সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ২০)

ক্ষণিক বসন্ত

সাগর

নয় নয় করে প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল। সাগর এখন গুরুজির ঘরেই থাকে। তবে একাএকাই থাকে। হোমশিখা ম্যাডাম মুম্বাই চলে যাবার আগে সাগরকে গুরুজির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে গিয়েছে। তবে প্রাথমিক পরিচয় পর্ব নেহাতই সহজভাবে সম্পন্ন হয়নি। গুরুজি সঙ্গীতজ্ঞ তুখারিরাম শিস্ত্রী পুরনো দিনের মানুষ। সঙ্গীতে নিবেদিত প্রাণ। পাকা জহুরি। হীরে চিনে নেবার আগে ভালো করে যাচাই করে নেওয়া তার চিরকালের অভ্যাস। সাগরকে কড়া পরীক্ষা দিতে হল। একের পর এক রাগ গায়কির প্রবেশক পেরোতে হল নিষ্ঠা সহকারে। প্রথমদিকে গুরুজির মনোযোগ আদায় করা সহজ হল না সাগরের। হোমশিখার প্রতি তার অভিমান প্রতিফলিত হচ্ছিল সাগরের প্রতি। তারপর হঠাৎই সাগরের একটি ঠুমরী কীর্তনে তার দুই চোখে জল চলে এল।
-কিতনা উমার বোলা আপনে আপকা বেটা?
-বারো।
-বাহ। অদ্ভুত সুন্দর।
হোমশিখাকে ক্ষমা করে দিলেন তুখারিরাম। সাগরকে ছয় মাস তালিম দিতে রাজি হলেন গুরুজি। কিন্তু সেটুকুও নিঃশর্তে নয়। সাগরকে গুরুর গৃহে শিক্ষা নিতে গেলে কয়েকটি নিয়ম মানতে হবে। প্রথম। বাবা মাকে চলে যেতে হবে ঘরে। পড়ালেখা খাওয়াদাওয়া ও গানবাজনার সমস্ত দায়িত্ব এই ছয় মাসের জন্য তাঁর। দ্বিতীয় শর্ত। সঙ্গীত শিক্ষার জন্য কোনও অর্থ নেবেন না তিনি। কিন্তু তার অনুমতি ছাড়া এই কটা দিন কোথাও কোনও অনুষ্ঠান করতে পারবে না সাগর। আর তৃতীয় সবচেয়ে ভয়াবহ শর্ত। গুরুজি যখন যা বলবেন, সাগরকে সে আদেশ পালন করে চলতে হবে। না বলা চলবে না। সে যতো কঠিন কাজই হোক না কেন।
গুরুজির ঘরে আর সদস্য বলতে তাঁর স্ত্রী শোভাবরী আর তুখারিরামের একমাত্র কন্যা দীপরঞ্জনী। দীপরঞ্জনী গেল ফাগুন মাসে পনেরোতে পা দিল। প্রথম দিন থেকেই সাগরকে তার বেশ ভালো লেগে গেছে। এই হালিশহরের দুই তলা বাড়ির একতলায় কিছু নির্দিষ্ট ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে গুরুজি ক্লাস নেন। দোতলায় তারা থাকে। স্কুলে তার তেমন বন্ধু নেই। বাবা বন্ধুদের সঙ্গে তেমন মেলামেশা পছন্ধমদ করে না। ফলত ঘরির ভিতর অন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও তার তেমন মিলভাও ছিল না। সাগর আসতে দীপরঞ্জনী একজন কথা বলবার লোক পেয়ে গেল বেশ। অবশ্য তুখারিরামের স্ত্রী শোভাবরীরও সাগরকে বেশ লেগেছে। ছেলেটির চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় তার ভিতরে সঙ্গীতের প্রতি মেধা আছে। তুখারিরামের শাসনে সাগর যখন ভেঙে পড়ে কদাচিত তখন শোভাবরী হয়ে ওঠেন তার মা। আহা। বাপ মা চলে এসেছে ছোট্ট ছেলেটা। কতোই বা বয়স। এতোটা ত্যাগ না থাকলে বুঝি প্রাপ্তি ঘটে না কারও।
সারাদিন গুরুজির নানান হুকুম তলব করতে কেটে যায় সাগরের। স্কুল যাতে অনলাইনে করা যায় তেমন ব্যবস্থা করে গেছে হোমশিখা ম্যাডাম। কিন্তু স্কুল নয়। সাগরের জীবনে এখন সুরসাধনাই অগ্রভাগ অধিকার করে নিয়েছে। কখনও গুরুজি আদেশ করেন বাগান থেকে পুজোর জন্য শিউলিফুল তুলে আনতে। সাগর সে আদেশ পালন করে। কখনও বা তুখারিরাম বলেন।’যা বেটা। নদী ঘাট থেকে পানি লিয়ে আয়।’ সাগরকে সাহায্য করে দেয় দীপরঞ্জনী। দুজনে মিলে নদীগাট থেকে জল নিয়ে আসে। এমনই চলতে থাকে। এরই ভিতর সাগর বেশ শিখে ফেলে ‘দাদরা’ শব্দ এসেছে ‘দাদুর’ শব্দ থেকে। দাদুর শব্দের অর্থ ব্যাঙ। কারণ এই তাল ব্যাঙির মতোই লাফিয়ে চলে। শিখে ফেলে ঠুমরীকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার রূপকার লখনৌ থেকে নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর সঙ্গীত জগতের ছদ্মনাম অখতর পিয়া। সে ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছে ‘সুরেন বাঈজি’ আসলে প্রখ্যাত ঠুমরীশিল্পী সুরেন্দ্রনাথ দাস। কাজের ফাঁকে এইভাবেই ধীরে ধীরে মখমলী সুতাবাহার আলোয়ানের মতো তিলতিল করে সাগরকে গড়ে তোলে তুখারাম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রেয়াজে বসতে হয় তাকে। হারমোনিয়ামে এইবয়সেই বেশ সড়গড় হয়ে উঠেছে সাগর। গুরুজি কখনও কখনও চোখ বন্ধ করে শোনেন তার গান। কখনও বা উঠে চলে যান রেগেমেগে। অযাচিত হরকত তার পছন্দ হয় না। কখনও দীপরঞ্জনী আর সাগরকে বসিয়ে তিনি ক্লাস নেন। সেখানে তুখারাম বলেন।
-গায়কীর সময় গলা যতো মিঠাস ভরা হবে, গান ততো শারতিগ্রাহ্য হয়ে উঠবে। ভাও নয়। লচাও দিয়ে জয় করে নিতে হবে শ্রোতাদের মন।
হালিশহরের রাস্তাগুলো নবদ্বীপের মতো সরু সরু নয়। পাশেই গঙ্গার ঘাট। সাধক রামপ্রসাদের বাড়ি। সেখানে ভক্তরা হেঁটে, টোটো করে, গাড়ি করে আসে রোজ। গুরুজির নানান হুকুম তামিল আর সঙ্গীত শিক্ষার মাঝেমাঝে সাগর এইসব দেখতে থাকে। নবদ্বীপের দৈন স্তব্ধতা এখানে নেই। পাশেই বড় বড় চটকল বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ওসব জায়গা ভালো না। গুরুমা বলেছেন। বিকেলের পর গুরুজির দরজায় তালা পড়ে যায়। খোলে ফের ভোরে। রাতে ভিডিওতে বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলে সে। কখনও সারা দিনের কাজের কথা বলতে থাকে তাদের। কখনও তাদের সারাদিন ধরে মিস করার ফলস্বরূপ মোবাইল পর্দার দুইদিকের বক্তা শ্রোতার চোখজুড়ে অঝোরধারায় জল নেবে আসে। এভাবেই কাটতে থাকে দিন। সাগরের মনে হয়, সে যেন কোনও এক দ্রাপর যুগের আশ্রমে গুরুবন্দী হয়ে আছে। ঠিক যেমন ছবিতে মহাভারত পড়তে গিয়ে বইয়ের পাতায় দেখেছিল সে।
সাগরের অনন্য মেধার কথা গোপন থাকে না। আজকাল সে চটজলদি উত্তর দিয়ে ফেলে ক্লাসে। গুরুজি ধীরেধীরে তাকে আর দীপরঞ্জনীকে নিয়েই আজকাল সকলের সঙ্গে ক্লাস করছে। এতে খানিক গলার বিশ্রামও হচ্ছে তার। ক্লাসে গুরুজি জিজ্ঞেস করলেন।
-ঠুমরীগানের ‘বোলবনাব’ কে প্রথম প্রচলিত করল কে বলতে পারবে?
সাগর হাত তুলে বলে দেয়,”গণপত রাও আর মঈজুদ্দিন খান”।
তুখারামের মুখেচোখে তৃপ্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে। ফের তিনি প্রশ্ন করেন।
-ঋতুর সঙ্গে কোন কোন গান গাওয়া চলবে?
সাগর আবার হাত তুলে উত্তর দিতে থাকে।
-কাজরী ,সাবনী আর ঝুলা বর্ষা ঋতুতে। ফাগ আর হোলি বসন্ত ঋতু আর চৈতী, ঘাটো চৈত্র মাসে গাওয়া হয়।
গুরুজি ‘বেশ।বেটা’ বলে পিঠ চাপড়ে দেন সাগরের। মনে মনে বুঝতে পারেন তুখারাম। সাগর তার শিক্ষার প্রথম ধাপ পেরিয়ে গেছে। এইবারের ধাপ আরও খানিকটা কঠিন। রাতে শোভাবরী খানিকটা আদা যুক্ত গরম জল করে দেন তুখারামের জন্য। সেই গ্লাস তার ঘর অবধি পৌছে দেবার দায়িত্ব সাগরের। সাগর রাতে সেই জল পৌছে দিতে গেলে গুরুজি তাকে ডেকে পাশে বসতে বললেন। তারপর তার মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন।
-এইবার আরও কঠিন রেয়াজে যেতে হবে বেটা। পারবি তো?
সাগর মাথা নেড়ে জানায়। সে পারবে।
-সারা দিনে আর কোনও কাম করতে হবে না তোকে। শুধু একটাই তান দেব আমি। সারাদিন ওই তান তৈরি করে রাতে শোনাতে হবে। তাহলে পরের তান। আর না পারলে খানাবন্ধ। রাজি?
এ কেমন নিয়ম কে জানে! কিন্তু সাগর মুখে বলে না কিছু। রাজি হয়ে যায়।পরদিন সকালে তুখারিরাম তাকে খেয়ালভাঙা একটি তানকারি তুলে দিলেন। দীপরঞ্জনীর স্কুল ছিল। সে বাবার এই কঠিন তালিমের কথা হাড়েহাড়ে জানে। এপথ কঠিন বন্ধুর পথ। তার বুকের ভিতর ঢিবঢিব করতে থাকে। তুখারিরাম সাগরকে একটা কাগজে লিখে দিলেন তান।
-গা বেটা। সরগম রমপধমপ নসঁ পধমগ সরগসন্ স।
সারাদিন গুণগুণে কেটে যায় সাগরের। শরীরটা ঝিমঝিম করে। মাথার ভিতর দপদপ করতে থাকে। গুরুমা দুপুরের খাবার দিতে এসে দেখেন দোতলার তক্তপোশে ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে। কপালে হাত ছোঁয়াতেই চমকে ওঠেন তিনি। সাগরের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সর্বনাশ। এখনই তার বাবা মাকে খবর দেওয়া উচিত। চারপাশে খারাপ খারাপ অসুখের অভাব নেই। তুখারাম কে বলতেই তিনি তার বাহারি কাঠের হোমিওপ্যাথি বাক্স বের করে একটা কাঁচের শিশি শোভাবরীর হাতে দিয়ে দিল। দুই ফোঁটা দু ঘন্টা অন্তর খাইয়ে দিতে হবে। শোভাবরী দেখল সাগরের অসুস্থতায় তার স্বামী খুব বেশি বিচলিত হলেন না। কেমন তালিম এ? সে যে অতো সাধনার মানে বোঝে না! তার তো মায়ের মন। দুশ্চিন্তা হতে থাকে তার। নবদ্বীপে সাগরের বাবিমায়ের ফোন নম্বর তার কাছে নেই। ঘরে গিয়ে সাগরকে ওষুধ দিতে গিয়ে সে দেখল জ্বরের ঘোরের ভিতর ছেলেটা অচৈতন্য হয়ে গুণগুণ করছে,” সরগস রমপধমপ…”

রাতে তানকারি গুরুজির কাছে পেশ করতে পারল না সাগর। খাওয়াও হল না তার। ঘোরের ভিতর সাগরের মনে হল একটিই ঘড়ির কাঁটা নিরলসভাবে তার কাছে এক অপ্রতিরোধ্য চক্রর মতো ঘুরে চলেছে। ‘সরগস রমপধমপ…’।পরদিন সকালে গুরুজি ডাক পাঠালেন। তান গাইতে গিয়ে দু জায়গায় গলা নড়ে গেল তার। তুখারিরাম রেগে মেগে গানের ডায়রি ছুঁড়ে মারলেন সাগরকে।
-হয়নি। কুছু হয়নি। আজ সব বন্ধ। খানা পিনা সব। পেহলে তান। তারপর সব।
দীপরঞ্জনী আর শোভাবরী তুখারিরামের আচরণে শিউরে ওঠে। গোপনে দীপরঞ্জনী সাগরকে সাহায্য করে দেয়। ধীরে ধীরে সাগর দেখল স্বরগুলো তার হৃদস্পন্দনের মতো অনায়াসসিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আলাদা করে স্মরণ করতে হচ্ছে না কিছু। শরীরের দুর্বলতা কেটে যাচ্ছে স্বরগ্রামের উত্থান আর পতনে। ঝর্ণার কলকল ধারার মতো নেমে আসছে পালটা। সন্ধ্যা নামে। গুরুজির ঘরে অবশেষে দাঁড়ায় সে।গুরুজি মন দিয়ে শোনেন। চোখ বন্ধ করে সাগরের তান আর পালটা শুনতে শুনতে তার মনে হয় তিনি যেন কোনও মহাসমুদ্রের উপতটে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই তটের উপর সমুদ্রলহরী বারবার এসে মিলিয়ে যাচ্ছে। ফের আসছে। ফের মিলিয়ে যাচ্ছে। শেষে সজল চোখে সাগরকে কাছে আসতে বলেন তিনি।
-বসো বেটা।
সাগর তক্তপোশে গুরুজির পায়ের কাছে বসতে গুরুজি তার দুই কাঁধে হাত রেখে তাকে তার পাশে বসতে বলেন। তারপর নিজের বাম পায়ের গোড়ালির কাছ থেকে পোশাক সরিয়ে সাগরকে দেখান।
-সঙ্গীতসাধনার পথ সহজ হয় না বেটা। এ বড় কঠিন পথ। ধৈর্য লাগে। লাগাও লাগে। আর লাগে গুরুমুখী শিক্ষা।
সাগর দেখতে পায় গুরুজির পায়ের খানিকটা উপরে একটা গভীর ক্ষত। শুকিয়ে গেলেও জায়গাটা বেশ খানিকটা গর্ত হয়ে গেছে। বেশ বোঝা যায় যে এই ক্ষত বহু দিন আগের।
-তোমার মতো বয়সেই আমার গুরুজির কাছে গিয়েছিলাম আমি। একদিন খম্বাজের একটা তানকারি দিলেন তৈরি করতে। তিনদিন সময়। এদিকে তখন গ্রামে টাইফয়েড হচ্ছে মহামারীর মতো। মার শরীর ভালো নেই। বাবা কাজের সূত্রে শহরের বাইরে। গুরুজিকে নিখুঁত তানকারি দিতে পারিনি সময় মতো। গুরুজি পুজোর জন্য একটা ছোট দা দিয়ে নারকেল কাটছিলেন। আমার নড়ে যাওয়া সুর তার শ্রুতি স্পর্শ করতেই তিনি হঠাৎ তার দা টা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। দা টা আমার বাম পায়ে লেগে গেঁথে গেল। এই ঘটনার পর সারাজীবন গুরুজি আমার কাছে অনুতাপ করেছে। কিন্তু আমি ওই তানকারিটা আজও মনে রেখেছি। হুবহু।
সাগর প্রণাম করে তুখারিরামকে। তুখারিরাম বলে চলেন।
-কাল থেকে একটা গান শিখাব তোকে। ঠিক দেড় মাস বাদে শো। মস্ত শো। অনেক বড় বড় লোক থাকবে সেখানে। এই কদিন আর কোনও চিন্তা নয়। শুধু ওই গানটা। দিখা দে সাগর জগ কো। তু চিজ ক্যা হ্যায়।

‘বন্দিশ ফাইট’ এর প্রতিযোগিতা বেশ জমে উঠেছে। নিয়মিত তালিমের পর প্রাথমিক স্তরে জড়তা এখন আর নেই। গ্র্যাণ্ড ফিনালেতে অতিথি বিচারক হিসেবে ডাকা হল হোমশিখাকে। পাঁচজন ফাইনালিস্ট। পাঁচজনই সমান দক্ষ গায়ক। সেই পাঁচজনের একজন কুন্তল। যমুনাঘাটা থেকে তার এই কলকাতা বিজয়ের কাহিনী এখন মানুষের মুখে মুখে। ফিনালের আগের সপ্তাহে উদ্যোক্তারা ফ্লায়ারে জানিয়ে দিল। শনি রবিবারের ওই মেগা এপিসোডে এইবার থাকছে বাড়তি চমক। কী সেই চমক কেউ জানে না। প্রডিউসর খুশিতে ডগমগ। বিজ্ঞাপনের সব কটি কোটা ভর্তি হয়ে গেছে। শনিবার ঠিক আটটায় চ্যানেলজুড়ে শুরু হল ‘বন্দিশ ফাইট’ এর অন্তিম যুদ্ধ। কে হবে সুরশ্রেষ্ঠ? আগামী একবছর গ্রামে শহরে বিজ্ঞাপনে কে হবেন সুরের সম্রাট। মধুবসন্ত আর ইন্দুমতী নবদ্বীপের তাদের ভগ্নপ্রায় বাড়িতে টিভি খুলে বসেছিল। তাদের সঙ্গে তাদের কীর্তনদলের অন্যান্য সদস্যরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। নির্দিষ্ট সময়ে শো শুরু হল। ঘোষণা হল। এইবারের বিষয় ‘গুরুকূল’। প্রতিযোগীরা তাদের সঙ্গীতের গুরুর সঙ্গে গান পরিবেশন করবেন। বেশ খানিকক্ষণ অনুষ্ঠান চলার পর অতিথি বিচারক হোমশিখা ঘোষণা করল এইবার সে তার গুরুজিকে আনতে চলেছে মঞ্চে। অত্যন্ত সাধারণ পোশাকে তুখারিরাম শাস্ত্রী আর একটি স্বরমণ্ডলী হাতে সাগর উঠে এল মঞ্চে। বিচারকের আসনে হোমশিখার পাশেই ছিল উড়ান। সে প্রধানত পাশ্চাত্য পল্লী গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে। গোয়াতে তার নিজস্ব ব্যাণ্ড আছে। সে বলল। এই প্রথা ভারতের নিজস্ব। গুরুকূল প্রথা। উড়ানের কথার পরেই সাগর গান ধরল। ঠুমরী অঙ্গে রাগ তিলক কামোদ। মুহূর্তে অনুষ্ঠানের আবহাওয়া বদলে গেল। উপস্থিত সকলের মনে হল এ যেন মুম্বাইয়ের স্টুডিও নয়। বৃন্দাবনের বাঁকেবিহারী মন্দিরের নাটমন্দির। সাগর অনায়াসে স্বরমণ্ডলী সহযোগে গাইছিল। ‘বিনত করত পৈয়া পরত। বিট্ঠল চিত এক না মানত।’ যেমন আবির্ভাব তনই তিরোভাব। রকমেগাস্টার উড়ান ভাবোন্মাদ হয়ে গিটার নিয়ে ছুটে এল মূল মঞ্চে। হোমশিখা দর্শককে হাত নাড়িয়ে গুণগুণ করতে বলল। নবদ্বীপের মধুবসন্ত কীর্তনীয়ার দল তাদের খোল করতালে সাগরের গানের সুরের তালে তালে মদমত্ত রসিকের মতোই দুলতে লাগল। তারপর সেই অসামান্য গান শেষ হলে মঞ্চে কয়েক সেকেণ্ডের নীরবতা নেমে এল। আর তার পরক্ষণেই যেন অনন্ত হাততালির তরঙ্গ। সে তরঙ্গ থামতেই চায় না কিছুতেই।শেষে সেই করতালি খানিকটা স্তিমিত হয়ে এলে উড়ান সাগরকে জরিয়ে ধরল। এতক্ষণ তার মন খুঁতখুঁত করছিল। এই মেগাফাইনালে প্রতিযোগীদের গান তাকে খুশি করতে পারছিল না। সাগরের গান তার মনের সেই খুঁতখুঁতামি দূর করেছে।
-কাঁহা থে তুম ইতনা দিন। তুমহে তো উস কনটেস্টান্ট সিটমে রেহনা চাহিয়ে। সম্রাট হ্যায় তু। কিতনা উমার।
-বারো।
-কামাল হ্যায়। তু চল মেরে সাথ।
-কাঁহা?
-আগলা হফতা সে মেরা ইয়ুরোপ ট্যুর হ্যায়।তু যায়েগা মেরা সাথ? তেরে মাম্মি পাপাকো ভি সাথ লেলে। রুপায়া কা ইন্তেজাম ম্যায় করুঙ্গা।
হোমশিখা যেন এতোদিন তার সোনার খাঁচার বন্ধন থেকে মুক্তি পাচ্ছিল মনেমনে। আর সাগর? সে ভয়ে ভয়ে তার গুরুজির দিকে তাকিয়ে বুঝল এই কদিনের অজ্ঞাতবাস সে সফলতার সঙ্গে সম্পূর্ণ করেছে। গুরুজি আর তার আবদারে আপত্তি করবে না। উড়ান আবার বলে।
-ক্যায়া হুয়া সাগর? উড়েগা মেরে সাথ?
সাগর বলে না কিছু। শুধু সলজ্জ ক্যামেরার সামনেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা গুরুজি, হোমশিখা ম্যাডাম আর উড়ান স্যারকে একে একে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।