ন’ পাঁচের লোকালে বেরুলেই ভদ্রলোককে দেখতে পাই।
এমনিতে আমার সিফটিং ডিউটি। একুশ দিন অন্তর যখন দশটা-ছ’টা জেনারেল ডিউটিতে যাই, ভদ্রলোক থাকেন পরিচিত রোদের মতন। উল্টো দিকের গেটে। বাঁ হাতে হ্যাঙার ধরে ডান হাত পকেটে ঢুকিয়ে। ধবধবে সাদা ফুল স্লিভ জামার সঙ্গে কালো প্যান্ট। গলায় নেকটাই সম্বলিত মানুষটাকে আপাতদৃষ্টিতে কেতা দুরস্ত বলেই মনে হয়। কারো সঙ্গে বেশী কথা বলেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন নিজের মধ্যে। দীর্ঘদিন ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করার ফলে যাত্রীদের মধ্যে এক অলিখিত আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। দু’চারদিন দেখা-সাক্ষাত না হলে, কুশল বিনিময়ের পর না দেখতে পাওয়ার কারণও দর্শাতে হয়। ভদ্রলোক সেই সামান্য সৌজন্যটুকুর ধার-পাশ দিয়েও যান না। তবু আছেন পরিচিত আকাশে সন্ধ্যাতারার মতন।
ডানকুনি আসাতেই ট্রেনটা প্রায় খালি হয়ে যায়। ন’টা ষোলর শিয়ালদা লোকাল ধরার জন্য যাত্রীরা পড়িমরি করে ছুটতে শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেনটা আবার ভর্তিও হয়ে যায়। তবু ভিড়ের চাপটা বেশ হাল্কাই থাকে। কিন্তু প্রথম ধাক্কাটা সামাল দেবার জন্য গায়ে একটু গত্তি থাকার দরকার। তাস-পার্টিরা হুড়মুড় করে উঠেই ঠেলাঠেলি শুরু করে, নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার জন্য। ভদ্রলোকের গায়ে এই আঁচটুকুও পৌঁছায় না। তিনি থাকেন নিরাপদ দূরত্বে।
সেদিনও ওঁরা উঠেছে। ভাবলাম ঠেলাঠেলি এক্ষুণি থেমে যাবে। কিন্তু না, থামল না। অনবরতই একটা মৃদুমন্দ চাপ আসতে লাগল। কথায় কথায় জানা গেলো, ট্রেনটা আজ সামনের দিকে বেশী টেনে দিয়েছে। ওঁরা উঠতে পারেনি।
তারপরেই এক অপরিচিত ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন, আমার মানিব্যাগটা…ওতে আমার অনেক দরকারি কাগজপত্র আছে। কে নিলেন ভাই…প্লিজ…
প্রায় কেঁদেই ফেললেন ভদ্রলোক। ভিড়ের মধ্যে এক জন বলে উঠলো, ঠক করে কি যেন একটা পড়ার আওয়াজ পেলাম বলে মনে হলো। আর এক জন বললে, এই তো, এই দাদা কী যেন একটা কুড়িয়ে পকেটে রাখলেন না! কী কুড়ালেন দাদা! পকেট থেকে হাতটা বের করে দেখান না একবার…
কেতাদুরস্ত পরিচিত রোদের মতন ভদ্রলোক বললেন, আমি কিছু কুড়োইনি।
প্লিজ দাদা কী কুড়োলেন দেখান না, মানিব্যাগ হারানো ভদ্রলোকটি বললেন, টাকাপয়সা যা আছে সব নিয়ে নিন, কেবল ব্যাগটা আমায় দিয়ে দিন। সামনের সপ্তাহে আমার মেয়ের বিয়ে। ওতে ওর ছবি আছে। কতদিন দেখিনি ওকে। কুড়ি বছর হয়ে গেল ডিভোর্স হয়েছে। প্লিজ দাদা…
বলছি তো নিই নি। ওরকম স্বভাব নয় আমার।
দূর মশাই, সত্যবাদী যুধিষ্ঠির! দেখান দেখান না হলে… ; আরও চার-পাঁচ জন গলা মেলালো।
কি করবেন না দেখালে?
আমরা যারা নিত্যযাত্রী তারাও চাইছিলাম, কি দরকার বাপু ঝামেলা বাড়ানোর, দেখিয়ে দিলেই তো মিটে যায়। কিন্তু ভদ্রলোক অনমনীয় আর অসম্ভব জেদী। কিছুতেই দেখাবেন না। মুখের কথাই বেদবাক্য।
কতগুলো ইয়ং ছেলে তাস খেলছিল। তারা বললে, দেখলেন তো তাসপার্টি থাকা কত ভাল। একদিন একটা টিম উঠতে পারেনি অমনি গন্ডোগোল। এই চল তো, গেটে গিয়ে দাঁড়াই। গন্ডোগোল একটা আছে এর মধ্যে। দেখছিস না কতগুলো নতুন মাল উঠেছে।
যে ভদ্রলোক মানিব্যাগের জন্য কাঁদছিলেন, যে বা যারা ভদ্রলোককে পকেট থেকে হাত বের করতে বলছিলেন, তারা যেন একটু মিইয়ে গেলেন।
ছেলেগুলো গেটের কাছে দাঁড়িয়ে একের পর এক বেশ রোয়াবি মেরে বলে চলল, কি আছে দাদা দেখান আপনার পকেটে। ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি!
এবার একটু উজ্জীবিত হয়ে ওঁরা বললেন, ঠিক বলেছেন কখন থেকে বলছি, তা না সত্যিবাদী যুধিষ্ঠির…
একটা কথা কতবার বলব, বলেছি তো পকেটে কিছু নেই।
আর এরপরেই ঘটল আসল ঘটনা…
শুরু হলো বচসার সঙ্গে প্রায় ধ্বস্তাধ্বস্তি। ছ’সাত জনের সঙ্গে একা একজন পেরে ওঠেন কখনও!
কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক গেটের কাছে পাহারা দেওয়া ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বললেন, তোরা আমার সঙ্গে এ রকম করতে পারলি! আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতন আমায় থাকতে দিলি না, বলেই যন্ত্রণায় কুঁচকে উঠলেন, আহ্…
ঠিক সেই সময়ে, যে ভদ্রলোক বলেছিলেন, দাদা কি যেন কুড়ালেন, তিনি ওই ধ্বস্তাধ্বস্তির মধ্যে হঠাৎ করে হেঁট হয়ে কিছু যেন একটা করতে যাচ্ছিলেন, চিৎকার করে উঠলেন, আহ্…; ওরে বাবা রে মরে গেলাম রে…
দেখা গেলো, কেতাদুরস্ত ভদ্রলোকের জামার ডান হাতাটা বোতাম ছিঁড়ে কনুইয়ের ওপর থেকে শূন্যে দুলছে। আর কাঠের ফলস্ হাতটা ধ্বস্তাধ্বস্তির জেরে খুলে গিয়ে সজোরে ওই ভদ্রলোকের মাথায় পড়েছে। আর তারই পায়ের তলায় ব্যাগটা উঁকি মারছে তখনও…