কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া

আব্বা

এক দরিদ্র আর নিরক্ষর বর্গাচাষি ছিলেন আমার আব্বা৷ কিন্ত প্রচন্ড এবং আত্মবিশ্বাসী মানুষ ছিলেন তিনি৷ স্বপ্ন দেখতেন দিন বদলের৷ তাই শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও তিনি মাথা উচু করে চলতেন৷ নিজের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে রাখতো৷ এলাকায় তার এই একাগ্রতার কদর তৈরি করেছিলো৷ যার ফলশ্রুতিতে নিরক্ষর হবার পরও সমাজের নেতৃত্ব তিনি সুকৌশলে করায়ত্ব করেছেন৷
আমরা অনেক ক’জন ভাই-বোন৷ সে সময়তো পরিবার পরিকল্পনার বালাই ছিলোনা৷ তাই এখনকার মতো দুই সন্তানের পরিবর্তে পাঁচ-সাতজন সন্তানে ঠাশা পরিবার৷ আমরা চার ভাই, তিন বোন৷ সাত ভাই বোন৷ আব্বা তার সামান্য রোজগার দিয়ে আমাদের সকলকে উচ্চ শিক্ষিত করেছেন৷ অবশ্য এটাও ঠিক আমরা সব ভাই বোনই স্কলারশীপে টাকা আর টিউশনি করে পড়ার খরচ চালিয়েছি৷ এতে পরিবারের আর্থিক চাপটা লাঘব হয়েছে৷ একটা জিনিষ অদ্ভুত৷ আব্বা-মা নিরক্ষর হলেও আমরা জন্মসূত্রে সকলে প্রচন্ড মেধাবী৷ শিক্ষাজীবনে সবাই বোর্ড স্টান্ড করা স্টুডেন্ট৷ এমনকি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্টগুলোও অত্যন্ত ভালো৷ অনেকে মজা করে বলতো “বোর্ড স্টান্ড ফ্যামিলি”৷ যার ফলে আব্বার সুপরিচিতি আর নেতৃত্বের পরিধি কমিউনিটি লেবেল থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে৷
বর্তমানে আমরা সকলেই বিসিএস ক্যাডার৷ কেউ ডাক্তার, আর্মি অফিসার, পুলিশ অফিসার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, উপ সচিব এবং রেলের কর্মকর্তা৷
সন্তানদের এই সাফল্য আর ক্ষমতা কেন যেন আমাদের সাদাসিধে ও সংগ্রামী আব্বাকে হিংস্র করে তুললো৷ তিনি তার অতীত জীবনের ক্ষোভ আর অবহেলার প্রতিশোধ নেয়া শুরু করলো৷ ধীরে ধীরে আব্বার নেতৃত্বের পরিধি সুসংহত হলেও হারিয়ে ফেললেন মানুষের স্বতস্ফুর্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা৷ এখন মানুষ ভয়ে থাকেন কখন তার হেনস্থার শিকার হয়৷ তাই সমঝে চলেন৷ বিরুদ্ধাচারণ গোপনে চললেও কেউ মুখ খুলেননা ভয়ে৷
আব্বার এখন অনেক বয়স৷ আগের মতো তার বডি পারমিট করেনা৷ আমরা তাকে অবসর জীবন কাটাতে বলি৷ প্রত্যেক সন্তানদের বাড়িতে বেড়িয়ে আসতে বলি৷ এতে ওয়েদার চেঞ্জের পাশাপাশি বিনোদন হবে৷ কিন্ত তিনি সায় দেননা৷ তার এক কথা যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে যাবো৷
গ্রামের খড়ের ছাউনীওয়ালা বাড়িটা ভেঙ্গে নির্মিত হয়েছে এক প্রাসাদোপম ভবন৷ যার সামনের লনে তৈরি হয়েছে ইট সিমেন্টের এক সামন্তবাদী রাজার দরবার৷ এখানে আব্বার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত৷ একদিন আব্বার উপর জুলুম দেখে যারা তাকে সাহার্যের হাত বাড়িয়েছিলো৷ আজ তারাই শিকার৷ এমন আচরণে মানুষের ক্রোধ আর ক্ষোভ বেড়ে যাচ্ছে৷ জনতার রোষানলে একবার পরলে আর রক্ষে নেই৷ ইতিহাস বলে আজ অবধি কেউ রক্ষা পায়নি৷
আমরা সব ভাই বোন আব্বার এই নৈতিক স্খলের জন্য অপরাধী মনে করি৷ কিন্ত সরাসরি না বলে ইনিয়ে বিনিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি৷ শুধু বলেছি আব্বা অনেকতো হলো৷ এখন ক্ষান্ত দিন৷ সময়ের দাবীকে উপেক্ষা করা সমিচীন নয়৷ কিন্ত তিনি অনড়৷ নিজের জন্মদাতা তাই ডায়রেক্ট কিছু বলাও যায়না৷
আমরা এক মহাসংকটে নিপতিত৷ তাকে ফেরাতে না পারাতে সকলে আমাদের দোষারোপ করছে৷ অন্যদিকে তার জীবনে ভয়ংকর কিছু ঘটলে নিজেদের ক্ষমা করতে পারবোনা৷
এখন আমরা সকলে প্রতিদিন একটা অশুভ সংবাদের যাতনা নিয়ে দিন পার করি৷ কেননা সময়ের দাবী ইচ্ছে করলেও উল্টানো যায়না৷

ইতিহাসের বড় সত্য হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয়না৷ আব্বাও না৷
আফসোস! অবধারিতভাবেই আব্বা নিজেই আজ হয়ে গেলেন এক ইতিহাস৷

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।