রম্য রচনায় সংযুক্তা দত্ত

বাড়িতে ভিতরের ছাদ ছিল মেয়েদের দখলে। পিতলের গামলা ভরা কলাইবাটা নিয়ে টপটপ করে বড়ি দিত তারা, কাঁচা আম ফালি করে কেটে কেটে আমসি শুকোনো হত, নানা আকার আকৃতির কাজ-করা কালো পাথরের ছাঁচে আমের রস থাকে থাকে জমিয়ে তোলা হত, রোদ খাওয়া সর্ষের তেলে মজে উঠত ইঁচড়ের আচার। আবার বাড়িতে নতুন বউ আসার পর ছাদের ওপর আসর বসত দিনের শেষে, রুপোর রেকাবিতে ভিজে রুমালে বেলফুলের মালা, পিরিচে বরফ দেওয়া জলের গ্লাস আর ছাঁচি পান নিয়ে।
সে বাড়িকে লোকে চেনে ঠাকুরবাড়ি বলে। কেবল ধনী বলে নয়, চেনে সংস্কৃতিমনস্ক বলে। কিন্তু বাইরের পালাবদল ঘটতে থাকলেও অন্দরের ব্যবস্থা বদলাতে দেরি হয়। উনিশ শতকের নতুন আলোর দিনেও, আর পাঁচটা বনেদি বাড়ির মতো ‘রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা’-র সাবেকি চাল পালটায়নি সেখানে। মহর্ষিকন্যা সৌদামিনী দেবী ‘পিতৃস্মৃতি’-তে লিখেছেন, ‘রোজ একটা করিয়া টাকা পাইতাম, সেই টাকায় মাছ তরকারি কিনিয়া আমাদিগকে রাঁধিতে হইত।’ ব্যঞ্জনে মিষ্টি দেবার প্রচলন শুরু ঠাকুরবাড়িতেই। এককালের বৈষ্ণব ধর্ম অনুসারী এই বাড়িতে ‘তরকারি বানানো’ হত, ‘কুটনো কোটা’ বললে পাছে হিংস্র মনোভাব জেগে ওঠে!
কিন্তু বদল ঘটেছিল এক জায়গায়। একান্নবর্তী পরিবারের রান্নার গতানুগতিকতার সঙ্গে এখানে মিশেছিল ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব সৌন্দর্যবোধ।
আর ছিল নানারকমের পরীক্ষানিরীক্ষা,
রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথের মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী প্রায় গবেষণাই করেছেন এই বিষয়ে।
পিছিয়ে ছিলেন না ছেলেরাও। ঘিয়ে ভাজা লুচিতে হাত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ দাবি করেছিলেন জল দিয়ে লুচি ভেজে দিতে হবে তাঁকে। কম যেতেন না রবীন্দ্রনাথও। নবনীতা দেবসেনের স্মৃতিচারণে পাওয়া যাবে তাঁর পোলাও বানানোর সহজ ফর্মুলা। ছোটবেলায় উত্তরায়ণে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে ছোট্ট নবনীতা বলে উঠেছিলেন, এ কেমন নেমন্তন্ন! পোলাও নেই! অমনি পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে হুকুম জারি করেন কবি, তক্ষুনি পোলাও রান্নার। সাদা ভাতের সঙ্গে কমলালেবুর কোয়া আর মশলাপাতি মিশিয়ে পোলাও রান্নার রেসিপিও বাতলে দিয়েছিলেন তিনিই।
রান্নার মতো অবহেলিত বিষয়েও যেমন উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়েছিল ঠাকুরবাড়ি, তেমনই সেই নতুনত্বকে ধরে রাখার প্রয়োজনও বোধ করেছিল। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর তিন খণ্ডে লেখা ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’-এ কেবল নতুন পুরোনো রান্নার রেসিপি-ই ছিল না, বইয়ের প্রথমে ছিল হাইজিন ও হোম সায়েন্সের পাঠ আর শেষে ছিল রান্নাঘরে ব্যবহৃত শব্দের পরিভাষা। বাংলার ভোজসভায় মেনুকার্ডকে হাজির করেছিলেন তিনিই। নাম দিয়েছিলেন ‘ক্রমণী’। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী নিজে রন্ধনপটিয়সী না হলেও ভালো খাবারের রেসিপি লিখে রাখতেন। তাঁর সংগৃহীত রেসিপির সঙ্গে মা নলিনী দেবীর রেসিপি মিলিয়ে পূর্ণিমা ঠাকুর একটি কুকবুক লিখেছিলেন ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ নামে।
এই রবিমাসে আমার রান্না ঘরে ঠাকুরবাড়ির রান্না
‘ মুরগির রসল্লা’
এই লেখার কিছুটা সংগৃহীত, কিছুটা নিজের এলোমেলো কথা।
পূর্ণিমা দেবীর লেখা, এই রেসিপি টি “ঠাকুরবাড়ি রান্না বান্না” বই থেকে নেওয়া হয়েছে। ঠাকুরবাড়ির রান্নাঘরের রন্ধনসম্পর্কীয় উৎকর্ষের উত্তরাধিকারের মধ্যে, “মুরগির রসোল্লা” একটি অনন্য এবং সম্মানিত অবস্থান দখল করে আছে। এই থালাটিকে যা আলাদা করে তা হল এর অসাধারণ স্বাদ, কোন মশলা ব্যবহার ছাড়াই অর্জন করা হয়।
উপকরণ-
মুরগী – এক কিলো , দৈ- পাঁচশো গ্রাম, পেয়াজ- পাঁচশো গ্রাম , লংকা- বারো থেকে তেরোটা, রসুন কোয়া – নয় থেকে দশটা ঘি – একশো গ্রাম, তেজপাতা – চারটি, নুন – স্বাদমতো ।
প্রনালী – চিকেন মেরিনেট করতে হবে দৈ, রসুন ও লংকা বাটা, পেয়াজ কুচি আর নুন দিয়ে ।
এরপর হাঁড়ীতে ঘি গরম করতে হবে । তেজপাতা আর কাঁচা লংকা ফোড়ন দিয়ে মেরিনেটেড চিকেন দিতে হবে । ঢাকা না দিয়ে মাঝারি আঁচে কষতে হবে । মাংস সেদ্ধ হয়ে গেলে গ্যাস অফ করে চাপা দিয়ে রেখে দিতে হবে । ভাত,রুটি দুইয়ের সাথেই চলবে ।