কর্ণফুলির গল্প বলায় সৌমেন দেবনাথ

প্রিয়স্মিতা
তার সৌন্দর্যে বিভোর মন, থাকতে পারে না স্বাভাবিক অনুরাজ। জ্ঞান লোপ পেয়েছে একবার দেখেই। লাস্যময়ীর হাসির ঝলকে হারিয়ে ফেলেছে দিক। রূপের দ্যুতিতে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে। রূপের ঔজ্জ্বল্যে ঝলসে যায় সে, হৃদয়ের রানি হয়ে উঠেছে এই প্রথম দেখা থেকেই। তুলনাহীনা, অপরূপা ও সৌন্দর্যময়তায় ভরপুর মেয়েটির প্রেমমগ্ন অনুরাজ কামজ আলিঙ্গনকাতর হয়ে উঠে। প্রেম, আনন্দ, আবেগ এবং সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির সাথে তুলনা করে তাকে। রূপ-লাবণ্যে ভরপুর ড্রিমগার্লের রূপের রহস্য তার অজানা। সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে সৌন্দর্য উপহার দিতে কার্পণ্য করেনি।
বান্ধবীরা তার নাম ধরে ডাকাডাকি করে, প্রিয়স্মিতা নাম তার। ঠোঁট পাউট করে ছবি তুলতে ব্যস্ত সে। নিখুঁত পাউটের অধিকারিণী প্রিয়স্মিতা। গোলাকার আদর্শ ঠোঁট। অনুরাজের মন শুধু বলে, তুমি সত্যিই অনন্যা, প্রিয়স্মিতা। তুমি এক সুন্দরী প্রতিমা, সুন্দরী শ্রেষ্ঠা।
বিশেষ মুখভঙ্গি করে ছবি তোলার দৃশ্য অনুরাজের মন কেড়ে নিলো। ওদের এক বন্ধু উচ্চস্বরে বলে, ছুঁচোমুখ করে আর ছবি তুলিসনে।
ছুঁচোমুখ শব্দটা কানে আসতেই অনুরাজ রেগে গেলো। প্রিয় মানুষকে কেউ বাজে শব্দ শোনালে রাগ জাগা স্বাভাবিক। সূচালো মুখভঙ্গি চুম্বনের মহড়া। প্রিয় মানুষের সূচালো চঞ্চু থেকে প্রেমদাগ নেওয়া তার এখন শ্রেষ্ঠ স্বপ্ন।
স্বর্ণকেশী এই সৌন্দর্যের রানি তার হাসির ঝলকানিতে, অপার সৌন্দর্যের মুগ্ধতায়, সুমিষ্ট কণ্ঠের আবেশে, তীক্ষ্ণ চাহনিতে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে বন্ধুবলয়কে। রূপের বিপুল খ্যাতি, রূপধন্যার বিপুল খ্যাতি। বন্ধুবলয় থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন না করতে পারলে চরম অসন্তোষ থাকবে অনুরাজের মনে। শুধুই ভাবে সে, প্লাটিনামের সোনালি আভার স্বর্ণালী চুলই তাকে অন্যদের থেকে দৃষ্টিনন্দন করেছে।
একমাত্র ছেলে বন্ধুটির কাছ থেকে একটি আপেল কেড়ে কামড় বসালো প্রিয়স্মিতা। আর সেই কামড় দেওয়ার দৃশ্যটি ক্ষত-বিক্ষত করে দিলো অনুরাজের হৃদয়কে। ওষ্ঠে ওষ্ঠরঞ্জনী। নজরকাড়া সুন্দর ঠোঁটের আকর্ষণীয় অভিব্যক্তি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে তার মন। বন্ধুটির দিকে চেয়ে অকারণ হাসে। বাঁকা ঠোঁটের বাঁকা হাসি যেন ভুবন ভুলানো। ভুবন ভুলানো হাসি দেখে অস্থির না হয়ে থাকা যায় না। হরিণী শিকার করতে বাঘ নির্দিষ্ট হরিণীকেই টার্গেট করে। অনুরাজ প্রিয়স্মিতার ছেলে বন্ধুটিকে টার্গেট করলো।
ছেলেটির নাম দীপ্তেন্দু। সে এসেছিলো সিগারেট নিতে। অনুরাজ তার থেকে জেনেছে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এদিকে এসেছে আড্ডা দিতে। আরও কিছু প্রশ্ন করতেই দীপ্তেন্দু উত্তর দিতে অনাগ্রহ দেখালো। দুই প্যাকেট সিগারেটের প্রলোভন দেখাতেই রাজি রাজি অভিব্যক্তি মুখমণ্ডলে ভাসলো। দীপ্তেন্দুর অবন্ধুসুলভ ভূমিকাতে প্রিয়স্মিতা সম্বন্ধে বিস্তারিত জানলো অনুরাজ। দীপ্তেন্দু অনুরাজের বাসার ঠিকানা নিলো, উপশহরে বাসা। কারণ অনুরাজ তাকে ভালো টিউশনির ব্যবস্থা করে দেবে।
অনুরাজের শ্রেষ্ঠ অনুষঙ্গ প্রিয়স্মিতা। প্রিয়স্মিতা বন্ধুবৎসল। অনুরাজের সান্নিধ্য তাকে আনন্দিত করে। তার বিভিন্ন শখ অনুরাজ পূরণ করে। অনুরাজের কথা তার বেশি ভালো লাগে। অনুরাজ প্রিয়স্মিতার দিকে তাকায়। আর বলে, সৌন্দর্য মানেই তুমি, তোমাতে সৌন্দর্য নেয় বিশ্রাম। অমর দেবীর অবিকল প্রতিমূর্তি তুমি, সৌন্দর্য ও ঔজ্জ্বল্যের প্রতীক তুমি।
কথা শুনে হাসে প্রিয়স্মিতা। হাসিতে মোহাবিষ্ট অনুরাজ। বলে, তুমি সৌন্দর্যের দেবী, আমার মনের রানি।
আবার হাসে প্রিয়স্মিতা। অনুরাজ বলে, বিধাতার বিশেষ সৃষ্টি তুমি, সোনালি আভার মায়া সর্বাঙ্গে, যত দেখি তোমায়, ততই মুগ্ধ হই; ঘায়েল আমি। বলো আমায় অসাধারণ রূপের গোপন রহস্য কী!
দিনান্তে বাসায় ফেরে অনুরাজ। পড়াশোনা শেষ তার। চাকরি খোঁজার নাম-গন্ধ নেই। তার মা পুষ্পোক্ষি বলেন, সুন্দরী দেখে বৌমা আনবো ঘরে।
শুনে অনুরাজের বাবা ঘনানন্দ বলেন, শুধু কেতাবী নয়, পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক জ্ঞান আছে এমন মেয়েকে বৌমা করে আনবো।
পুষ্পোক্ষি বলেন, সৌন্দর্যও একটা গুণ, সৌন্দর্যও একটা যোগ্যতা। বৌমা হবে রূপবতী। বৌমা হবে সৌন্দর্যের প্রতিমা। সৌন্দর্যময়ী।
ঘনানন্দ বলেন, যে নিজেকে ভালোবাসতে জানে, অন্যকে ভালোবাসতে জানে সেই সৌন্দর্যময়ী। যার জ্ঞান সুতীক্ষ্ম ভোজালির মতো সুতীব্র সেই সৌন্দর্যময়ী।
পুষ্পোক্ষি বলেন, রাখো তোমার ভাঁড়ামি। বৌমার পটোল চেরা চোখ, দীঘল কালো চুল থাকতে হবে।
ঘনানন্দ বলেন, পটোল চেরা চোখ, দীঘল কালো চুল কখনোই সৌন্দর্যের মাপকাঠি হতে পারে না।
মায়ের কথায় মন ভালো হয় তো বাবার কথায় মন খারাপ হয়ে যায় অনুরাজের। বাবা-মায়ের মতোদ্বন্দ্বে প্রিয়স্মিতার কথা বলতেই পারলো না সে।
উপশহর থেকে ক্যাম্পাসে আসতে বেশি সময় লাগে না অনুরাজের। প্রিয়স্মিতা ক্লাস বাদ দিয়ে অনুরাজের সাথে দেখা করে। সেজে এসেছে প্রিয়স্মিতা, নানা অনুষঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছে নিজের রূপকে আরও কমনীয় করে। প্রিয়স্মিতাকে দেখতেই অনুরাজ বলো, বাস্তবেই অপ্সরা তুমি।
একগাল হেসে নিয়ে প্রিয়স্মিতা বলে, চলো আজ পার্লারে যাবো। আরও একটু সাজবো। তারপর তোমার সাথে ঘুরবো।
প্রিয়স্মিতার কথাতে রাজি হয়ে পার্লারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ওরা। যেতে যেতে অনুরাজ বলে, জীবনে সকল সময়ের স্বপ্ন, অহোরাত্রির আনন্দ ও জীবনভর প্রশান্তির ছোঁয়া তুমি।
হাসে প্রিয়স্মিতা। হাসির মাধুর্য আকৃষ্ট করে অনুরাজকে। রোদের মতো উজ্জ্বল হাসি মনকে আলোকিত করে। অনুরাজ বলে, তুমি যতবার হাসো ঢেউ ততবার খেলে।
প্রিয়স্মিতা হাসি বন্ধ করে বলে, পার্লার থেকে সেজে শাহেববাজার যাবো। দুটো শাড়ি কিনে দেবে, দুটো না একটা। তবে একটু দামি দেখে। ক্লাস পার্টিতে পরবো।
প্রিয়স্মিতার আবদার রাখা আবশ্যিক কর্তব্য ভেবে নিয়েছে অনুরাজ। মিষ্টি একজন মেয়ের মন খারাপ হলে সে সহ্য করতে পারবে না। নিষ্পলকে প্রিয়স্মিতার দিকে তাকায়। প্রিয়স্মিতা অপূর্ব মুখভঙ্গি করে বলে, কী!
অনুরাজ বলে, আমার দেখা শ্রেষ্ঠ দৃশ্য, তোমার মুখ।
প্রিয়স্মিতা হেসে বলে, অনেক বেশি বলো।
অনুরাজ বলে, তোমার রূপের প্রশংসা করার জন্য কোনো শব্দই যথেষ্ট নয়, প্রিয়স্মিতা।
দিন শেষে বাসায় ফেরে অনুরাজ। তার মা একজন রূপবতী মেয়ের সন্ধান পেয়েছেন। ঘনানন্দ সে কারণে চটে আছেন, বলছেন, বলেছি তো রূপ থাকলে হবে না, মেয়ের গুণও থাকতে হবে। গুণ না থাকলে তোমার ছেলের জীবন, আমাদের সম্পদ নষ্ট করে ছাড়বে।
পুষ্পোক্ষি বলেন, গায়ের ধবধবে সাদা রং, টানা টানা চোখ, জোড়া ভ্রূ আর খাড়া নাক; যথেষ্ঠ।
অনুরাজ ক্ষুব্ধ, তাকে না জানিয়ে মেয়ে দেখেছেন তাই। মায়ের পক্ষ ছেড়ে বাবার পক্ষে কথা বলতে শুরু করলো আজ, বললো, গায়ের রং ফরসা হলে তাকে বিবাহ করবো না আমি।
ঘনানন্দ বললেন, আত্মোন্নতি না করে পার্লারে সাজগোজ করা মেয়ে দিয়ে সংসারের উন্নতি হবে না। পড়াশোনায় অবহেলা করা মেয়ে, তিন সাঝে তিন শাড়ি পরা মেয়ে দিয়ে অগ্রসর হওয়া যাবে না। মুখের জেল্লাবৃদ্ধি করা মেয়ের চেয়ে অন্তরের জেল্লাবৃদ্ধি করা মেয়ে সংসারের জন্য উত্তম। সাজগোজে উজ্জ্বলতা বাড়ে, ব্যক্তিত্ব বাড়ে না। কষ্টে সম্পদ করেছি, কষ্ট জানা মেয়েকেই ঘরে আনবো।
বাবার কথা ভালো লাগলো না, মায়ের মেয়ে পছন্দ করা ভালো লাগলো না। পরেরদিন প্রিয়স্মিতার সাথে দেখা করতে গেলো। তাকে দেখলে চিন্তা শেষ হয়, দুঃখ শেষ হয়, লাগে আনন্দ। তার স্নিগ্ধ রূপে প্রশান্তি পায় সে। তার দেহভঙ্গী, তার দেহবল্লরী, তার বাচনভঙ্গি সে উপভোগ করে। তার বর্ণ ও লাবণ্য কল্পনাকে হারা মানায়। তার দেহমন্দিরের নিমগ্ন পূজারী সে। মিষ্টি হাওয়া এলো, অনুরাজ বুঝলো প্রিয়স্মিতা কাছাকাছি। চোখ তুলে দেখে, সত্যই সর্বাঙ্গসুন্দরী প্রিয়স্মিতা। দেখতেই অনুরাজ বললো, সৌন্দর্য বর্ণনায় তাজা প্রস্ফূটিত গোলাপের উপমা তুমি, তাজা গোলাপ দেখার মতো রূপময় অনুভূতি আর নেই।
এক চিলতে হেসে নিয়ে প্রিয়স্মিতা বলে, আমার রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা দেখিনি তোমার। দেখিনি বর্ণনায় কৃপণতা।
অনুরাজ কামার্ত চোখে চেয়ে বলে, প্রেমময়ী প্রিয়স্মিতা, তুমি অনন্য, অনন্য তোমার বক্ষশোভা।
একথা শুনে প্রিয়স্মিতা আদুরে আঘাত করে অনুরাজের, আর ততোধিক আদুরে কণ্ঠে বলে, দেখো না, আমার হ্যান্ডসেটটা অনেক পুরনো, দেবে আমায় একটা সুন্দর সেট কিনে!
প্রিয়স্মিতার আবদারভরা মুখটা অনুরাজের খুব ভালো লাগে। বলে, চিরদিনই আমার তুমি, চিরযৌবনা তুমি, চিরকাব্যময় তুমি, হৃদয়ের তুমি, প্রাণের তুমি ও স্বপ্নের তুমি, এক কথায় ভালোবাসার তুমি।
এরপর ওরা হ্যান্ডসেট কেনার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। রিক্সা চড়ে যেতে যেতে অনুরাজ বলে, তুমি ফুল ও ফুলের রানি, ফুল প্রশংসার যোগ্য।
প্রিয়স্মিতা বলে, অত প্রশংসা করতে হয় না।
অনুরাজ বলে, তোমাকে পেয়েছি আর তাই সৌন্দর্য কী খুঁজি না। পদ্মাবতী, শকুন্তলা, বেহুলা, তিলোত্তমা, বিদ্যাসুন্দরীর সৌন্দর্য আমার কাছে অত্যন্ত মামুলি।
এক পশলা হাসির বৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় প্রিয়স্মিতা। তারপর বলে, তুমি যা বলো হয়ে পড়ি বাক্যহীন।
অনুরাজ বলে, তোমার দেহের বন্দরে ভিড়িয়েছো আমার সব কল্পনার তরি।
মিটিমিটি হাসে প্রিয়স্মিতা। অনুরাজ আবার বলে, তোমায় বর্ণনা করতে গেলে শব্দরা হারিয়ে যায়। তোমার সৌন্দর্যে একটা আভিজাত্য আছে। প্রকৃতির বর্ণিল রূপের মতো সুন্দর তুমি।
প্রিয়স্মিতাকে হ্যান্ডসেট কিনে দিয়ে বাসায় এলো অনুরাজ। বাসায় এলেই ভালো লাগে না তার। মায়ের পীড়াপীড়ি প্রচণ্ড পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে ইদানীং। ঘুরে-ফিরে মায়ের একই কথা। বলেন, একদম ফরসা, টানা চোখ, লম্বা চুল, মেদহীন, চিকন এবং উন্নত কপোলের অধিকারিণী। নাক টিকোলো, ঠোঁটের গঠন পাতলা। সুন্দরের সংগা ঐ মেয়েটির কাছে গিয়েই শেষ। আর তোর সাথে মানানসই হবে।
অনুরাজের উত্তর না দিতে দিয়ে ঘনানন্দ বলেন, যার বুদ্ধিমত্তা অনন্য সেই সুন্দর। নারীর সৌন্দর্য মূলত তার সত্তায়। গায়ের রঙ, শারীরিক গঠন মনের কলুষতা ঢাকতে পারে না। এতদিন যা দেখেছো, দেখেছো; এবার মন দেখো।
অনুরাজ বলে ফেললো, সৌন্দর্যই অস্তিত্বের আসল সার্থকতা বলে স্বীকৃত।
ঘনানন্দ বলেন, ভুল। যার ভেতর সহানুভূতি বেশি সেই সুন্দর, সেই সৌন্দর্যময়ী। যার ব্যক্তিত্ব মনোমুগ্ধকর সেই সুন্দর, সেই সৌন্দর্যময়ী। যার উপস্থিতিতে সবাই সন্তুষ্ট সেই সুন্দর, সেই সৌন্দর্যময়ী। যার সৌজন্যতা নজর কাড়ে সেই সুন্দর, সেই সৌন্দর্যময়ী। যার লোভ কম সেই সুন্দর। যে কেবল উপহার পেতে আকুল তার ভেতর স্বার্থ কাজ করে। তার সৌন্দর্য আপাতত সৌন্দর্য মনে হবে, তার থেকে ঠকার সম্ভাবনা প্রবল।
অনুরাজ নিজের ঘরে গেলো। তারপর প্রিয়স্মিতাকে ফোন দিলো। নতুন ফোন পেয়ে যারপরনাই খুশি প্রিয়স্মিতা। ভিডিও ফোনে কথা বলতে থাকলো ওরা। অনুরাজ বললো, তোমার চোখের পাশাপাশি টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো লাল ঠোঁট দুটিও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়। একেবারে অনন্য।
একটু হেসে প্রিয়স্মিতা বলে, আমাকে দেখে কি তোমার তৃপ্তি নেই?
অনুরাজ বলে, তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার কোনো ক্লান্তি নেই।
আবার একটু হাসে প্রিয়স্মিতা, তারপর বলে, যারা মেয়েদের প্রশংসা করতে পারেন না তারা কখনো মেয়ে পটাতে পারে না। তোমার এই মেয়ে পটানোর গুণটা অত্যন্ত বেশি।
অনুরাজ বলে, তুমি যা আমি তোমাকে তাই-ই বলি। তোমার কথা বলার ভঙ্গি মনোরম। তোমার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি মন ছুঁয়ে যায়। গাল যেন গোলাপের পাপড়ি। অপরূপা ও তুলনাহীনা, কামার্তের অন্ধকারের আকাঙ্ক্ষা। তুমি আমার কামসঙ্গিনী কিংবা স্পর্শসঙ্গিনী।
প্রিয়স্মিতা বলে, তুমি কিন্তু আমার দেহশ্রীতে সৌন্দর্য খোঁজো। দেহশ্রীতে অতুল সৌন্দর্য খোঁজা কিন্তু ঠিক নয়।
একটু থমকে গেলো অনুরাজ। ভাবলো হয়তো সে রাগ করেছে। তাই বলে, তুমি কি রূপজ ও কামজ রহস্য-মহিমা, নন্দন-প্রতিমা নও!
প্রিয়স্মিতা বলে, নারী মানুষ নয়, সুন্দর পুতুল? দেহমুগ্ধ তুমি, মনমুগ্ধ তো দেখিনি কখনো!
প্রিয়স্মিতা ফোন রেখে দিলো। অনুরাজ বিভ্রান্ত হলো প্রিয়স্মিতার আজকের হঠাৎ রেগে যাওয়াতে। আবার ফোন দিলো, প্রিয়স্মিতা ফোন ধরে বললো, সৌন্দর্য মানেই পরিচ্ছন্নতা, সেটা হোক শরীরের বা মনের। তুমি শরীরের সৌন্দর্য খুঁজেছো, পরিচ্ছন্নতা খোঁজোনি; আর মনের সৌন্দর্য তো খুঁজতেই চাওনি।
প্রিয়স্মিতার আজকের কথার সাথে তার বাবার কথার অনেক মিল পেলো। প্রিয়স্মিতাকে তাই আরও নতুন ভাবে আবিষ্কার করার সুয়োগ হলো।
সকাল হতেই ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো অনুরাজ, কারণ রাগ করেছে প্রিয়স্মিতা। সুন্দর মানুষটার সুন্দর মনের ঠিকানা উন্মুক্ত হলে আরও ভালোবাসা জন্মে। মায়ায় ভরা চেহারার মানুষটিকে দেখলে মনে প্রশান্তি আসে। প্রিয়স্মিতার মুখে হাসি আনা এখন তার মূল কাজ। তাই বললো, আমার হৃদয়ের পরতে পরতে, কবিতা-ছড়ার ছন্দে ছন্দে, উপমায় ও কাব্য অলংকারে শুধুই তুমি।
আজ প্রিয়স্মিতা হাসলো না। অনুরাজ আবার বললো,
তুমি আমার ভীষণ পছন্দের, আনন্দের আর আগ্রহের।
প্রিয়স্মিতা মুখ খোলে, শোনো, নারীর যেসব বন্দনা ও গুণকীর্তন রয়েছে তা মূলত তার দৈহিক সৌন্দর্যের। যা আমি নিন্দা করি। সৌন্দর্যের বাস মননে। শারীরিক সৌন্দর্যে প্রশান্তির অনাবিল ছোঁয়া মেলে না। জীবনের উত্তাল ফেনায়িত হতাশায় একজন প্রিয় মানুষের মমতামাখা হাতই যথেষ্ট। তোমার সৌন্দর্যের রূপময় বর্ণনায় আমি কখনোই মুগ্ধ হইনি। আমি মুগ্ধ হই তুমি আমাকে সময় দাও, আর অশ্রদ্ধা করোনি কোনোদিন তাই। সমাজে বাহ্যিক বা শারীরিক সৌন্দর্যই নারীর গ্রহণযোগ্যতার মুখ্য মাপকাঠি, আর সব গুণই গৌণ? বিকৃত বাসনা ও লালসা বাদ দাও। আমাকে তোমার গ্রহণযোগ্যতার প্রধান উপাদান শারীরিক সৌন্দর্য ও যৌন আবেদন যদি হয় তবে আজ থেকে আমাকে বাদ দাও। দৈহিক সৌন্দর্যই পুরুষের রোমান্টিক প্রেম জাগিয়ে তোলার প্রধান উদ্দীপকই বা হবে কেন, বুঝি না।
অনুরাজ কিছুটা নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য সময় নিলো। তারপর ভাবলো, তার বাবার পছন্দের সাথে হুবুহু মিলে যায় প্রিয়স্মিতার চিন্তা-ভাবনা। কিন্তু কোনোভাবেই প্রিয়স্মিতার রাগ পড়ছে না। তাই অনুরাজ বললো, চলো আরডিএ মার্কেটে, তোমাকে একটা স্বর্ণের ব্রেসলেট গড়ে দেবো।
প্রিয়স্মিতা তা শুনে বললো, তোমার কাছ থেকে এটা ওটা চেয়ে নেয় একান্ত ভালোবাসার আবদারে। তুমি মন খারাপকে যদি অর্থ দিয়ে ঢাকতে চাও ভুল করবে। অঢেল ঢেলে আন্দোলিত করতে পারবে না আমায়। শোভা, লাবণ্য, মাধুর্য গহনায় বাড়ে না। শোভা ও সৌন্দর্য বাড়ে সুস্থ চিন্তায়।
রমণী রহস্যমধুরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলো অনুরাজ। তবে তার ভেতর আজ অন্য ভালো লাগা কাজ করতে থাকলো। সুন্দর মনের মানুষের ঠিকানা এতদিনে সে পেয়েছে। প্রচণ্ড রাগ জাগলেও প্রিয়স্মিতা অনুরাজের হাতটি ধরে হাঁটতে লাগলো।
আজ বাসায় ফিরে বাবা-মাকে নিজের পছন্দের কথা জানাবে বলে মনস্থির করলো অনুরাজ। মাকে বললো, মাগো, প্রিয়স্মিতা আমার বন্ধু। প্রিয়স্মিতাকান্তির মাধুর্যে মুগ্ধ আমি, তুমিও মুগ্ধ হবে। প্রিয়স্মিতা অফুরান এক সৌন্দর্যের ভুবন। মুখের আদল নান্দনিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্যে মোড়া। রূপজ সৌন্দর্যে বিভোর হবে। অপরূপ রূপের রানি, অনন্ত মাধুরীময়, অপরূপা সে। বর্ণনায় তুলে ধরা দায়।
রূপের বর্ণনা সহ্য করতে পারেন না ঘনানন্দ। আর সেই রূপের বন্দনা শুনতে পেয়ে বললেন, কাচ-কাঞ্চন চেনো না তুমি। নজরকাড়া সৌন্দর্য দেখে তুমি ভুলে যাচ্ছো বাস্তবতা। রূপ অপেক্ষা আমার কাছে গুণের কদর বেশি।
অনুরাজ প্রতিউত্তরে জানালো, প্রিয়স্মিতা গুণে গুণান্বিতা। বাইরে কিছুটা এলোমেলো, কিন্তু মনের দিকে অনেকটা গোছানো প্রকৃতির। স্পষ্টভাষিনী, আত্মবিশ্বাসিনী, সৎসাহসিনী, সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে অভ্যস্ত। মাধুর্যমণ্ডিত বাচনভঙ্গি; কথাবার্তার ধরন, দায়িত্বশীলতা, সমাজ ও বিশ্বকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানুষের প্রতি তার সম্মানবোধ বিবেচনা করার মতো। একটু সাজপ্রিয়, তবে তার মনের সৌন্দর্য অত্যন্ত সুন্দর। আকর্ষণীয়া সে এই অর্থে, সে রুচিশীল পোশাক পরে, তার মার্জিত আচরণ। গান-কবিতা পছন্দ করে, নিত্য-নতুন বিষয়ে জানা ও শেখার প্রবল নেশা আছে। লেখালেখি করে, লেখালেখির বিষয় সস্তা প্রেম নয়; রাজনীতি, সমাজনীতি, বিশ্বসমস্যা। মুখে র্যাশ উঠা নিয়ে সে বিচলিত নয়, বিচলিত নয় চুল পড়া নিয়ে; স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করে প্রতিকূলতাকে। তার সৌন্দর্য তার বিনয়ী ভাব, তার নম্রতা, তার সহনশীলতা। তার যোগ্যতা তার সৌন্দর্য নয়, তার শিক্ষা; সুশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত, সে মেধাবী। অভিভূত হবে তার জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তায়।
অনুরাজের কণ্ঠে প্রিয়স্মিতার রূপ ও গুণের বর্ণনা শুনে তাকে দেখার প্রবল ইচ্ছা জাগলো ঘনানন্দ ও পুষ্পোক্ষির। তাঁরা প্রিয়স্মিতাকে দেখবেন বলে পরেরদিনটিকেই নির্ধারণ করলেন।