গল্পেরা জোনাকি -তে সুরঞ্জনা বিশ্বাস দে

অপ্রয়োজনীয়

তা অনেকবছর কেটে গেলো পলাশপুরের এই রায়বাড়ীতে,সেই সেইবার বড়কর্তামশাই ডেকে পাঠালেন সাবিত্রীকে, বাপ-মা মরা দু’বছরের ছোটনাতি অংশুর নিউমোনিয়া হয়েছিলো, তার যত্নআত্তি করার জন্য। সাবিত্রী তখন বছর তিরিশের বিধবা ….বাঁজা, অপয়া মেয়েমানুষের দাম ছিল শুধু ভাইয়ের বাড়িতে ভাতকাপড়ে ঝিগিরি করা। দিনরাত জেগে খোকার সেবা করেছিলো ।আধো আধো গলায় “সাবি” বলে ডাকতো অংশু আর চুপি চুপি সকলের অগোচরে অংশুকে নিজের মাতৃস্নেহটুকু উজার করে দিতে চাইতো সে।

তারপর থেকে অসুখেবিসুখে ডাক পড়তো সাবিত্রীর… ভরসা করতেন কর্তামশাই… সেবার গিন্নীমার পা ভাঙলো… সাবিত্রী পাকাপাকি থেকে গেলো রায়বাড়ীতে…. শহরে পার্টি করতো রায়বাড়ীর মেজছেলে … একদিন মেজদাদাবাবু খুন হলো গেলো … গিন্নীমা বিছানা নিলেন শোকে…… বড়কর্তামশাই দেহ রাখলেন… অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে রাজপরিবারের উপর, সাবিত্রীও সয়েছে অনেক । রায়বাড়ীতে সাবিত্রীর থাকাটা বৌদি ক্ষেত্রমণি মেনে নিতে পারেনি… মাঝে মধ্যেই শাসিয়ে যায়- পরে বসতবাটীতে যে তার আর ঠাঁই নেই —একথাও শুনিয়ে দিয়ে যেতো ঠারে ঠারে।

রায়দের চারপুরুষ দেখলো সাবিত্রী…ছেলে মেয়েরা সবাই এখন শহরবাসী –গ্রামের বাড়িতে আসে ছুটিছাটায়…দুএকদিনের জন্য। শীতের শেষে মেয়ে মিতুল আর বৌ অদিতিকে নিয়ে ছোটখোকা অংশু এলো বাড়িতে। তা এবার এসেই ঘরে বন্দী… দেশটাই নাকি ঘরবন্দী… কিসব কঠিন রোগ এসেছে.. তাই… সাবিত্রী এতোশতো বোঝেনা… একমাত্র ওই একটু খুশি… মিতুলটাকে কাছে পাবে।
… এখন সাবিত্রী কানে কম শোনে.. চোখেও দেখে কম..খুকখুক করে কাশে..গায়ে গায়ে জ্বর… বয়সও তো কম হলো না । অদিতি যেনো সহ্য করতে পারেনা সাবিত্রীকে, মিতুলকে আগলে রাখে…. সাবিত্রীকে দেখলেই অদ্ভূত একটা ভয় তার চোখে মুখে ফুটে ওঠে।
সেদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ হলে ছোটখোকা তার “সাবি”র হাতে কিছুটাকা দিয়ে বললো — “আমরাও তো কেউ থাকিনা এখানে, বিক্রি করে দেবো এই বাড়ী। তুমি বরং ঘরে ফিরে যাও। ”
সাবিত্রী যেনো নতুন করে ঘর শব্দটা শুনলো, আগের থেকে অনেক আলাদা।
সন্ধ্যা হয় হয়, ঠাওর করতে করতে উঠোনে এসে দাঁড়ালো…ঐ তো ঐখানে ছিলো রান্না ঘর, ঐখানে শিউলি ফুলের গাছটাতে শরৎ এলেই ফুলে ছেয়ে যেতো। পশ্চিম ভিটের আটচালাটা আর নেই, একটা পাকা বাড়ী ,শান বাঁধানো পুকুর ঘাট…
আরো অনেক কিছু বদলে গেছে। তুলসীতলায় ক্ষেত্রমণির ছেলের বৌ সাঁঝবাতি দিচ্ছিলো…
অচেনা মানুষ দেখে ডাকলো ঘরের মানুষদের।
ভাইপো রামু কিছুটা সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো পরিত্যক্ত ঢেঁকিশাল… ভাঙাচোরা ,তারই মতো অপ্রয়োজনীয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।