে। কমবিনেশন না মিললে এটা কারোর খোলার সাধ্য নয়।

অন্যমনষ্ক হয়ে উত্‍পলা বাঁ হাতে তালার রিং একটু একটু ঘোরাতে থাকে। ঠিক সেসময় তার সারা গা কাঁপিয়ে তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়।চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। যেন শয়ে শয়ে বৃশ্চিক পেটের নিচে দংশন করছে। তলপেট খামচে ধরে উত্‍পলা বাঁ হাতে তালা ধরে বসে পড়ে সেখানে। অসহ্য যন্ত্রনায় তালায় মোচড় দিতে থাকে আর চিত্কার করতে থাকে। মাথা ও সারা গা ঘামে ভিজে যায়। হঠাত্‍ বাঁ হাতে একটা ঝাঁকুনি ও খট করে শব্দ। চোখ বন্ধ হবার আগে উত্‍পলা অনুভব করে তালা খুলে গেছে। তারপর কিছু মনে নেই।

উত্‍পলা বাথরুমের দরজার পাশেই প্রায় পনেরো মিনিট অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। তলপেট অসাড়। উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো বাথরুমের দরজার লক খোলা। বাথরুম দেখার খুব ইচ্ছে হল। উল্লাস আসতে এখন অনেক দেরি। বাথরুমের ভিতরে ব্লিচিং ও ওষুধের উগ্র গন্ধ। অথচ পরিষ্কার ঝকঝকে। ভিতরে আইসক্রিম রেফ্রিজরেটরটা অন করা আছে। এটা সে আগেই একঝলক দেখেছিল। এতে বেশ বড় একটা তালা ঝোলানো। এটাতেও তালা? উত্‍পলা তালাটা ধরতেই দেখে ওটা খোলা। এক অজানা কৌতুহল তাকে অস্থির করে তুলেছল,তাই কাঁপা কাঁপা হাতে সটানে সে ফ্রিজের ডালা তুলে ফেলল। বরফ সাদা ঠান্ডা ধোঁয়া, উত্কট মড়া পচা গন্ধ আর নরক সদৃশ দৃশ্য দেখে ওর বমি পেয়ে গেল। বমির বেগ চাপতে পারলো না, ওয়াশ বেসিনে গিয়ে বমি করতে লাগলো। চরম আতঙ্ক ভয় উদ্বেগে ভীষণ অসহায় বোধ হল তার। তবু একটু ধাতস্থ হয়ে মনে জোর এনে আবার সে এক ঝটকায় ফ্রিজের ডালা খুললো। সাদা ধোঁয়া সরতেই দেখলো বরফের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে শুকনো কালো কাঠের মত বাঁকানো একটা পা। বুড়ো আঙুলে একটা মিনে করা সাপের ডিজাইনের আঙঠ। একটা হাতের বাহুতে উল্কি। শিবের ছবি ও লেখা ওম নমঃ শিবায়। উত্‍পলা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আর শি শি করে ফোপাতে ফোপাতে সাহস করে বরফের আস্তরণ সরাতে লাগলো। একটু সরাতেই দেখলো একটা স্তন ও অর্ধেক কাটা মুন্ড। এ যে সেই নারায়ণী! তার যৌবন সন্ধিকালের পরম বন্ধু! তার দু বছরের রুমমেট। হ্যান্ডিক্যাপ্ট। অর্ধেক কোমর অর্ধেক মুন্ড অর্ধেক বুকের খাঁচা। ওকে হত্যা করে এই ফ্রিজে রেখে একটু একটু করে রোজ কেটে বাইরে ফেলে আসে উল্লাস। ওর পরে নিশ্চয়ই আমি? বিকলাঙ্গ ধরে ধরে আনে, ভোগ করে আর মেরে ফেলে। আমিও তো বিকলাঙ্গ। হে ঈশ্বর! উত্পলার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। তার সাথে সঙ্গম মূহুর্তে ওর ওই পৈশাচিক আচরণ কেন তা বুঝে গেল উত্‍পলা।

ফ্রিজটা বন্ধ করে তালাটা যেমন ছিল লটকে দিল সে। বেসিনে আরও জল ঢেলে পরিষ্কার করে মুছে দিল। চারপাশে দেখে নিলো নিজের কিছু চিহ্ন ছেড়েছে কি না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এই ব্যাপারটা তার গোচরে আনার জন্য কি কি ব্যবস্থা করেছেন। মৃত্যু তো তার দোরগোড়ায়। সেই মৃত্যু উল্লাসের হাতেই হোক,কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু মনে তো আক্ষেপ থাকবে না?

উত্‍পলা বাথরুমের দরজায় তালা দেবার সময় খোলার কমবিনেশন নম্বর দেখে নিলো। এক তিন চার। তেরো আর চার। এই নম্বর উল্লাস পছন্দ করেছে কেন? উত্পলার মাথা এখন পুরোপুরি সাফ। তেরো নম্বর হল শয়তানের। মৃত্যু দূতের। আর চীনদেশে চার নম্বর হল স্বয়ং মৃত্যু। সব ভেবেচিন্তে উল্লাস মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিয়েছে। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে উত্‍পলা পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে এল। জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দেখলো ঠিক সময়মতো হায়েনারা লাফাতে লাফাতে আসছে। আজ একটা মিশমিশে কালো লম্বা ছুঁচোলো মুখো কটাশ সঙ্গী হয়েছে।তার মুখে একটা লম্বা সাদা হার। সম্ভবতঃ মানুষের। উত্‍পলা এবার বুঝতে পারে ওরা এই বিল্ডিংএর নিচে কেন আসে।

বিন্দাস উল্লাস

সন্ধেবেলায় উল্লাস এসে দেখে উত্‍পলা নিজের রুমে টেবিলে কাজে ব্যস্ত। উল্লাসকে দেখে ও হাসলো। উল্লাস খুশি। যাক সব ঠিক আছে। ওকে অনেক সুবিধে দেওয়া হয়েছে যাতে ও অনুগত থাকে।থাকা খাওয়ার যাবতীয় খরচ সব উল্লাসের। খাবার বাইরে থেকে প্যাক করে আনা এমনকি টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেওয়া সব কাজ উল্লাস করে। উল্লাস ওর কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। কপাল থেকে চুল সরিয়ে ওকে আদর করলো। উত্‍পলাও তার সঙ্গ দিলো। কিছুটি বলল না, যা করছিল তাতেই সায় দিল সে। রাতে খাবার টেবিলে বসে উত্‍পলা একটু অভিনয় করলো। খেতে বসেই উঠে দাঁড়িয়ে বেসিনে গিয়ে একটু বমি করলো। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে হাফাতে হাফাতে এসে উল্লাসকে বলল আমার খুব খারাপ লাগছে,পেটটা কেমন কেমন করছে। আজ আমি খেতে পারব না, আমি শুতে যাচ্ছি। প্লিজ আজ আমাকে ক্ষমা কর।

উত্‍পলা যেমনটা ভেবেছিল। ওই স্ম্যকের ধোঁয়া আজ কোনোমতেই গিলবে না। অনেক রাত অব্দি ও জেগেই রইল। প্রায় রাত দুটোর সময় শুনতে পেল ওর রুমের দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ করে দিল উল্লাস। বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানোর শব্দ। উত্‍পলা একটু হাসল। উল্লাস নারায়নীর টুকরো নিয়ে বাইরে ফেলতে যাচ্ছে। উত্‍পলা ঘুমিয়ে পড়ল।

এইভাবেই আরো পাঁচদিন গেল। প্রতিদিন উত্‍পলা সুযোগ খোঁজে বাইরে বেরবার কিন্তু পারে না। প্রায় অসম্ভব। এমনি করেই কি তার হাতে জীবনটা যাবে? উত্‍পলা হাসে। এম্নিতেই তো তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। মৃত্যুর জন্য একটা অজুহাত তো চাই। সেটা বুঝি এই?

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।