সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে যুথিকা সাহা (গল্প – পর্ব ৪)

দাসী

রাত তখন প্রায় দুটোর কাছাকাছি হবে ,হঠাৎ টুকি মা মা….গো আর মেরোনা ছেড়ে দাও এই বলে চিৎকার করে উঠল! পাশেই ছিল বুলির মা,বৌদি ও এক দিদি আর বুলি …।
বুলির মা জেগেই ছিল ,বলল কি রে মা কি হয়েছে বলে যেই না গায়ে হাত দিয়েছে ,ওরে বাবা কি জ্বর !!!
তার গা এক্বেবারে বারে পুড়ে যাচ্ছে !
ওর বৌদিও লাফিয়ে উঠে আর সবাইকে ডেকে আনল ।
ওর এক দাদা বলল, ওই জ্বরের ওষুধটা খাইয়ে দাও ।
ওর মা বলল জল আন দেখি বাটি করে মাথায় জল পট্টি দিয়ে দি ।
ওর দাদা বলল ওর ভেতরে ভয় ঢুকে আছে ,আর তাছাড়া শরীরের অত যন্ত্রনার জন্য এটা হচ্ছে ,ওষুধ খেলে কমবে ,আর দেখবে ও যেন চমকে না ওঠে ।
বুলির মা বলল, আমার কাপড়খানা ওই যে ধরে শুয়ে আছে আর ছাড়েনি আমাকে !
আমি তো জেগেই আছি ,রাতের খাবার সব বুলি আর ওর বৌদিই সকলকে দিল ।
আমার টাও দিয়ে গেল ,বলল মা তুমি এখানেই খাও ,আর ওর কাছেই থাকো…..
এই করেই তো রাত পেরিয়ে সকাল হল,তখন দেখছি গা ঘেমে জল —-বলছে জল খাবো দিদি ,জল দিয়ে গা মুছিয়ে বুলিকে বললাম তোর একখানা জামা দে ?
এটা ছাড়িয়ে দি ,ও নিয়ে এল ।এবার দেখি উঠে বসল ,বলল দিদি আমাকে বাড়ি গেলে আবার মারবে?
আমি বললাম নারে আর মারবে না আমরা তো আছি তুই ভয় পাস না কেমন ।
এখন আমাদের বাড়িতেই থাক ,কিন্ত বাড়ির কাজ ,বাবার খাবার সব কে করবে ?
বললাম তোকে অত চিন্তা করতে হবে না ।সবাই ঘুম থেকে উঠেছে ,বুলির বৌদি ও আর এক দিদি সবার জন্য চা করে বিস্কুট নিয়ে হাজির ।
ওর এক দাদা বলল যে ওর তো কিছুই খাওয়া হয়নি ,ওকে চোখ মুখ ধুইয়ে খেতে দাও ।
ওষুধ আছে খেতে হবে , বুলির বৌদি ধরে নিয়ে গেল মুখ ধুয়ে নিয়ে এসে বলল-
কি খাবি বল ?
তোমরা যা খাচ্ছ তাই দাও।
ওর মা বলল আরে তোকে পেট ভরে খেতে হবে ,তরপর ওষুধ খাবি যে মনা ।
ওর দাদা একটা হরলিক্স কিনে এনেছিল বলল এটা দিচ্ছি এটা গুলে চার পাঁচ টা বিস্কুট দাও শিগগির— খিদেও পেয়েছিল মেয়েটার ,তাই খেয়ে ওষুধ খেল ।
দাদা বলল দেখতো থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর কতটা আছে ?
দেখে বলল জ্বর একশোর নীচেই রে ,তাও তুই দেখ আমার তো চশমা পড়া নেই —বলল না তুমি ঠিকই দেখেছো ।
বললো চিন্তা করিস না আমরা তোর বাড়ি সামলাচ্ছি ।
বুলির মা,দিদি ওর দাদা সবাই ওদের বাড়ি গেল। দ্যাখে যে ওর মা বারান্দায় বসে আছে,বুলির মা নরম সুরেই ডেকে বললো ,ও বৌমা কেমন আছো এখন?
একটু কমেছে ,এর মধ্যে ওর বৌদি কেটলি হাতে আর কৌটো নিয়ে এসে বললো দিদি কাল রাতে যে ওষুধটা দিয়ে গেলাম তা খেয়েছিলে?
হ্যাঁ খেয়ে এখন অনেক ভালো ,রক্ত বন্ধ হয়েছে , খুব উপকার হইসে ওষুধটা খেয়ে । যাক ভালো এ নাও চা খাও দেখিনি ভালো করে বানিয়ে নিয়ে এসেছি বেশী করে দুধ দিয়ে ঘন করে –দেখোতো তোমার মত হয়েছে নাকি ?
আবার এসব কেন করতে গেলে ?
কেন আমরা তোমার পর যে করবো না !
পাশাপাশি থাকি একসাথে ,নয় রক্তের সম্পর্ক নেই ওটাই কি সব বল !
খাও তো …..
এর মধ্যে অমলের মা এল ,বলল আমি তো কাল রাতে এসেছি মেয়ের বাড়ি থেকে এই মনার মুখে সক্বাল বেলায় শুনলাম ।মননাই বলল যে দাদা দেখলাম বেড়িয়ে গেল ,আমি আইস্যা উঠান ঝাড় দিয়া গেটে জল দিয়া গেলাম তখন দিদি ওঠেও নাই ,টের ও পায় নাই! তখনই তো অমলের মার লগে দেখা সব কইলাম ।তোমার চিন্তা নেই আমরা আছি তুমি এখন দুদিন বিশ্রাম নাও দেখি ।
তুমি কাল রাতে কি ওষুধ দিয়েছিলে ?
আরে আমার মার ও তো এরকম হয়ে ছিল তাই কাল যখন ভাই এলো ওকে বললাম ওষুধ দুটো এখনি দিয়ে যা তো ?
আমি এসে দিয়ে গেছিলাম ।শোন বৌমা ওর মারো এমন হয়েছিল নাড়ি বাদ দিয়েছিল ।
তুমি এনাকে দেখিয়ে ওষুধ খাও তারপর একটু সুস্থ হয়ে বোনের বাসায় যাও কেমন ।তা খবর দেবে তো তাদের ?
হ্যাঁ ওই একজন আছে ও কলকাতা যাবে পরশু ।ওরা আমার দাদার শালা হয় ,ওর হাত দিয়ে চিঠি দেব ।
ও মামনির মা তোমার মার ডাক্তার কোথায় দেখাইছিল ?
ওই যে গো দিদি উনি কলকাতা থেকে আসেন আমার বাপের বাড়ির পাশে রামকৃষ্ণ মঠে ওখানে দেখেন।
উনি ওখানকার শিষ্য খুব ভক্ত মানুষ আর ভীষণই ভালো ।
আমি তোমাকে নিয়ে যাবো ,ভাই কে বলবো নাম লেখাতে ।
কত টাকা লাগে ?
পয়সা লাগেনা খালি কুপন দেয় ওটা সাথে করে নিয়ে গেলেই হয় ।
কাল বসবে তোমাকে নিয়ে যাবো । ওর দিদি বলছে বড়দার খাবার তো আমি আগেও ক‍রে দিয়েছি ,আমি করে দেবোক্ষণ ।
বুলির মা বলল ও বাবা বৌমা তোমার কর্তা যা মানুষ তুমি এতদিন রান্না কর তাই একটু নুন ঝাল বেশী হলে তোমাকে কথা শোনায় আবার তা ছুঁড়ে ফেলে দেয় ,ও ছেলেমানুষ ও পারে!!!
তার পর কত তার কত ফিরিস্তি ,ফাইফরমাস হুকুম ধুর ধুর এই সমস্ত বেটাছেলে নিয়ে ঘর করা যায় !
সবসময় ভয়ে সিটিয়ে থাকতে হয়।
আমার যে কপাল খারাপ তাই এই অবস্থা !
তা বলি তুমি কি মেয়েটার ওপর দিয়ে ওই শোধ নেবে?
দুঃখ কষ্ট সবার জীবনে থাকে ,তাই বলে আমরা তো তোমার নিজের মতো আমাদের কাছে বলেও তো হালকা হতে পারো নাকি !
আমার মাথার ঠিক থাকেনা যে ….!
যাই বলো বাপু তোমার ছেলেকে দিয়ে মেয়েটাকে ওরকম মার খাওয়ানো ঠিক হয়নি ।
আজ থেকে তো তোমাদের ফ্যামিলি কে দেখছি না সেই তোমার দেওর, ননদ শ্বশুর- শাশুড়ির আমল থেকে তাদের আচরন জানা আছে ।
এখন দেখলে তো কথাই বলে না ,যেন চেনেই না !আমাদের বাড়িতেই যত আড্ডা ছিল তোমার ননদদের ।
এখন তারা বড় ঘরের বৌ আমাদের কে চিনবে ? যাক শোন তোমাকে রান্না করতে হবে না ,আমরা তোমার খাবার দেব আর ও ছবি তো বড়দা যা খায় করবে বুঝলে ।অমলের মা বলল আমি তো আছি সবই তো করবো ,দুদিন ছিলাম না ,মেয়েকে আর আমার বাবা কে একবারে দেখে এলাম ।
এর মধ্যেই এত্ত কিছু হয়ে গেল !
অমলের মা ওদের বাড়ি কাজ ক‍রে আর বড় বৌয়ের সঙ্গী ।
বুলির দাদা – বৌদি ওকে ভীষন বাজে ভাবে মেরেছে ,যাই বলো এটা অন্যায় ,দেখ ওদের আমরা কতটা দিতে পারি বল ?
এই বয়সে ওরা তো এটা করবে ,ওদের মুখের হাসিটা দেখলেই মন ভরে যায় ।
দুটো কম খাই আমরা সাধ্য নেই কিন্ত আমরা সবাই আনন্দ করেই থাকি ।মেয়ে সন্তান কার ঘরে যাবে আমরা ওদের কত ভালো বিঁয়ে দিতে পারবো বলো তো যা সব চাহিদা সেখানে গিয়ে ও যদি এই অত্যাচারের মধ্যে পড়ে তাহলে বলো ..?
মনা বলল জানোনা ওপাড়ার মধুর বোন কে পণের টাকা সব দিতে পারেনি বলে রোজ রাতে চোরা মার মারতো ,তার পর টাকা চেয়ে পাঠিয়েছিল দিতে পারেনি বলে মেরে বস্তায় ভরে ওই ওদের বাড়ির পেছনের বাগানে পুঁতে দিয়েছিল ,ধর্মের কল বাতাসে নড়ে !
যাদের বাগান তারা দুদিন পর এসে ছিল বাগান পরিষ্কার করার জন্য ,ওরা নাকি ওখানে বাড়ি বানাবে ।ওই পরিষ্কার করতে গিয়েই দেখে এই সব !!!তখন লোকজন জড়ো হয়ে গেছিল আর ওরা স্বীকার করে না ,সব চিহ্ন পাওয়া গেছে ,ওপাড়ার ক্লাবের সবাই গেছিল ,পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে সব কটাকে ।
কিন্ত ওরা পার্টি করে তো নেতাদের ধরেছে পয়সা দিয়ে সব মিটিয়ে ফেলবে ।হ্যাঁ যার গেল তার গেল ।এই বলে মনা বেরিয়ে গেল কিন্ত আবার ফিরে এসে বলল ওনার বড় মেয়ে আসছে ,ও ছবিদি শিগগির যাও তোমারে তো ও দেখতে পারে না !
ছবি চলে গেল ,টুনির মা বলল ওর বড় ট্যাকস ট্যাকস কথা বাবা!
একটু ভালো ঘরে বিঁয়ে হয়েছে বলে ধরা কে সরা জ্ঞান করে ।
অনেকেই চলে গেল ।বড় মেয়ে এসে বলল কি তুমি এখন ঠিক আছো ?
মা বলল বুলির বৌদি কাল ওষুধ দিতে অনেক ভালো আছি ।
ওর মার নাকি এরকম হয়েছিল তাই আমাকে বলল তুমি দুদিন খেয়ে সুস্থ হয়ে কলকাতা যাও ।কবে যাবা ?
তোরা ব্যবস্থা কর ,আর তোর মেসোর কাছে চিঠি দিয়েছি মামিমার ভাইয়ের কাছে ।
আজকে খাবার……
বলতেই অমলের মা সব চাপা দিয়ে বলল আমি তো আইসি কাল রাতে আমি ই করুম ।এখন তো এখানেই আছি ,ও তুমি চলে এসছো ।বুলেট আয় সবাই আদর করতে লাগল ,অমলের মা বলল তোর পোলার জন্য ডিম সিদ্ধ কইর‍্যা দেই খাওয়া ?
না না ওসব ঝামেলা করতে হবে না আর ও ডিম এখানে খাবে না ।কেন রে রাগ করসোস ?
রাগের কি আছে আমাদের জন্য বাবা কাউকে ঝামেলা পোহাতে হবে না ,!আর আমি কাল কলকাতায় যাচ্ছি জায়ের ওখানে ওরা টিকিট কেটেছে ওর ও ছুটি পড়েছে আমরা হরিদ্বার যাচ্ছি ।তাইলে তোর মার যে এই অবস্থা কি হইবো? বলল মার আবার লোকের অভাব ওই তো চিঠি দিয়েছে মেসো আসবে নিয়ে যাবে।
বাবা আছে দাদা বৌদি আছে তো ।
কেন রে তুই ও তো মেয়ে? বুলির মা বলল ,তুই কিছু করবি না ?
বিকেলে দাদার বাড়ি যাবো কথা বলি ।দেখ রে তোদের এই সবাই কে আজ থেকে নয় ,তোর পিসি ,ঠাকুমা,কাকারা সব কিন্তু আমাদের বাড়িতেই আড্ডা ছিল ,নিজের ভেবেই আসিরে বোন ।নাগো দিদি তোমাকে কিছু বলিনি …
তোর যখন অপারেশন হয় তোর মা তো ভয়ে অস্থির আমরা সব সাহস দিয়েই করালাম বোন ।
দেখ পাশাপাশি থাকলে নিজের লোক হয়ে যায়।
চতুর্থ পর্বের কিছু অংশ পরবর্তীতে…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।