গল্পে শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

বুড়ো দাদুর মন্দির
বহু যুগ আগেকার বাড়ি। বাবার অবর্তমানে বাড়ির মিউটেশন সংক্রান্ত কিছু দরকারী কাজের বিষয়ে নলিনী বসু রোডে আমাদের এক পুরোনো উকিল কাকুর কাছে এসেছি। চাপা গলি রাস্তার মাঝে আদ্যিকালের স্যাঁতসেঁতে নোনা ধরা বাড়ি।
কাকু নীলাভ চরণ বিশ্বাস আর আমার বাবা একই কোর্টে কাজ করতেন। অনেককালের বন্ধুত্ব দুজনের। কাকুকে আমাদের বাড়িতে আগে বারকয়েক আসতেও দেখেছি। যদিও উনি আমাদের সেভাবে কোনোদিন দেখেছেন কিনা মনে পড়ে না।
মুখে না চিনলেও পরিচয় দিতে অবিশ্যি সহজেই চিনলেন ভদ্রলোক।
কাকুদের দোতলার ঘরে ছাদের গা ঘেঁষা জানলার ধারে বসে বাড়ির বিষয়ে কিছু আইনি কথাবার্তা সারছিলাম। চলে যাবার মুহূর্তে চোখ দুটো হঠাৎ জানলা দিয়ে আনমনে ছুঁয়ে গেল…
অনেকটা দূরে বাড়িঘর জনবসতি ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাদা চূড়া দুটো।
কতদিন পর দেখলাম, নিজেও জানি না ! এই বাড়ির দোতলার ঘরে না এলে হয়তো দেখতেও পেতাম না। আগে আমাদের বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে দূর থেকে মন্দিরের ঠিক এই বড় চূড়া দুটোই চোখে ভাসতো। এখন আর ছাদেই বা ওঠা হয় কই….কংক্রিটের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে সে সময়, সে দৃষ্টিপথ।
একটু থমকে গিয়ে কৌতুহল বশত কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ মন্দিরে এখন কে থাকে জানেন?’
‘ কে আবার থাকবে? কেউ থাকে না। ‘
‘ কেন? গুরুদেবের সঙ্গে যিনি সর্বক্ষণ ছায়া হয়ে থাকতেন, সে নীলকান্ত মহারাজ, তিনি কোথায় গেলেন?’
আমার দেওয়া মিউটেশন সংক্রান্ত কাগজপত্র গুলো হাই পাওয়ারের চশমার ফাঁক দিয়ে ভুরু কুঁচকে দেখছিলেন কাকু, কথাটা শুনে মুখ তুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘ মহারাজ? সে তো পালিয়ে গিয়েছে…তা ধরো বছর, হ্যাঁ, পাঁচ সাত তো হলো…হঠাৎ করে মন্দিরের প্রসঙ্গ তুললে বলে কত ছবি মনের মাঝে ভীড় করে আসছে….এখন ভাবলে মনে হয় সেসব কোন্ আদিযুগের কথা! আমি, আর বিনয় তখন এ পাড়াতেই পাশাপাশি বাড়িতে ভাড়া থাকতাম…ও পাড়ার দুঁদে সরকারি উকিল বিজয় নন্দীর তখন নামডাক তুঙ্গে। আমাদের গুরুদেবের মন্দিরের পেছনে বিভিন্ন সময়ে যে কজন মোটা টাকাপয়সা ডোনেট করেছিলেন তাদের মধ্যে বিজয় নন্দী প্রথম সারিতে। তিনি তখন মন্দির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি। কাজের সূত্রে নন্দী বাড়িতে প্রায়ই যেতে হত আমাদের। একদিন নিয়ে গেলেন আমাকে আর বিনয়কে গুরুদেবের কাছে। আলাপ হল,পরিচয় হল, একটু একটু করে যাতায়াত বাড়লো মন্দিরে। ঠাকুর যে কিভাবে মনের একটা বড় অংশে জায়গা করে নিলেন নিজেও জানি না। দীক্ষা নিয়ে ফেললাম গুরুদেবের কাছে…বিনয় কিছুতেই নেবে না…সে ছিল ঘোর নাস্তিক…কান ধরে দীক্ষা নেওয়ালাম…চোখের সামনে বদলে গেল সে ছেলে…গুরুভক্তি এলো, প্রনাম করতেও শিখলো…শিখবি না মানে, শিখতে বাধ্য। স্বামীজির চাইতে নাস্তিক সংসারে আর কে ছিল…সে ছেলেও রামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসে… সাক্ষাৎ অবতার ছিলেন আমাদের গুরুদেব…অবতার হয়েই চলে গেলেন…একশো পনেরো বছরের মানুষটা, যখন মন্দিরের আরাধনা স্থলের পাশের চত্বরে চেয়ার সমেত উপবিষ্ট অবস্থায় সমাধিস্থ করা হচ্ছে, কে বলবে আত্না দেহ ছেড়ে চলে গেছে…কোথাও এতটুকু মৃত্যুর ছায়া বা স্পর্শটুকু নেই…বুঝি বা কিঞ্চিৎ নিদ্রা যাপন করছেন, চোখ খুললেই অনন্ত জ্যোতি ভাস্বর হয়ে উঠবে! সে মহাপ্রয়ানের ঘটনা আস্তে আস্তে কিরকম যেন একটা একটা করে নিভিয়ে দিল মন্দিরের বাতিগুলো…অত লোকজন, অত ভক্ত শিষ্য, সেবায়েতের দল, ফি বছর রাসপূর্ণিমায় বাবার জন্মতিথি পালন, মহোৎসব, সন্ধ্যারতির ঘন্টা, হরিধ্বনি, নিত্যদিনের কীর্তন…আর কিচ্ছু রইলো না, বছর কয়েকের মধ্যে অদ্ভুতভাবে সব বিদায় নিল…তারপর একদিন শুনি মহারাজ নিজেই নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে…কোনো এক শীতের রাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপিসারে কোথায় যে উবে গেল সে লোক…! আর গেলই বা কেন..সে এক বিস্ময় বটে!
একটানা কত বছর মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আমার আর বিনয়ের! সেই দেবালয় এখন খাঁ খাঁ পড়ে আছে। বয়স হয়েছে তো, এসব দৃশ্য মেনে নিতে কষ্ট হয়…ছোটো নাতনিটা জল বসন্তে ভুগছিল…রোগ আর ছাড়ে না কিছুতেই…বাবার কাছে নিয়ে গেলাম…মাথাটা বার কয়েক ঝেড়ে জলপরা দিয়ে দিলেন…পরের দিন থেকে সে মেয়ে আলোর মুখ দেখতে শুরু করলো। ধন্বন্তরি বলবো নাকি দৈব শক্তির অধিকারী বলবো!
তারই মাস খানেক বাদে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে শুনি গভীর রাতে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বাবার চিরবিদায়! আমার কি মনে হয় জানো? এ একেবারেই স্বেচ্ছামৃত্যু। নইলে একশো পনেরো যার বয়স, আর যাই হোক এমন করে আত্নসমাধি তার হতে পারে না।
মহারাজের খবরটা পেয়ে সত্যিই বেশ আপসেট হয়ে পড়েছিলুম…শেষমেশ চলেই গেল! তবু তো খানকতক বাতি জ্বলতো। এখন দ্যাখো গে যাও, রাত না হতেই অমাবস্যার অন্ধকার! ‘
শেষ বিকেলের ছায়া নেমে এসেছে মন্দিরের চূড়ার গায়ে। কয়েকটা পাখি বসেছিল বোধহয় বড় চূড়ার শীর্ষপ্রান্তে যেখানে ত্রিশূল দেখা যায়। উড়ে গিয়ে আকাশে কোথায় মিশে গেল। ছোটোবেলায় মন্দিরে গেলে মাথাটা উঁচুতে তুলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম চূড়াগুলোর দিকে। বাবা বলতেন, পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের আদলে তৈরি এ দেব ভাস্কর্য।
…’ দেবভাস্কর্য’…সেদিন শব্দটুকুর মানে বুঝিনি। আজ বুঝি। সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক অন্যরকম অন্ধকার যেন প্রাক সন্ধ্যার আবছায়া পথ ধরে আমায় আর এক কৌতুহলী জীবনের প্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিল…
বললাম,’ কেউ থাকে না মন্দিরে? অবাক কান্ড! নীলকান্ত মহারাজই বা কি কারণে চলে গেল?’
শেষ কথাটা যেন নিজের মনেই বলে ফেললাম।
কি একটা ভাবলেন নীলাভ কাকু। জানলার দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘ কে কখন কি কারণে চলে যায় পৃথিবীতে এর চেয়ে কঠিন প্রশ্ন আর হয়না। কেউ চলে যায় জগৎ সংসারের মায়া কাটিয়ে…যেভাবে তোমার বাবা মানে বিনয় একদিন কথা নেই বার্তা নেই আমায় না জানিয়েই চুপিসারে চলে গেল…যখন জানলাম তখন আর কার ওপরেই বা অভিমান করবো, কার ওপরেই বা রাগ করবো, আর কার সাথেই বা ঝগড়া করবো…সবই তো স্মৃতি হয়ে গেল! কেউ সেই স্মৃতি আঁকড়ে জীবন কাটিয়ে দেয়, কারো কাছে সেই স্মৃতিগুলোই ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। পাথরপ্রমান।
তবে এটা বলবো, লোভের বশে চুরী বা সেরকম কিছু করে নীলকান্ত মহারাজ পালিয়ে যায় নি। তেমন হলে সাড়া পড়ে যেত। মন্দিরের স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তিরই হদিশ মহারাজের অজানা নয়। চাইলেই অন্য কিছু করতে পারতো। তা যখন হয় নি, তখন সাধারণ চোখে এটাই ভেবে নেওয়া যায়, হয় সে স্মৃতিভারে জর্জরিত হয়ে একাকিত্বের জ্বালায় পালিয়ে গিয়েছে, আর নয়তো অন্য কিছু…বয়স হয়েছে তো, তাই মন থেকে চট করে উড়িয়ে দিতে পারি না ভাবনাটাকে।’
পিতৃহীনতার দুঃখ বা শূন্যতা আজ এতবছর পরেও মনকে গ্রাস করে। তার থেকেও হয়তো বেশি পীড়িত করে মায়ের একাকিত্ব। জীবন এমনই। একটু একটু করে সকলকেই কোনো এক নিরালা নিঃসঙ্গ প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। অনেকের মাঝে জড়িয়ে থেকেও একটা সময় আসে যখন নিজের কাছে একা হয়ে পড়ি আমরা।
মনে পড়ে অনেক ছেলেবেলায় মন্দিরে যখন যেতাম তখন আমাদের পরিবার আজকের মতো ছিল না। সে ছিল যৌথ পরিবার। বেশিরভাগ সময় মা, জেঠিমা,কাকিমাদের হাত ধরেই মন্দিরে যেতাম। মা বলতেন, ‘ বুড়ো দাদুর মন্দির।’
সেদিনের ঐ কথাটাই সময় সময় আজও বেরিয়ে আসে মুখ থেকে।
একদিন নীলাভ কাকু বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন দীক্ষা নিতে। এমন একটা সময় এলো যখন পরিবারের সকলের কাছেই আরাধ্য দেবতার মতো হয়ে উঠলেন আমার ছোটবেলার ‘বুড়োদাদু।’
কিছু কিছু জিনিস যা শৈশব থেকে মন্দিরে দেখে এসেছি সেগুলো এতদিনেও মনের একটা গভীর কোণ যেন আলো করে রেখে দিয়েছে। মন্দিরের কীর্তন ঘরের পেছনের আবছা অন্ধকারে ঢাকা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার প্রশস্ত বারান্দায় কাঠের চেয়ারে উপবিষ্ট গেরুয়া বসন পরিহিত বুড়ো দাদুর সেই জটাজুটোধারী প্রশান্তিময় ছবি, চেয়ারের পাশে দাদুর পানের পিক ফেলার পেতলের সেই বড় ডাবরখানা, বারান্দার দেওয়াল জুড়ে মস্ত লোহার খাঁচায় উড়ে বেড়ানো রঙবেরঙের পাখিগুলো, তাদের কিচিরমিচির কলরব, সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচের ঐ কীর্তন ঘরে উঁচু বেদির ওপর স্থাপিত একটা বিশালাকৃতির কালো কষ্টিপাথরে তৈরি গরুর দেবতার মূর্তি…যে মূর্তির হদিশ গুপ্ত যুগের ইতিহাসের পৃষ্ঠাটুকুর বাইরে আর কখনো কোথাও খুঁজে পাই নি, কীর্তন ঘরের উল্টোহাতে মার্বেল পাথরের শান বাঁধানো প্রকান্ড সভাগৃহের দেওয়ালের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত জুড়ে মুকুট পরা নাম না জানা রাজা, মুন্ডিত মস্তক কপালে তিলক কাটা রাজপুরোহিতদের সারিবদ্ধ মাটির মূর্তি…যতদিন যতবার মন্দিরে গেছি, ঐ ঘরে ঢুকলেই আগে তাকিয়ে থাকতাম মূর্তিগুলোর দিকে…জানি না কেন….তবে বিস্ময়বোধের নিরিখে এই সব কিছুকে ছাপিয়ে যেত মন্দিরের চূড়া দুটো…এত বড় আর উঁচু চূড়া পুরীর জগন্নাথ মন্দির ছাড়া আমি আর কোথাও দেখি নি…যাদের কথা নতুন করে বাবার মুখে শুনি ইউনিভার্সিটি জীবনে পা দিয়ে। কাঁচরাপাড়া অঞ্চলে তখনো প্রোমোটারি রাজ শুরু হয়নি। মানুষ জমি ভিটে আঁকড়েই কম বেশি সুখে শান্তিতে বসবাস করতে অভ্যস্ত ছিল। ইতিহাস তাই হারিয়ে যায় নি।
….’ সামনে রথ। উৎসবের আগে মন্দিরটাকে সাজাচ্ছে। দেখতেও ভালো লাগে…’
একদিন দুপুরবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে আমায় উদ্দেশ্য করে বলছিলেন বাবা।
সত্যিই তাই। যদিও অনেকটা দূর, তবু বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে দুটো লোক কি সুন্দর দড়ির সাহায্যে বেয়ে বেয়ে চূড়ার একেবারে মগডালে উঠে ত্রিশূলের আগায় পতাকা টাঙাতে শুরু করেছে… দেখতেও ভালো লাগে।
….’ চূড়ার গায়ে গায়ে খোদাই করা পাথরের কত যে সব কারুকার্য আছে…ওগুলো কখনো নজর করেছিস খোকা?’
বলছিলেন বাবা।
অত খুঁটিয়ে সত্যিই যে কখনো দেখা হয়ে ওঠে নি, বললাম বাবাকে।
‘ ইতিহাসের ছাত্র…ওগুলো দেখবি না? বাঃ! ও হলো বিশেষ এক ধরনের শিল্পকার্য, যার নাম নাগড় শিল্পরীতি। মূলত দক্ষিন ভারত থেকে আমদানি, তবে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরেও এই ধরনের শিল্পের ব্যবহার স্পষ্ট লক্ষ্য করা গেছে। এখানে মূল মন্দির অর্থাৎ গর্ভগৃহের চূড়ার ছাদটি সর্পিল ভঙ্গিতে পেঁচানো হত। কাছে না গেলে ভালো করে বুঝবি না, কত সুন্দর নিখুঁত ভাবে নকশাগুলো তৈরি করেছে…শুধু ছেনি হাতুড়ি সম্বল…সত্যিই দেব ভাস্কর্য! এবার রথ যাত্রার উৎসবে যদি যাস, সময় করে একবার দেখিস গিয়ে…’
কত রথ কেটে গেল, আর যাওয়া হয় নি। ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে ফিরে কফি হাউসে এক বিকেলে বসে কথায় কথায় বন্ধুদের কাছে একদিন গল্প করেছিলাম…সে নাগড় শিল্পরীতির গল্প…দেব ভাস্কর্যের গল্প…ওরা আগ্রহ ভরে বলেছিল, একদিন দেখতে আসবে…
ওরকম কত বিকেল কেটে যায় কফি হাউসে, কার কথা কে ই বা মনে রাখে!
তবে যেটুকু মনে রয়ে গেছে, সেটুকু রোমন্থন করে নিভৃতের এই ছোট্ট চৌকিটাতে বসে নির্দিধায় বলতে পারি…ইতিহাস হারিয়ে যেতে পারে, ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, মুছে যেতে পারে…তাকে ডেড চ্যাপ্টার কখনোই বলা যাবে না…জীবন্ত অশরীরী? তাহলে তাই…তার নিঃশ্বাস কিংবা নির্যাস অনেকটাই যে সেরকম, ঠিক যেমনটা মন্দিরের ভেতরে ঢুকলেই ধূপ ধূনোর এক অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ ভেসে আসতো, যেটা আজও আমার কাছে মন্দিরের গন্ধ হয়ে কোথাও একটা মিশে আছে। যেমন মিশে আছে কীর্তন ঘরে সেবায়েতদের খোল কর্তাল আর খঞ্জনি বাজিয়ে হরিনাম সংকীর্তনের ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ গুলো।
যাক সে কথা….
সেই ছোটো থেকে ফি বছর দেখে আসতাম আমাদের পরীক্ষার আগে মন্দিরে গিয়ে কলম পেনসিলগুলো বুড়ো দাদুর হাতে তুলে দিতেন মা জেঠিমারা। মায়ের মুখে শুনেছি ওকে বলা হতো পেন পড়ানো। দাদু কলমলোতে কিসব মন্ত্র পড়ে দিতেন। বিড়বিড় করতে করতে মাথার চুলে আলতো হাত বুলিয়ে দিতেন। সেই সঙ্গে ‘ কোনো ভয় নেই…ভালো করে পরীক্ষা দাও…বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করো…’
ইত্যাদি কিছু কিছু উপদেশও দিয়ে দিতেন।
কোন্ মন্ত্রবলে জানি না, সেই সব উপদেশ বাণী, মন্ত্রপূত কলম পেনসিল রবার জ্যামিতি বাক্স,আমার মাথায় কপালে বুড়ো দাদুর হাত বুলিয়ে দেওয়া…এইসব ব্যাপারগুলি প্রতি বছর পরীক্ষার আগে আমার মনোজগতে এক অদ্ভুত সোয়াস্তি যে বয়ে নিয়ে আসতো একথা বলতে বাধা নেই।
বাড়িতে অনেকেই বলতেন,’ গুরুদেব সাক্ষাত ঈশ্বর…নইলে শুধু পান আর জল খেয়ে কোনো মানুষ কখনো বেঁচে থাকতে পারে! ‘
বুড়ো দাদুকে ভগবান বলে নিজে থেকে যতটা না চিনতাম..হয়তো তার থেকেও বেশি আমার নিজের পরিবারের প্রতি আমার মনে যে স্বাভাবিক নির্ভরতা কাজ করতো সেই নির্ভরতা আসলে এমন একটি জায়গা যেখানে দাঁড়িয়ে চোখ কান বুজে বুড়ো দাদুর মাঝে ভগবানের আসল রূপটিও কল্পনা করে নেওয়া যায়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে সমাজে চলতে গিয়ে একটু একটু করে জীবন নতুন পথে বাঁক নিল। পড়াশুনা, বন্ধু বান্ধব, ভবিষ্যৎ, এগিয়ে চলার চিন্তা…এসবের মাঝে অন্য অনেক কিছুর মতো মন্দিরে যাতায়াতের সে রাস্তা ক্রমশ আমার আসা যাওয়ার বাইরে দূর থেকে আরো দূরে সরে এলো।
ততদিনে আমার নিজস্ব দৃষ্টিপথ তৈরি হয়েছে। সেই পথ অবলিলায় সবকিছুকে বিশ্বাস করে না। ভেঙেচুরে, অবিশ্বাসের পথ ধরে যেতে যেতে হয়তো একসময় বিশ্বাস করে নতুবা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এ জিনিসটা কিছুটা হলেও হয়তো আমার বাবার কাছ থেকে পাওয়া।
বাবার মুখে শুনেছি, নিলাভ কাকু যতই তাঁর ভালো বন্ধু হন না কেন, এককালে মন্দির কমিটির প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আইনের ফাঁকফোকড় কাজে লাগিয়ে, কমিটির বেশ কিছু স্তাবক লোকজনের সাহায্যে যেভাবে মন্দিরের প্রপার্টিগত মালিকানা হাতিয়ে নেবার মতলব করেছিল, জানাজানি হয়ে যাওয়ায় চক্ষুলজ্জায় আর নাকি সে মন্দিরের দরজাতেই পা দেয় নি কতবছর! যে কারণে প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ থাকাকালীনই তাকে সরিয়ে কালি ভাদূরিকে সর্বসম্মত সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
বাবার কথায়, ‘ সেই মানুষই সব কিছু স্থিতু হয়ে যাওয়ার পর আবার যখন চুপিসারে মন্দিরে ফিরে আসে, ঠাকুরমশাইয়ের কাছে ক্ষমাটমা চেয়ে নতুন করে তাঁর শিষ্যত্ব, মাহাত্ম্য প্রচারে ব্রতী হয় তখন নিজের কাছে নিজেরই ভারী অবাক লাগে! একদিন জোড় তর্ক বেধেছিল ওর সঙ্গে…শুধু জল আর পান খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে কি পারে না তাই নিয়ে। আমি বললাম পারে না…পারা সম্ভব নয়। ও ততই বলে হ্যাঁ পারে…পরে আর বিতর্ক বাড়াই নি…হাজার হোক, বন্ধু তো…ও আমায় চেনে, আমিও ওকে চিনি। এসবের মাঝে ঠাকুরমশাইকে নাই বা টেনে আনলাম। কি হবে ওসব কথায়..? শুধু ভক্তের ভগবান শব্দ টুকু কানে এসে বড্ড আঘাত করেছিল…!’
এসব ঘটনারও বহুবছর পর যেদিন শুনতে পেলাম ঠাকুরমশাই ইহজীবন ছেড়ে পরপারে প্রস্থান করেছেন, পুরী ধাম ( যেহেতু জন্মসূত্রে তিনি কটক জেলার মানুষ বলে শুনেছি) থেকে আগত জনাকয়েক বিশিষ্ট আচার্যগুরু এবং অন্যান্য ভক্তবৃন্দের ইচ্ছানুসারে চেয়ার সমেত মন্দিরের একটা অংশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছে, মন্দিরে আজ স্রোতের মতো মানুষের ভীড়, টেলিভিশন চ্যানেলে লাইভ টেলিকাস্টের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে সেই মহাপ্রয়াণের নিরবচ্ছিন্ন চিত্র…মন্দির এবং তার চৌহদ্দিটুকু তখন আমার কাছে জীবনের ভীড়ে মিশে যাওয়া কোনো এক ফ্যাকাশে অ্যালবামের টুকরো ছবি ছাড়া আর কিছু নয়।
তারপরে আরো বারোটা বছর কেটে গিয়েছে। আমাদের সে যৌথ পরিবার আজ আর নেই। একই বাড়িতে থেকেও যে যার মতো করে একা। মিউটেশন সংক্রান্ত কাজগুলো হয়ে গেলে হয়তো বাড়িটাও কখন যে বদলে যায় কে বলতে পারে?
যে বুড়ো দাদুর মন্দির একদিন যৌথ পারিবারিক জীবনে অন্যরকম ছায়া মেলে দাঁড়িয়েছিল, আজ কমে আসা আলোয় বহু দূর থেকে দেখা একাকি চূড়াদুটো, বাইরের অদ্ভুত শান্ত নিরালা পরিবেশ চিন্তা চেতনার পথ ধরে এক ভিন্ন পৃথিবীর ছায়াচ্ছন্নতার মাঝে এনে দাঁড় করিয়ে দিল আমায়!
নিলাভ কাকু, যিনি একটা সময় বুড়ো দাদুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন নিজের কৃতকর্মের কারণে..জানি না, অনুশোচনা বশত কিনা, কিন্তু আজ তিনি ছাড়া মন্দিরের বহু পুরোনো কালের ইতিহাস তুলে ধরার মতো মানুষ আমার চারপাশের বৃত্তে আর যে সত্যিই কেউই নেই…শেষ টুকু জানার জন্য তাকেই যে আমার দরকার….জীবন সত্যিই কি অদ্ভুত! কখনো সাধারণের ভীড়ে মিশে থাকা অতি নিরস বাস্তব, কখনো গল্প হয়ে উঠে আসে, কখনো একেবারেই অলিখিত….জীবনের একটা অধ্যায়ে এসে কেন যে বারবার টানছে ঐ নীলকান্ত মহারাজের চলে যাবার অলিখিত ইতিহাস…!
….’ বয়স হয়েছে তো, তাই ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিতে পারি না… ‘
ঠিক কোন্ ভাবনার কথা বোঝাতে চাইলেন নিলাভ কাকু? হয়তো সেটাই জিজ্ঞেস করতাম, কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই কাকু চোখগুলো বড় বড় করে আমার কিছুটা কাছে সরে এসে বলতে শুরু করলেন, ‘ পাড়া প্রতিবেশিরা বলে, সন্ধ্যার পর মাঠ পেরিয়ে মন্দিরের কাছটায় গেলে গা নাকি ছমছম করে ওঠে…পেছন থেকে কার নিঃশ্বাস গায়ে এসে পড়ে…মন্দিরের এ দেওয়াল সে দেওয়ালে কার যেন আস্ত ছায়া ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় …কীর্তন ঘরের অন্ধকারের ভেতর থেকে ক্ষীণ সুরে খঞ্জনীর আওয়াজ, ধূনোর গন্ধ এসবও পাওয়া গেছে কতদিন..! যা যা বললাম, এগুলো মহারাজ চলে যাবার পরেকার ঘটনা। যতদিন নীলকান্ত ছিল, পুজো-আচ্চা যা যেটুকু করার সে নিজেই করতো। সেও পাততাড়ি গোটালো, তারপর থেকেই ঐসব ভুতুড়ে ব্যাপার…! বেশ কয়েকমাস আগে কোন এক জোগাড়ে গোছের লোককে ঠিক করা হয়েছিল মন্দিরের আনাচে-কানাচে জুড়ে সব জংলা, আগাছা পরিষ্কারের জন্য, সন্ধ্যায় তাকে দোতলার সিঁড়ির কাছে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়…জ্ঞান ফেরার পরও কিরকম একটা ট্রমা কাজ করছিল তার ভেতরে..দোতলার বারান্দায় খড়ম পায়ে হাঁটাচলার আওয়াজ শুনে সে সচকিত হয়ে ওঠে…আপাদমস্তক সাদা উলের চাদরে ঢাকা কোন এক ছায়ামূর্তিকে নাকি এক পা এক পা করে নেমে আসতে দ্যাখে…আমি তো আর নিজে ভেতরে ঢুকি নি, ঐ লোকটির কথা পাড়া প্রতিবেশির মাধ্যমে যেটুকু কানে এসেছে….’
‘ কত লোকে কত বদ মতলবেও তো এসব করতে পারে। সন্ধ্যা রাতে ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে আতঙ্ক ছড়ানো..এরকম হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এসব ঘটনা বা রটনা ছড়ায় বেশি, মানুষের মনে প্রভাবও ফেলে বেশি। এমন সুযোগ কাজে লাগানোর মতো লোকজনের তো আর অভাব নেই পৃথিবীতে.. ‘
নিজস্ব বোধবুদ্ধিতে যতটুকু আসে, সেই সীমানার মধ্যে দাঁড়িয়েই হয়তো কথাগুলো বললাম। যা জানি না, যা দেখিনি..শুধু মাত্র কোনো এক জন লোকমুখে শুনে তার প্রতি আস্থা জন্মানোর মতো যৌক্তিকতা এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাই নি, তাই হয়তো…।
আমার দিকে কিরকম যেন চোখ করে নীলাভ কাকু তাকালেন। মনে হলো আমার ভেতরের মানুষটাকে একবার যেন পড়ে নিলেন তিনি।
‘ চুরিচামারির কথা বলছো? অত বড় লোহার গেট, অত উঁচু পাঁচিল…তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই…এতগুলো দিন পেরিয়ে গেল, কৃষ্ণরাজের গা ভর্তি ঐ ভারী ভারী সোনার গয়না..সেসব অবিকৃত থাকে কি করে? এই তো শুনলাম নাকি সেদিন সকালে মন্দির কমিটির কয়েকজন লোক কি একটা দরকারে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দ্যাখে ঠাকুরের গায়ের গয়নাপত্তর যেমনকারটা ছিল ঠিক তেমনি। একটা ছোট্ট পাথরও এদিক ওদিক হয় নি। কেন জানো? অভিশাপের ভয়ে। যে ওতে হাত বাড়াতে যাবে সে ই ছারখার হবে। জীবনে চরম বিপর্যয় নিশ্চিত। এ স্বপ্নাদেশ আমাদের ঠাকুর মশাই পেয়েছিলেন বহুবছর আগে। আমার তখন মন্দিরে নিত্য যাতায়াত। আর এখন, সে মন্দির নিজেই ইতিহাস হয়ে গেছে। খবর হলে সে খবর চাপা থাকে না। ঠিক মাটি ফুঁড়ে বেরোবেই…’
বলতে বলতে এক পা এক পা করে এগিয়ে যান নীলাভ কাকু, উল্টোমুখো একটা পুরোনো কাঠের দেরাজের সোজাসুজি জানলার পাশে দেওয়ালের কোণের দিকে। সেখানে একটা নকশা করা শ্বেতপাথরের সিংহাসন রাখা। যে সিংহাসনে অন্য কোনো দেবতা নয়। আছে শুধু কালো কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো রামঠাকুরের একটি ছবি, যে ছবিটা এর আগে আমার নজরে পড়ে নি। ঠিক এরকমই একটা ছবি আমাদের বাড়ির সিংহাসনেও রাখা রয়েছে। জটাধারী,পরণে গেরুয়া বসন, চেয়ারে উপবিষ্ট, বড় বড় উজ্জ্বল চোখ, মুখে প্রশান্তির হাসি কিংবা তারই ছায়া। আমার চোখে ছবিখানা অবশ্য আরো পুরোনো। সেই পঁচিশ ত্রিশ বছর আগে যখন মা, কাকিমাদের সঙ্গে মন্দিরে যেতাম তখনকার ঠাকুরমশাইয়ের চেহারাটাই যেন বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। ছবির সামনে ধূপকাঠি ধরাচ্ছেন নীলাভ কাকু। ধোঁয়ার কুন্ডলির মতো পাক খেতে খেতে ক্রমশই একটা গন্ধ যেন কাছে আসতে শুরু করেছে আমার…ভীষণ কাছে। কেমন একটা অগুরুর গন্ধ। কিন্তু তার থেকেও আশ্চর্যের, গন্ধটা যেন আমার খুব চেনা। অনেককালের চেনা! জীবনের কোনো এক গভীর, সূক্ষ স্তরে যে ছাপটুকু আজও রয়ে গেছে। বহু যুগ আগের হারিয়ে যাওয়া একটা ছবি। দাদু মারা গেছেন। সে মুখ আজ বড় আবছা। আশপাশের ছবি তো আরো আবছা। দাদুর মৃতদেহ উঠানে শায়িত। হাওয়ায় ছড়ানো অগুরুর গন্ধ…।
স্মৃতি নয়। এ যেন স্মৃতির আঘ্রাণ… এতটাই স্পষ্ট!
পুড়তে থাকা একটা ধূপকাঠি চল্লিশ বছর আগে মৃত মানুষের দেহের গন্ধের সঙ্গে কি করে এমনভাবে সংপৃক্ত হয়ে যায় , তা যেন ঐ ধোঁয়ার মতোই অস্পষ্ট আমার কাছে। হতে পারে, এই ধরনের গন্ধ সচারাচর পাওয়া যায় না। পেলেও হাওয়ায় বিলীন হয়ে যায়। জীবনে মৃত্যু কম দেখিনি। প্রতিটি মৃত্যুর আলাদা আলাদা গন্ধ। আলাদা আলাদা অনুভব। সময়ের নিয়মে একদিন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে সেসব নিজে নিজেই। এ ও হয়তো সেরকমই কোনো এক ক্ষনিকের মনে হওয়া। একটু পরে কোথায় বিলীন হয়ে যাবে ধূপের পোড়া ছাইটুকুর মতো!
চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়ে একটু হেসে নীলাভ কাকু বললেন, ‘আমার এই গন্ধটা ভারী পছন্দের! একজন বাড়িতে আসে বিক্রি করতে…এমন গন্ধ সচরাচর …’
ধোঁয়ার বেশিরভাগটা জানলা দিয়ে অন্ধকারে মিশে যাচ্ছিল। যেটুকু পড়ে রইলো সেটুকুই নির্যাস। জানি না এ কিসের নির্যাস। কিন্তু এই মূহুর্তে আরো অনেক প্রশ্ন, আরো অনেক জিগ্যাসা ধূপের ধোঁয়ার মতোই যেন ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে আমার চারিপাশে। যে কাজ নিয়ে এসেছি তা মোটামুটি সারা হয়ে গিয়েছে। তবু মন চাইছে আরও একটু বসি। থাকি না আর একটু বসে।
আমার ভেতরকার ইচ্ছেটাকে যেন খানিকটা আঁচ করে নীলাভ কাকু বললেন, ‘ তা যে কথা হচ্ছিল..শেষটা শুনবে তো? নাকি বাড়ি চলে যাবে? তবে তোমার যে এ বিষয়ে আগ্রহ আছে তা অবিশ্যি আমি আগেই টের পেয়েছি। যার আগ্রহ রয়েছে তাকে আমি ফেরাই না। সেও আমায় ফেরায় না।’
ভুরু কুঁচকে বলি, ‘ ফেরায় না মানে?’
‘ মানে মন্দির নিয়ে কথা উঠলে যারা জানে না, শুরুতে এসব কাহিনী হয়তো বা বিশ্বাস করতে চায় না। ভাবে গপ্প আওড়াচ্ছি। বুড়ো বয়সে সময় কাটানোর ফন্দিফিকির। তারপর শুনতে শুনতে এমন বিশ্বাসের গর্তে পড়ে যায় যেখান থেকে বেরিয়ে আসা বেজায় মুশকিল! এই ধূপকাঠিটার মতো। এর গন্ধ যে একবার পেয়েছে সে ঠিক খুঁজে বেড়াবে। হয় আমাকে, নয় ঐ ধূপকাঠিওয়ালাকে।’
চাপা হেসে বললেন নীলাভ কাকু। বাল্বের আলো তাঁর হাইপাওয়ারের লেন্সের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে চোখদুটোকে অস্পষ্ট করে তুলেছে। মানুষের বিশ্বাস, ধূপের গন্ধ এরা প্রত্যেকেই জীবনের ভিন্ন ভিন্ন স্তর থেকে উঠে এসে যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছিল এই মূহুর্তে..মন্দিরের ইঁট, পাথর, ধূলিকণায়। সেখানে প্রশ্ন নেই, আছে শুধু গল্পের মতো শুনে যাওয়া। প্রশ্ন যেখানে, যত কুয়াশাচ্ছন্নতা যে সেখানেই।ঠাকুরমশাইয়ের ছবির চারপাশ ঘিরে ধূপকাঠির ধোঁয়াগুলো ঠিক যেন সেরকমই কোনো এক ভাসমান,, এলোমেলো, কুয়াশাস্তীর্ণ ভাবজগতে একাকার হয়ে যাচ্ছিল বলে মনে হলো আমার।
নীলাভ কাকু বলে চলেন,
‘ গয়নাগাটি বাদ দিলে মন্দিরের অবশিষ্ট দেবত্র সম্পত্তি, টাকাপয়সা..ওসব জিনিস কি আর পড়ে থাকার? বোর্ড কমিটির জিম্মায় চলে গিয়েছে কবে! ট্রাস্টি বোর্ড সেগুলো আগলে রেখেছে না কি হাপিস করেছে তা আমার জানার কথা নয়। জানতে চাইও না। বাদবাকি যা পড়ে আছে, তা নিতে চোর আসবে না। অনুমান নয়। উপলব্ধি। নীলাভ স্যান্নালের ছিয়াত্তরের উপলব্ধি। অনেককাল যাও নি মন্দিরে, বোঝাই যাচ্ছে। দিনমানে খোলা থাকলে ভেতরটা একবার গিয়ে দেখে এসো। অবশ্য দিনে কিছু নেই। সব স্বাভাবিক। মৃত্যুর মতো। রাতের দিকে যদি কখনো সুযোগ পাও…। লোকমুখে শুনি, যত ভয় ঐ ঝুপসি অন্ধকারটা নামলেই…! মহারাজের অন্তর্ধান…তোমার, আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিনশেষে ঐ একটাই বিন্দুতে এসে ঠেকবে। যত ভাববে অন্ধকার তত গাঢ় হবে..ততই ভয় আর আতঙ্ক… রহস্যের কালো ছায়া… একবার এ দেওয়াল, একবার সে দেওয়াল, একবার এ ঘর একবার ও ঘর…’
অন্ধকার ঘনিয়ে আসে চারিধারে। কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায় চূড়াদুটো। অনেক আগে ছোটোবেলায় মনে আছে বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে সন্ধ্যা রাতে চূড়াগুলোর শীর্ষদেশে বাতি জ্বলতে দেখতাম। আকাশ প্রদীপের মতো জ্বলজ্বল করতো আলোগুলো। সে আলো কতদিন হলো জ্বলে না কে জানে! নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। নিস্তব্ধতার আড়ালে ঝুপ করে কখন অন্ধকার নেমে আসে টের পাওয়া যায় না। বাতাসে হালকা শনশন শব্দ। চাঁদ ওঠে নি দেখছি। অমাবস্যা নাকি? হবে হয়তো। চতুর্দিক দেখতে দেখতে হঠাৎই কিরকম একটা ইচ্ছে জেগে উঠলো মনের ভেতর….এই অন্ধকারে একবার মন্দিরে গেলে কেমন হয়? গিয়ে দেখবো নাকি? দেখবো একবার? এটাই যে উপযুক্ত সময়। জীবনে কোনোদিন ভূতপ্রেত বিশ্বাস করিনি। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলতে, তাদের সেই নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে বড্ড যে মন চাইছে আজ! এতদূর এলামই যখন, ফেরার পথে একবার সরেজমিনে দেখে যাই না পরিস্থিতিটা। এ সময়টা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না কোনোমতেই!
মাথায় যেন সত্যি সত্যি কি একটা ভূত চেপে বসতে শুরু করেছে…! কিছুতেই বাগ মানানো যাচ্ছে না ইচ্ছেটাকে…!
শব্দটা যেন ঘুরপাক খাচ্ছে ভেতরে…’ জীবন্ত অশরীরী… ‘
দেওয়াল থেকে ঘরের কোণ, কোণ থেকে আনাচে কানাচে…এ এমন এক চলাচল, যার শুরু আছে…শেষ কোথায় সত্যিই বোধহয় জানা নেই…দেবালয়, পোড়ো মন্দির, ভূতূড়ে বাড়ি যাই বলি না কেন, সে রহস্যময়তার সবটুকু জুড়ে যেন অন্য আর এক ইতিহাস নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে আমার অন্তর্জগতের শিরায় উপশিরায়…অদ্ভুত এক মনোজগতে কে যেন প্রাণপণ টেনে নিয়ে চলেছে আমায়…বাড়িঘর, বিষয় আশয়, সম্পত্তি…এ আজ আছে কাল নেই…দেহের সাথে সাথে কোথায় বিলীন হয়ে যাবে কেউ জানে না…সংসারে অন্তঃসার বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তার সবটুকু নির্যাস লুকিয়ে রয়েছে নির্মোহ জীবনের স্তরে স্তরে সঞ্চিত অব্যক্ত নীরবতার মাঝে। এতদূর এসেও নীলকান্ত মহারাজের অন্তর্ধান রহস্যের কিছুটা হদিশও যদি করে উঠতে না পারি…কি জানি, মুহূর্ত গুলো হয়তো সারারাত স্বপ্নে ভেসে ভেসে উঠবে…ঠিক থাকতে দেবে না আমায়!
আর যাই হোক, জীবনকে অন্তঃসারশূন্য হতে দেবো না আমি, কিছুতেই না…
‘ মন্দিরের দরজা কি সবসময়েই বন্ধ থাকে? ‘
কথাটা যেন স্প্রিংয়ের মতো দৌড়ে এলো মুখ থেকে।
কালো পুরু লেন্সের চশমার ফাঁক দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন নিলাভ কাকু, যেন আমার ভেতরটা পরখ করে নিচ্ছেন এমনই চোখের চাহনি…
‘ একবার যাবে নাকি? লোকের মুখের কথা না শুনে সরেজমিনে নিজে গিয়ে… হা হা হা…!’
পান খাওয়া দাঁতগুলো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসে ভদ্রলোকের। অকস্মাৎ তাঁর এই ভাবান্তরের কারণ আমি বুঝতে পারলাম না।
‘ আপনি হাসছেন কেন?’
‘ হাসবো না? ভূত দেখতেও লোকে মন্দিরে যায় তাহলে? এই অমাবস্যার রাত, ঝোপ ঝাড়ে ঢাকা আঁধার ঘেরা মাঠ, তারই মাঝে পোড়ো মন্দির….একদিন লোকে যেত দেব দর্শনে, আজ কেউ যায় ছায়া দেখতে, কেউ বা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে…’
‘ পাপের প্রায়শ্চিত্ত? ‘
মুখভঙ্গি কিরকম যেন আশ্চর্য ভাবে পালটে যেতে থাকে নিলাভ কাকুর! সাদা চুল, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, কপালের বলিরেখা, ঘোলাটে চোখের চাহনি…সবকিছুর আড়ালে চেনা মানুষটা ক্রমশ যেন অদ্ভুত অচেনা হয়ে উঠতে শুরু করেছে আমার কাছে…! এক পা এক পা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন ভদ্রলোক। ফিসফিসিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘ জীবনে কম পাপ করিনি..আইনজ্ঞ হয়েও বেআইনি ভাবে রন্ধ্র পথে মন্দির হস্তগত করবার ছক কষেছিলুম, ক্যাশবাক্সের প্রনামীর টাকা হাতানো, শিষ্যদের অনুদানের পয়সা চুরী…সেসবের শাস্তি যাবে কোথায়? যে জন্য তোমার বাবার মতো আরো অনেকেই শেষের দিকে এড়িয়ে চলতো আমায়। একটা সময় যতই আইনের ফাঁক গলে বেঁচে যাই না কেন, মন…মন বলে তো একটা বস্তু আছে…বয়স বলেও বস্তু আছে। রোজ রাত্তিরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর একবার করে তাই মন্দিরে যাই, কি করতে জানো? অনুশোচনা করতে। চুপ! একথা কাউকে বোলো না যেন! এই তোমাকেই বলে গেলাম। ভূত দেখবে,তাই তো? মিছামিছি অদ্দূর যাওয়া কেন…এই তো, যে চৌকিতে বসে আছো, এখান থেকে মোটে হাত কয়েক এগোলেই….মনে করো না আয়নায় যাকে দেখছো, আসলে সে-ই মন্দিরের ছায়া, দোতলার বারান্দায় পায়ের আওয়াজ, ঘাড়ের কাছে ফেলা নিঃশ্বাস…!’
‘ মা মা মা মানে?’
এগিয়ে আসছে মানুষটা, কাছে…আরো কাছে…আপাদমস্তক সাদা চাদরে ঢাকা, শুধু শীর্ণকায় মুখটুকু ছাড়া। ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি এখনো একচুলও সরে নি আমার দিক থেকে….একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে আগের সেই চেনা মুখটাও….!
‘ কে? কে আপনি?’
কথাটা যেন বুক চিরে বেরিয়ে এলো আর ঠিক তক্ষুনি
আচমকা কারেন্টটা চলে গেল, সেই সঙ্গে নিকষ কালো অন্ধকার বিদীর্ণ করে এক প্রবল অট্টহাসিতে যেন ফেটে পড়লো ঘরের চারিদিক….!
‘ কেন তোমার নীলাভ কাকু! ভুলে গেলে? ধূপের এই গন্ধ যে একবার পায় সে সহসা ভোলে না। এ হলো মৃত্যুর গন্ধ! কার মৃত্যু জানো?’
কে একটা ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে আমার, হাসির সাথে এক অদ্ভুত হিসহিস শব্দ সর্বাঙ্গে যেন বিদ্যুতের শিহরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে….
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে আন্দাজে দৌড়ে দরজাটা খুঁজতে যাবো, একটা কিসের পায়ার সঙ্গে বেধে সজোরে আছড়ে গিয়ে পড়লাম….
ঘুমটা ভেঙে গেল সাথে সাথে। জানলার কাঁচের ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়েছে। আমার বুকের ওপর খবরের কাগজটা এখনো সেভাবেই রাখা। কাল রাতে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাঝের পৃষ্ঠার কোণের দিকে লেখাগুলো আরো একবার চোখে ভেসে উঠলো…খবরটা গতকালকের। ঘটনাটা গত পরশুর।
…..’ কাঁচরাপাড়ার নকড়ি মন্ডল রোডে পরমারাধ্য শ্রী শ্রী ভবানি চরণ বাবার মন্দিরের দোতলার সিঁড়ির কোণায় নিলাভ চরণ বিশ্বাস নামে এক বৃদ্ধের গভীর রাতে রহস্যজনক মৃত্যু…প্রসঙ্গত, ভবানি বাবার প্রয়ানের পর প্রায় দশ বছর সে মন্দিরে পুজো আচ্চা, লোক যাতায়াত আর তেমন একটা হত না বললেই চলে…বছর কয়েক আগে মন্দিরের প্রধান সেবায়েত শ্রী নীলকান্ত মহারাজের অকস্মাৎ অন্তর্ধানের পর থেকে সে মন্দির পরিত্যক্ত প্রায় অবস্থাতেই ছিল বলে জানা গেছে….অবসরপ্রাপ্ত আইনগ্য নিলাভ বাবু গভীর রাতে ঠিক কি কারণে ঐ মন্দিরে গিয়েছিলেন তা যতটা রহস্যময়, ঠিক একই ভাবে সিঁড়ির একপাশে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহে কোনো ক্ষত বা আঘাতের চিহ্ন না পাওয়া গেলেও দোতলার বারান্দার রেলিঙের দিকে নিবদ্ধ তাঁর স্থির বিস্ফারিত দু চোখের মণি, এক ভয়ংকর এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুকেই ঈঙ্গিত করছে বলে সূত্রের অনুমান…স্থানীয় পুলিশ থানা এই ঘটনার তদন্তভার হাতে নিয়েছে…’
ছোটোবেলার বুড়ো দাদুর মন্দির জীবনের আর এক প্রান্তে এসে এইভাবে একদিন চোখের সামনে ভেসে উঠবে, ভাবতেই পারিনি!!