গপ্পসপ্পে সুব্রত চক্রবর্তী 

নদীটি পুষেছি মনে

– দেখতে এলাম কেমন আছিস ? বেশ তো রাজার হালে আছিস দেখছি।
– তুই ! এলি কিভাবে ? একাই !
– একা না তো কি ? হুলো বেড়াল কোথায় পাবো !
– দাঁড়িয়ে কেন ? বোস। কী দেখছিস গোল গোল চোখে ?
– এতো গোছানো ছিলি না তো ! ছিলি তো নেদা মার্কা। অকর্মণ্যের ঢেঁকি। অথচ ঘরদোর বিছানাপত্র সবকিছু টিপটপ। কাজের মেয়েকে চব্বিশ ঘণ্টা রাখিস বুঝি ?
– কে বললো কাজের মেয়ে রেখেছি ?
– তোকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। নদী নারী নীরবতা। এই তিনটে ছাড়া কোন কালে এক পা চলেছিস !
– অবসরে কেউ ফুরিয়ে যায়, কারো বা নব জন্ম হয়। তুই নেই কাজও নেই। তাই খালি ঘর গোছাই।
– জিও সিমটা আমি না হয় রাগে দাঁতে কেটে দু’টুকরো করেছি। তোকেও তাই করতে হলো ?
– কে বলেছে আমিও তাই করেছি ? তোকে দীর্ঘদিন ফোনে না পেয়ে সিমটা খুলে বুকসেল্ফে যত্নে রেখেছিলাম। একদিন লাগিয়ে দেখি ভ্যালিডিটি শেষ।
– তোর কোন কাজের ভ্যালিডিটি থাকে ! অনার্সে থার্ড ইয়ারে টিউশন ফেরা পথে রাস্তায় একা পেয়ে ফুসলিয়ে সিঁদুর পরালি। তারপরই চোঁ চোঁ দৌড়। এক্কেবারে পগার পাড়।
– কি করবো তুই হঠাৎ ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেললি।
– কাঁদবো না তো কি ? মেয়েদের মন বুঝিস ! কোন্ মেয়ে বিয়ের সময় হি হি হাসে শুনি !
– তোর কান্না দেখে ভড়কে গেছলাম।
– ভীতুর ডিম। ভয়েই মরলি। মারলি আমাকেও।
– জল খাবি ?
– ঢং রাখ। জল খেতে আসিনি। সিঁদুর পরালে বউ হয় জানিস ?
– জানি।
– মুন্ডু জানিস। জানলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরতিস না। আরে কলমদানিতে একটাও কলম নেই কেন ? আমার টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা গিফ্টের এই হাল ! নাকি আমার পয়সা খোলামকুচি !
– লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছি।
– সগ্গে বাতি দিয়েছিস ! লজ্জা করে না বলতে ? নিজের ট্যালেন্ট কবে চিনবি ?
– কি লাভ চিনে ? কাকে শোনাবো ?
– লাভ ক্ষতির হিসেব শুনতে আসিনি। দেয়ালকে শোনাবি। কী করিস সারাদিন ? স্কুলে গিয়ে খালি ছেলে ঠ্যাঙানো !
– বলতে পারিস অনেকটা তাই।
– যেন জমিদারি চালাচ্ছিস !
– কী করবো একা একা ?
– দোকা তো হলেই পারিস। কেউ তো মাথার দিব্যি দিয়ে যায়নি।
– তুই নেই। জীবনও থমকে গেছে। মনে পড়ে চাকরি নিয়ে দু’জনে দূরে কোথাও পালাবো বলে আদা জল খেয়ে লেগেছিলাম ?
– পুরোটাই তোর ভন্ডামি। ধরতে পারিনি ভেবেছিস ? তুই বইমুখো হয়ে বসে থাকতিস। আমি তোর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম।
– সেইজন্য তো তোর হলো না।
–  চাকরি পেয়ে ড্যাংড্যাঙিয়ে  শিলিগুড়ি চলে এলি। যেন হাতে চাঁদ পেয়েছিস।
– ওভাবে বলিস না। আসার পরেও তোকে রেগুলার উইশ করিনি ? পড়তে উৎসাহ দিইনি !
– ওইসব পাঁশ পিন্ডি করতে গিয়েই তো বাঁশ দিলি। ঘটা করে লিখতে হলো “তুমি রবে নীরবে হৃদয় মম, নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশিথীনিসম”। ব্যাস ! মা দেখে তেলে বেগুনে। বাবা ফায়ার। ” কি ! বামুন ঘরের মেয়ে হয়ে একটা শুঁড়ির ছেলেকে…”
– তারপর এক মাসে তোর তিনটে বিয়ের প্রস্তাব এলো। তুইও রাজি হয়ে গেলি। ভুলে গেলি স্মৃতির সিঁদুর প্রেম।
– ভুলবো না তো কি ? মা দিনরাত সুইসাইড করতে যায়। বাবা ফোন কেড়ে নিলো। তোর সাথে যোগাযোগ টোট্যাল স্টপ। আমার পাগল হওয়ার জোগাড়।
– যোগাযোগ করতে আমিও চেষ্টার কসুর করিনি। পরে ভাবলাম বিয়ের করে সুখে আছিস।
– সেলফিস্ একটা !
– কে ? তুই ?
– আমি কেন ! বিয়ে করলেই বুঝি সব দরকার ফুরিয়ে যায় !
– আরে কাঁদছিস কেন ! তুই ওখানে ভালো নেই ?
– ওখানটা কোথায় ?
– শ্বশুর বাড়িতে।
– ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছি।
– এটা কিন্তু ভালো করিসনি।
– আমার ভালো মন্দ বোঝার দায় তোকে কে দিয়েছে ? ভালো লাগেনি চলে এসেছি। ব্যাস।
– ভালো না লাগার কি আছে !
– বরটা বর্বর। সারাদিন কাজ নিয়ে থাকে। রাতে নাক ডাকার আগে খালি নিজের কাজের ফিরিস্তি শোনায়। একটা দিনও ভুলেও বলেনি আমি ভালো আবৃত্তি করতে পারি, দারুণ গাইতে পারি। খালি বলে আমি নাকি মুখরা। বকবক করি। আমি নাকি আমড়া কাঠের ঢেঁকি।
– রাখ ওসব কথা। এখানে এলি কিভাবে ! আমার ঠিকানা পেলি কোথায় ?
– যেন পৃথিবীর বাইরে কোন ভিন গ্রহে আছিস ! ভেবেছিলি খুঁজে পাবো না ! আমার হাত থেকে তুই লুকোতে পারবি ?
– মনে হয় দীর্ঘক্ষণ কিছু খাসনি। চোখ মুখ বসে গেছে। ভাত বসাচ্ছি। যা শাওয়ারে স্নান করে আয়।
– শাওয়ার লাগিয়েছিস ! একা থাকিস। এত বাবুগিরি কিসের !
– জানতাম তুই আসবি একদিন। আমি তো নদীতে স্নান করি। বাড়ির দু’পা পিছনেই নদী।
– শাওয়ার জীবন পিছনে ছেড়ে এসেছি। চল আমিও তোর সঙ্গে নদীতে ডুবি।
– যাবি ? বেশ। চল।
– হাঁদারাম ! কথা বলতে আজও শিখলিনা। ‘চল’ নয়, বল ‘আয়’।
– আয়……
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।