ক্যাফে ধারাবাহিক গল্পে সুবল দত্ত (পর্ব – ২)

হন্যতে

রোজ উত্পলা ভাবে, আচ্ছা ঠিক এই সময়ে কটাশগুলো ছাদের নিচে কেন আসে? ওকে দেখতে? ভেবে পায়না। ওরা কিছুক্ষন থাকে,লাফালাফি করে তারপর ছুটে চলে যায় কাছেই জঙ্গলঘেরা একটা লম্বা বিশাল শিরীষগাছের কাছে। ওখানে অনেকটা জুড়ে ফাঁকা জায়গা। সেখানে প্রচুর গর্ত। সেখানে ঢুকে পড়ে আর মুখ বাড়িয়ে এদিক পানে তাকায়। একটা গর্তে ঢোকে আর অন্য গর্ত দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে উঁকি মারে। উত্‍পলা বেশ কিছুক্ষন ওদের খেলা দেখতে থাকে। একসময় মনে মনে দৌড়ে অনায়াসে শিরীষ গাছে চেপে ওর একটা মোটা ডালে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে ওদের খেলা দেখতে থাকে।

উত্পলার অতীত

এই ট্যারা চোখেই উত্‍পলা একটা মাল্টিন্যাশন্যাল কম্পানিতে কাজ পেয়েছিল।একটা চৌড়া ফ্রেমের সানগ্লাস সবসময় পরে থাকতো অফিসে। কপাল ঢাকা চুল তা সত্ত্বেও মাথায় ওড়না। অবগুণ্ঠিত থেকেও তার মিষ্টি স্বভাব ও টেকনোলজি জ্ঞান সবার মন জয় করে নিয়েছিল। সেখানেই উল্লাসের সাথে ঘনিষ্টতা। ক্যান্টিনে কফি কর্ণারে অনেক কথাই হতো দুজনের। প্রকৃতিকে যে কত ভালোবাসে সেকথা উল্লাস বারবার উত্পলাকে বলত। দু তিনবার জঙ্গল পরিসরের নিকট এই বাড়িতে উত্পলাকে নিয়েও এসেছে। একা পেয়েও সে কোনোরকমের অন্তরঙ্গতার ইঙ্গিত দেয়নি। দূরত্ব বজায় রেখেছে।ছয়মাস পরিচয়ের মধ্যে সে কেবল তার হাত ধরেছিল একবার। তারপর হয়েগেল করোনা মহামারীতে লকডাউন। কম্পানী স্টাফদের বলেদিল যে যার নিজের ঘরে বসে কাজ কর। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। উল্লাসের সাথে কথা হতে হতে উত্‍পলা কেঁদে ফেলেছিল। ঘর? ঘরে ফেরা তো যাবেনা? ঘরের কেউ তো তাকে চায় না। সে যে কূরূপা।বয়েস বেড়েছে। তার বিয়ে হয়নি। পাড়ার লোকে যা তা বলবে ভেবে বাবা মা তার সাথে কোনো সম্পর্কই রাখেনা।

কূরূপা? তোমার এতো সুন্দর ফিজিক। তুমি লম্বা তন্বী,কে বলে এইসব? তুমি তো সুন্দরী? সর্বাঙ্গসুন্দরী। এইকথা বলে এই প্রথম উল্লাস তার কাঁধে হাত রেখে মুখে হাত বোলালো। পার্কের এক কোণায় আলো আঁধারিতে তার রোদ চশমা খুলে চোখ মুছল। উত্‍পলা তার চোখের দিকে তাকাতেই একটু কেশে উঠে চোখ নামিয়ে বলেছিল সে,-ওহ এই ব্যাপার? এইজন্যে তুমি গগলস পরে থাক? তবে শোনো, আজ থেকে আমার কাছে চশমা পর না। পলা তুমি যেমনই থাকো, আমার কাছে তুমি সুন্দরী। আমি যে তোমাকে ভালবাসি পলা। তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে ভাবতেই পারিনা। আই লাভ ইউ পলা।

তারপর উল্লাস কথাটা পেড়েই ফেলল। -আচ্ছা পলা, একটা এডভাইস তোমাকে যদি দিই তুমি রাখবে? এইযে তুমি বলছো তোমার ঘর যাওয়া নেই, আমাকে যদি বিশ্বাস কর যে আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না, তুমি ওয়ার্ক ফ্রম হোম আমার ঘরে থেকে করতে পারো। আর একটা কথা পলা, আমি তোমাকে নিজের জীবন থেকেও ভালবাসি। একটা আমার অতি ইচ্ছার কথা বলি? তোমার সাথে আমি লিভ টুগেদার করতে চাই। তুমি কি রাজি?

উত্পলার রাজি না হওয়ার কোনো পথ নেই। জীবন নৌকো তো আর বাইবার বেশিদিন সময় নেই। পেটের ভিতরে শয়তানটা বাড়ছে। মাঝে মাঝেই উগরে দিচ্ছে রক্তরস। এই ভয়ে চব্বিশ ঘণ্টা ডাইপার পরে থাকতে হয়। তবুও তো শরীরে বসন্তের অনুভব! শরীর তো জানতে চায় কেমন সে মিলন অনুভুতি? পৃথিবী ছেড়ে যাবার আগে এই স্বর্গসুখ কী আমার কপালে জুটবে না? একে তো আমি যমের অরুচি, তারপর এই মৃত্যুর পরওয়ানা। এই আফসোস তার মনের ভিতরে খচখচ করতো। এখন উল্লাস দেবদূত হয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে,আমি কী আর না করতে পারি?

তারপর থেকে উত্‍পলা এখানে। একটা রান্নাঘর আছে,কিন্তু বেশীরভাগ সময় উল্লাস ব্যবহার করে।উল্লাস মাংসাশী, বিফ খেতে পছন্দ করে।উত্‍পলা নিরামিষ। কিন্তু দুজনের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। এখানে আসার তিন সপ্তাহ অব্দি উত্‍পলা নিরাপদ দূরত্ব রেখে বাস করল। উল্লাসের অতি মার্জিত ব্যবহারে উত্‍পলা আরো বেশি আকর্ষিত হলো। আরো বেশি ঘনিষ্ট হতে চাইল। একদিন খুব ঝোড়ো হওয়া, বাইরে কড়কড় করে বিদ্যুত্‍ চমকাচ্ছে খুব কাছে বাজ পড়ছে। ঘর অন্ধকার কারেন্ট অফ। উত্‍পলা বাজ পড়ার শব্দে উল্লাসকে তার ঘরে ডাকলো। উল্লাস এলো তার রুমে। উল্লাস খুব রতিপরায়ণ। ধীরে ধীরে নিপুণ রতিক্রীড়া চলল দীর্ঘ সময় ধরে। সংগমের শেষ মূহুর্তে হঠাত্‍ উল্লাস উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দেখছিল উত্পলার কোমর রক্তে ভিজে গেছে। উত্‍পলা তখন আনন্দে বিহ্বল। চোখ বন্ধ করে ছিল।হঠাত্‍ চোখ খুলে উল্লাসকে দেখে কেমন যেন ভীষণ ভয় হলো। উল্লাসের একহাতে মোবাইল টর্চ অন্য হাতে একমুঠো রক্ত। চোখ টর্চের আলোতে জ্বলজ্বল করছে। চোখে এক পৈশাচিক উন্মাদনা। সেই রক্ত সে সারাগায়ে মাখতে লেগেছিল। তারপর সংগমের শেষ ভাগ।

কিন্তু কেন উল্লাস এমনটা করল? উত্পলার মাথায় সবসময় এই প্রশ্ন জাগে। উল্লাসের সঙ্গম ইচ্ছা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ওর এই ব্লিডিং কেন এই ব্যপারে সে কেন জানতে চায়না? উত্‍পলা একটু মনক্ষুণ্ণ,কিন্তু উত্‍পলা তো এটাই চায়? আর মাত্র তো কটা দিন। তবু কাজে অকাজে উত্পলার চোখের সামনে উল্লাসের রক্তমাখা হাত ও শ্বাপদের মত চোখ ভাসতে থাকে।কেন এমনটা করলো সে?ওই অশুচি রক্ত পাগলের মতো আঁজলায় ভরে সারাগায়ে মাখলো? উত্তর পায়না।

উত্‍পলা দূরে তাকিয়ে থাকে। কটাশগুলো ওই দূরে শিরীষগাছের নিচে চলে গেছে। গাছের নিচে গর্তগুলোয় ঢুকছে আর বেরচ্ছে। হাড়ের মত কিছু মুখে করে বাইরে ফেলছে আবার তুলে নিয়ে গর্তে ঢোকাচ্ছে। ওদের এই খেলা উত্‍পলা অন্যমনস্ক হয়ে কিছুক্ষন দেখে ছাদ থেকে নেমে নিজের রুমে এসে বসে। উল্লাসের আজ আসতে দেরি হচ্ছে।খাবার সময় হয়েছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।