সাপ্তাহিক গল্প নেই-তে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – ৭

গল্প নেই – ৭

আমার পাশে জায়গা খালি হতেই একজন মহিলা বসলেন। কোলে বসল একটি মেয়ে। এলোমেলো চুল। দু’হাতে চোখ ডলছে। মহিলার চাপা কণ্ঠস্বর, ‘এবার কাঁদলে কিন্তু আস্ত রাখবো না।’
পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক বললেন, ‘ওর আরও মার দরকার। যা দিয়েছ তাতে হয়নি।’
মেয়েটি এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
বাধ্য হলাম কথা বলতে। জানলাম গত তিনদিন জ্বরের জন্য মেয়েটি স্কুলে যেতে পারেনি। আজও সে যেতে চায়নি। একমাস যাবৎ স্কুলে যাবার নামে আতঙ্ক। স্কুলে এইভাবে না গেলে কর্তৃপক্ষকে নানা জবাবদিহি দিতে হবে। তাছাড়া স্কুলে না গেলে কি হবে মেয়েটার! লেখাপড়া হবে না। তাহলে কি চিরকাল মূর্খ হয়ে থাকবে।
মুখ নিচু করে আছে মেয়েটি ডাকলাম। “তোমার নাম কি?’
জিজ্ঞাসা করায় জবাব দিল না। দু’বার।তিনবার। চারবার ডাকার পর বলল, ‘একতা ব্যানার্জি।’
ক্লাস টুয়ে পড়ে।
বললাম, ‘স্কুলে যেতে চাও না কেন? স্কুলে কত রকম মজা।’
‘স্কুলে কোনো মজা নেই। আমি স্কুলে যাব না।’ ওইটুকু ফুটফুটে মেয়েটির মুখে একরাশ অভিমান।
বললাম, ‘এদিকে তাকাও।’ তাকাল। চোখের জলে মাখামাখি হয়ে আছে। বাসের মধ্যে ভ্যাপসা গরমে মাথা ঘামে ভেজা। চুল লেপ্টে আছে কপালে।
বললাম, ‘স্কুলে যাবে না কেন, তোমার পড়তে ভালো লাগে না?’
‘হ্যাঁ।’
‘তবে স্কুলে যেতে চাও না কেন?’
একতা বলল, ‘স্কুলে গেলে আমাকে মেয়েগুলি মারে।’
একতার কথা শুনে মহিলাকে বললাম, ‘আপনারা জানেন?’
‘ হ্যাঁ জানি।’ মহিলা বললেন।
ভদ্রলোক ইতিমধ্যে আমার পিছনের সিটে বসার জায়গা পেয়েছিলেন। বললেন, ‘যদি একটা ভালো সোর্স পেতাম তাহলে মেয়েটাকে অন্য স্কুলে ভর্তি করতাম।’
ভাবলাম এটা নিশ্চয়ই কোনো সমাধান নয়।
নির্দিষ্ট স্টপেজ আসতে একতা ওর বাবা মায়ের সঙ্গে নেমে গেল। নামার আগে ওর বাবা-মা দুজনেই বললেন, আঙ্কেলকে টাটা করে দাও। স্কুলে যাওয়ার আতঙ্কে শিউরে ওঠা একতা আমার দিকে ফিরেও তাকাল না।
স্কুলে যারা একতাকে মারে। যাদের ভয়ে একতা স্কুলে যেতে চায় না তারাও তো সবাই একতারই বয়সের ফুটফুটে ফুলের মতো সব মেয়ে। ওদের এখনও বোঝার ক্ষমতা হয়নি। কাউকে তো দায়িত্ব নিতে হবে বোঝাবার। নিষ্ঠুর মজার মধ্য দিয়ে ওরা কত বড় ক্ষতি করছে।আজ একতার সঙ্গে এমন করছে। কাল হয়ত অন্য কারও সঙ্গে এমন করবে।
মনে মনে ভাবলাম হয়ত আরও একদিন কোনো বাসে দেখা হয়ে যাবে একতার সঙ্গে। স্কুলে যাবার আগ্রহে উজ্জ্বল মুখ। একটু বাদেই দেখা হবে তার বন্ধুদের সঙ্গে। পড়াশোনার ফাঁকে ওদের সঙ্গে গল্প হবে। এই ভাবনায় দু’চোখে খুশি। নির্ভয়ে সবকিছু জয় করে নেবার পদক্ষেপ।
সেদিন বাস থেকে নেমে স্কুলে যাবার সময় একতা নিশ্চয়ই হাত তুলে হাসিমুখে, টাটা আঙ্কেল বলতে ভুলবে না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।