গল্প গাথায় সোহম চক্রবর্তী

জীবিকা নির্বাহ

কলকাতা শহরের ব্যস্তময় জীবন ,সূর্য উঠবো উঠবো থেকে সবাইকে বেরিয়ে পড়তে হয় নিজেদের রুজি রোজগারের উদ্দেশ্যে আর শেষ হয় সন্ধ্যায় অথবা রাতে সবাই কম বেশি শ্রম করে যেতে হয় তাদের কর্মস্থলে সময়মতো পৌঁছবার জন্য। কিন্তু সৌমেন বাবু এই চিন্তাধারার নয়, একটু উন্নাসিক গোছের মানুষ নিজের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে মস্ত এক ঝা চকচকেকে স্করপিও গাড়ি।গাড়ির চালক এসে একটা সেলাম ঢুকে দরজা খুলে দেয় ,আর সেই গাড়িতেই তিনি বেরিয়ে পড়েন তার অফিসের দিকে।
“বুঝলে সোমা এই লোকেদের কাজে যেতে এত অনীহা বোধ কেন কে জানে এই তো সেদিন শ্যামলদা হন্তদন্ত হয়ে অফিসে ঢুকলেন যদিও দশ মিনিট দেরি হয়েছে কিন্তু এসেই একটা না একটা বাহানা ধরে।” একটা বিদ্রুপাত্মক হাসি হেসে খবরের কাগজে চোখ রাখলেন সৌমেন বাবু। সৌমেন বাবু স্ত্রী অর্থাৎ সোমা তার স্বামীর স্বভাবের একদম উল্টো ,উনি বোঝেন যে সব মানুষদের খেতে পারো যোগাড় করে আনতে হয়। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখেই তিনি বললেন,” কথাটার কি মানে হলো?” সৌমেন বাবু খবরের কাগজে চোখ রেখেই বললেন,” কি আর বলবো মোদ্দাকথা আমি বলছি যে, এই লোকেরা কাজে না যেতে এত বাহানা কেন ধরে কে জানে বাড়িতে ফিরে নাকি তাদের এনার্জি থাকে না!”
এবার সময় বিরক্ত হয়েই বললেন ,”দেখ অনেকদিন এরকম শুনছি তোমার থেকে তুমি নিজে গাড়িতে চেপে আরাম করে যাও বলে কি সবাই একইরকম ভাবে যায় সব সময় তো তুমি নিজের জায়গায় তাদের বসাও একবার তাদের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখো আর ভাবো যে কত কষ্ট করে তাদের দু পয়সা রোজগারের জন্য যেতে হয় ।”
সৌমেন বাবু আবার এক গাল হেসে চলে গেলেন ঘরের মধ্যে।
এর মধ্যেই সৌমেন বাবুর গাড়িটা হয়ে গেল খারাপ সেদিন ছিল তার অফিসে একটি জরুরী মিটিং সকাল থেকেই একরাশ চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে কি করে তিনি অফিসে যাবেন তার স্ত্রী বললেন ,”এখন কি করে যাবে গানটা তো খারাপ হয়ে গেল!”
“তাই তো ভাবছি কি করা যায় এদিকে আজকে আবার জরুরী মিটিং আছে !”বললেন সৌমেন বাবু
“আজকে তাহলে বাদ দাও কি করে আজ যাবে……?”
“না না তা হয় না সোমা আজকের মিটিংটা অত্যন্ত জরুরি বোঝো এটা।”
“তাহলে বাসায় চলে যাও অনেক দেরি তো হয়েই গেল।”
কপট রেগে গিয়ে সৌমেন বাবু বললেন ,”অবুঝের মত কথা বল না ওসব বাসে টাসে আমি উঠতে পারব না ওরকম ঠেলাঠেলি ভিড়ের মধ্যে আমি কি কখনো যেতে পারবো ?আমি বরং ক্যাব বুক করে নিচ্ছি।”
সোমা বললেন ,” এত জেদ যে কেন করো একটা দিন বাসে গেলে যে কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো কে জানে??”
যেরকম কথা যে রকম কাজ সৌমেন বাবু একটা ক্যাব ভাড়া করলেন মিনিট পাঁচেক পরে ক্যাবটা আসলো এবং সৌমেন বাবু ক্যাবে করে বেরিয়ে গেলেন।
বড় রাস্তায় ট্রাফিক আটকে আছে হঠাৎ গাড়ীর কাঁচটায় কেউ টোকা মারল,সৌমেন বাবু দেখলেন যে একজন ভদ্রলোক ,চল্লিশের কাছাকাছি বয়স ,জামাকাপড়ও একটু ময়লা দারিদ্রতার স্পষ্ট ছাপ বোঝাই যাচ্ছে আর হাতে একটা ক্রাচ নিয়ে। ভদ্রলোক সৌমেন বাবুকে বললেন,” দাদা কেক নেবেন? ছোট-বড় সব সাইজের আছে খুব ভালো দাদা খেতে ,একটা নিন না।”
সৌমেন বাবু ব্যঙ্গ করে বললেন ,”দোকান থাকতে আমি তোমার কাছ থেকে কেন কিনতে যাব ?যাও এখন আমি ব্যস্ত আছি।”
“একটা খেয়ে দেখুন না দাদাবাবু বলছি তো খারাপ হবে না আপনার ভালোই লাগবে, একটা অন্তত নিয়ে দেখুন।”
“কেন বিরক্ত করছেন বলুন তো ?আমি বলছিতো যে আপনার থেকে আমি নেব না আপনার থেকে এত দূরবস্থা হয়নি যে কোন দোকান ছেড়ে রাস্তা থেকে এরকম ভাবে কিনবো ,”বলে কাঁচ উঠিয়ে দিল সৌমেন বাবু।
অগত্যা সে ভদ্রলোককে চলে যেতে হল।
সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরলে সোমা চা দিল সৌমেন বাবুকে চা খেতে খেতে টিভির দিকে খবরের চ্যানেল দেখছেন, হঠাৎ ঘর থেকে সৌমেন বাবুর মেয়ে এসে বললো ,”বাপি পরশু তো ক্রিসমাস আমার কিন্তু একটা ফ্রুটকেক চাই তুমি কিন্তু মনে করে আমার জন্য নিয়ে এসো, কেমন?”এই কথা শুনে সৌমেন বাবু বললেন ,”অবশ্যই আনব ,তুমি চিন্তা করো না তোমার কথা মত একটা ফ্রুটকেক আনবো।”
মাঝখানে একটা দিন বাদ দিয়ে ক্রিসমাস এল সৌমেন বাবু রেডি হয়ে বের হবেন তখন তার মেয়ে এসে বললো “মনে আছে তো বাপি কেক আনার কথা? ভুলে যেও না কিন্তু!!”
মুচকি হেসে মেয়েকে বললেন,” তোমার কোন কথাটা আমি ভুলেছি বলতো? আমি ঠিক তোমার জন্য একটা ফ্রুট কেক নিয়ে আসব।” এই বলে বেরিয়ে গেলেন উনি রাস্তা আটকে গেলেন আবার কে যেন কাঁচে টোকা মারলো, সৌমেন বাবু কাঁচ নামিয়ে দেখল সেই ভদ্রলোক যে কিনা তার কাছে সে বিক্রির জন্য এসেছিলেন বললেন ,”কি হল আবার কেন এসেছ?” ভদ্রলোকের মুখে একগাল হাসি তিনি বললেন ,”দাদাবাবু আজ বড়দিন কেক নেবেন না ?একটা ছোট দেখে নিন, আপনার ভালো লাগবে।”
সৌমেন বাবু বললেন,” বলছি তো আপনার থেকে নেব না আপনি যান এখান থেকে ,দোকান থাকতে আপনার থেকে নিতে যাব? যান যান এরকম ভাবে বিরক্ত করবেন না।”

সেই ভদ্রলোক বললেন,” দাদা বাবু আপনাদের টাকা আছে ,চাইলেই আপনারা অনেক বড় দোকান থেকে কেক নিতে পারবেন কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি যে কেক দেবো আপনাকে সেটা আপনার অপছন্দ হবে না।”

“কেন কথা বাড়াচ্ছেন বলুনতো ,যান এখান থেকে যত্তসব!!” রেগে গিয়ে বললেন সৌমেন বাবু।
অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল সৌমেন বাবুর , ফোন লাগালো সোমাকে,” হ্যালো সোমা এই বেরোলাম অফিস থেকে আসলে ক্লায়েন্টসরা সব দেরী করে এল তাই শেষ হতে দেরী হয়ে গেল!”

“সে কি এখন রাত দশটা বাজে তুমি এখন বেরোলে কি করে কেক পাবে ? এখন তো কোনো দোকান খোলা থাকবে না !” চিন্তিত হয়ে বলল সোমা।

“দেখছি কি করা যায়” বলে তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিল সৌমেন বাবু এবং গিয়ে গাড়িতে বসে রওনা হল এদিকে মেয়ের কথা ভাবছে যে কত শখ করে মেয়েটা একটা আবদার করল তার কাছে সেইটুকু যদি তিনি না রাখতে পারেন তাহলে তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে সেটাও তিনি সহ্য করতে পারবেন না এইসব চিন্তা করছেন আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন যাতে কোনো দোকান খোলা থাকে ভাগ্যক্রমে কিন্তু কোন দোকান খোলা ছিলনা। মন খারাপ করে বাড়ির দিকে রওনা হলেন।
বাড়ির কলিং বেল টিপতেই মেয়ে খুশি মুখে দরজা খুলল সৌমেন বাবু একটু আশ্চর্য হলেন মেয়েকে দেখে ,পাশে সোমা ও দাঁড়িয়ে আছে মুখে একগাল হাসি। সৌমেন বাবু মেয়েকে বললেন, “শোন মা আমার প্রচুর কাজের চাপ ছিল রে না হলে এত দেরি করে কোনদিন আসি ? আর সরি রে তোর কেকটা………..”
মেয়ে বাবার গলা জড়িয়ে বলল ,”বাপি কোন চিন্তা করো না মা আমাকে বলেছে তোমায় বেরোতে দেরী হয়েছে আর কেক চলে এসেছে এই তো কিছুক্ষণ আগে একটা কাকুর থেকে কিনলাম বাড়ির সামনে দিয়েই যাচ্ছিল মা কিনে দিল ঠিক যেমন ফ্রুটকেক চেয়েছিলাম সেরকমই।” সৌমেন বাবু বলল ,”তুমি কোনো দোকান থেকে কেন কিনলে না?”
মেয়ে বললো,” তখন তো জানতাম না যে তোমার দেরী হবে যখন শুনলাম আমার একটু মন খারাপ হয়েছিল তখনই কাকু টা যাচ্ছিল তারপর মা কে বলে কিনে নিলাম।”
সব শুনে সৌমেন বাবু তার স্ত্রী অর্থাৎ সোমাকে বলল “কার থেকে নিয়েছো তুমি?”
সোমা বাইরের বারান্দার দিকে দেখালো সেখানে এক ভদ্রলোক বসেছিলেন সোমা বললেন,” ওনার থেকেই তো নিলাম ,বেশ ভালো জানো তো খেতে , আমরা খেয়েছি তুমি খাও দেখো কি সুন্দর খেতে দোকানে কেক কেও হার মানিয়ে দেবে!” এরইমধ্যে প্লেটে করে মেয়েটি একটুকরো কেক সৌমেন বাবুকে দিয়ে বললেন ,” দেখো বাপি কি ভালো খেতে।”
একটু সংকোচ এর সঙ্গে প্লেট টা নিলাম সৌমেন বাবু, তারপর একটুখানি মুখে দিতেই তার মুখের ভাব বদলে গেল সত্যি কি সুন্দর খেতে ,এরকম স্বাদ জীবনেও পায়নি , কতো নামকরা দোকান থেকেও খেয়েছেন কিন্তু এই স্বাদ একদম অন্যরকম ,তিনি খাওয়ার পরে ভদ্রলোককে বললেন ,”সত্যি খুব সুন্দর খেতে কেকটা। যখন ভদ্রলোক সৌমেন বাবুর দিকে তাকালো সৌমেন বাবু হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তিনি ভাবছেন এতো সেই ভদ্রলোক যার থেকে কিনতে বারংবার দ্বিধা বোধ করেছিলেন অনেক কটু কথাও বলেছিলেন তিনি তাকে।
ভদ্রলোক বললেন ,”দাদাবাবু আপনার যে কেকটা পছন্দ হয়েছে এতে আমি খুব খুশি হয়েছি আসলে কি বলুন তো জীবিকা নির্বাহ করার জন্য মানুষ তো কত কষ্ট করে তাই আমিও হাল ছাড়িনি এই ক্রাচ নিয়েও বিক্রি করতে বেরিয়েছি , সংসারে দুটো পয়সা না হলে তো বাড়িতে বউ ছেলের ভাত টুকুও জুটবে না।” বলতে বলতে চোখ ছল ছল করে উঠলো ভদ্রলোকের।
সৌমেন বাবুর এবার একটু পরিবর্তন হলো তিনি ভাবলেন মানুষ কোন প্রান্তে যেতে পারে নিজের রুজি রোজগারের জন্য , আসলে তিনি নিজে এরকম কোন পরিস্থিতিতে পড়েন নি তাই হয়তো আর পাঁচজনের কষ্টের জায়গাটা তিনি বুঝতে পারেননি , একটা 200 টাকার নোট বের করে করে ভদ্রলোকের হাতে দিতেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন ,” দাদাবাবু কেকের দাম 50 টাকা আপনি তো বেশি দিচ্ছেন!”
সৌমেন বাবু বললেন ,” হ্যাঁ জানি কিন্তু ভুলটা সম্পূর্ণ আমারই , নিজের টুকু সবসময় দেখেছি বলেই হয়তো বাকিদের কষ্টটা সেরকমভাবে আমি বুঝিনি , এই বাড়তি টাকাটা আপনার প্রাপ্য, আপনার জীবিকা নির্বাহের ফল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।