সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৩৬)

ইচ্ছামণি

পর্ব ৩৬

সিঁড়ির দরজায় আওয়াজ। গুবলু বাড়িওয়ালাদের কাছে ছিল এতক্ষণ। সমবয়সী সঙ্গীর অভাবে বড়দের আড্ডাতেই বিনোদন খুঁজে নিয়েছে। রুমা বা অতীন, কারও ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও মেনে নিয়েছে উপায়ন্তর না দেখে। সুবিধাও যে হয়, সে কথা অস্বীকার করে কী করে?
গুবলু গোমড়া ঘরে ঢুকেই হাত পা ছুঁড়ে কান্না শুরু করল, “আমি কোনওদিন ওদের বাড়ি যাব না। কখ্‌খনও না।”
“কী হয়েছে সোনা, অমন করছ কেন? কেউ কিছু বলেছে?” রুমা হাঁটু মুড়ে বসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল।
গুবলুর দাপানি থামছে না। হাত থেকে জলের বোতলটা, যেটা কারও বাড়ি বা বাইরে গেলে ওর সাথে দেওয়া হয়, সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। অতীন টক করে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “আচ্ছা যেতে হবে না। আমি বাড়ি ফিরে আমার ছোন্তু মামমাম গুবলু সোনাকে যেন দেখতে পাই। বিকেলে মা পার্কে নিয়ে যাবে, আর সন্ধ্যেবেলায় বাবার সাথে উস্তমফুস্তম। ঠিক?” চকাত করে হামু দিল মেয়ের গালে। “তারপর একটু পড়া নিয়ে বসা। দেখছ না, কোনও খেলা খেলতে গেলেও স্কোর জানতে অঙ্ক শিখতে হয়। ম্যাথস্‌ ছাড়া কিছুই হবে না। মায়ের রান্নাও না।”
আড্ডার বিকল্প অঙ্ক – গুবলুর ব্যাপারটা খুব একটা মনঃপূত হল না। সে পুরোনো বায়নার রেশ টেনে বলল, “ওদের কাছে আর যাব না। রশ্নীদিদি আমার সাথে কম্পিউটারে খেলছিল। বিলুদাদা অন্য খেলা করতে চাইছিল। জেঠু বাড়ি ঢুকে বলল, গুবলু এখন রাত হয়েছে, বাড়ি যাও মা বাবার কাছে। হাঁ-হাঁ-হাঁ-আঁ—। আমায় খেলাটা শেষ করতে না দিয়ে এখানে পাঠিয়ে দিল। আমি কক্‌খনও খেলব না ওদের কম্পিউটারে। যাবও না।”
“যাস না। নিজেই তো অস্থির হয়ে হয়ে যাস জেটিমা, রশ্নীদিদি, বিলুদাদা করে। সেদিনও তপনদা ওকে যাওয়া মাত্র নীচে চলে আসতে বলল। আহা! বাচ্চা মেয়ে, মনে কষ্ট হয় না? বড়দেরই খারাপ লাগে। বলেছি না, ওরা না ডাকলে হ্যাংলার মতো যাবে না। বাবাকে কম্পিউটার কিনতে বল, এখানেই কতকিছু করতে পাবি। আমাদের তিনজনেরই কাজে লাগবে। তার আগে অবশ্য একটা ফ্ল্যাট কেনা জরুরি।” রুমা মেয়েকে ভোলাতে গিয়েও ফ্ল্যাটের প্রসঙ্গ ভুলতে পারে না।
“এটা আমাদের বাড়ি নয়, না মা?”
১৫
রাতে রুমার এমনিতেই ঘুম হতে চায় না। ওষুধ না খেলে তো নয়ই। ইদানিং ও ওষুধ খাচ্ছে বলে মনে হয় না। খাচ্ছে কি খাচ্ছে না, সেটা নিজেরই মনে থাকছে না। অতীন জিজ্ঞাসা করলে বিপাকে পড়ে যায়।  অতীন আর গুবলু শুয়ে পড়ার পর অনেকটা দেরিতে বিছানায় আসে। কখন আসে প্রায় টেরই পাওয়া যায় না। যেসব ওষুধে ঘুম পায় সে রকম কিছু খেয়েও যদি না শুয়ে রাত জাগলে ঘুমের বদলে শরীরে অস্থিরতা দাপাদাপি করে। সেটা অতীনও জানে। তাই ও জেগে থাকলে রুমাকে শুতে না দেখলেই রাগ করে। কিন্তু প্রতি রাতে পর্যবেক্ষণ বা পাহারা সম্ভব হয় না, কারণ অতীন বালিসে মাথা রাখা মাত্র নাকের গর্জনে সারা নীচতলাটা মন্দ্রিত হতে থাকে। ঝামেলাবাজ বাড়িওয়ালা এই নাক ডাকা নিয়ে যে আপত্তি তোলেনি সেটাই বাঁচোয়া। অতীন ঘুমিয়ে পড়ার আগে তাড়া দিলে উত্তর আসে “কাজ আছে”। সারাদিন ঘুমিয়ে থেকে রাত্রে কীসের কাজ কে জানে? ঐ ইচ্ছামণি না কে, তাকে বলে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
আজ অতীনও ঘুমোয়নি। রুমা শুয়ে পড়লে তার কাজ আছে। পাথরটা কোথায় লুকোনো অতীন জানে, কিন্তু হাত করা যাচ্ছে না। রুমা বার বার এঘর ওঘর করে চলেছে। টুকটাক জিনিসপত্র নাড়ার আওয়াজ। এমনটা রোজ করছে নাকি আজকাল। টের পাওয়া যায় না তো! কী করছে রাত জেগে?
অতীন উঠে দেখল রুমা বসার ঘর, ফ্রীজ সব ঝাড়পোঁছ করছে। অতীন কড়া গলায় বৌকে ডাকল, “শুয়ে পড়”। রুমা শুনতেই পেল না। বসার ঘরের পর ছোট শোবার ঘরের বইপত্র। অতীন দাঁতে দাঁত ঘষল, “কী হচ্ছে কী?”
রুমা ভ্রূক্ষেপ না করে পরম অন্যমনস্কতায় তোয়ালে কাঁধে বাথরুমে ঢুকল। গা ধুয়ে এসে আধভেজা গা ফ্যানের হাওয়ায় শোকানো ওর পুরোনো অভ্যেস। অতীন রাগ করে। সারা গায়ে যার ব্যথা, তার ব্যথা বাড়বে না? গা না ধুয়ে গরমের রাতে রুমা শোয় না, ঘুমই আসবে না। অতীন অপেক্ষা করে আছে, এবার তাহলে রুমা শোবার ঘরে আসবে। কিন্তু রুমার ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা বৃথা। হয়ত ঘুমোবেই না; বার বার বাথরুম যাবে।
এখন একটু বেশিক্ষণ স্নানঘরে কাটালে ভালো হয়। সাবধানে ঘরে ফিরে আলমারি খুলে তার প্রত্যন্ত কোণ থেকে কাগজে মোড়া পাথরখানা বার করল অতীন। মুঠোয় নিয়ে ঘষাঘষি করল। কিচ্ছু হল না। তাও মোড়কটার কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি ইচ্ছা? শুনতে পাচ্ছ? কাল, মানে আজ সকাল হলে আমার বদলে তুমি অফিসে গিয়ে লেবার পেমেন্টের বিলটা বের করে দিও। স্যালারি স্লিপগুলোয় যেন গোলমাল না থাকে। গত মাসে এক লাখ বত্রিশ হাজার টাকার অ্যাডজাস্টমেন্ট রয়েছে। কম পেমেন্ট হয়েছিল। সেটা অ্যাডজাস্ট করার জন্য সাপ্লিমেন্টারি ফাইল আমি বানিয়েই রেখেছি। আজ ঐ ফাইলটা মেইন প্যাকেজের সাথে একসঙ্গে প্রসেস করতে হবে। বুঝলে? তোমায় এত সব বলতাম না। কিন্তু কাল কন্ট্রোলার ডেকেছেন। মেইন অফিস গেলে সারাদিন ছাড়া পাব না। ফ্যাক্টরির এই কাজটা তো পড়েই থাকবে। আমাকেই করতে হবে অনেক বেশি ঝামেলা করে। তুমি…”। জরুরি কথাটা জিজ্ঞাসা করা হল না। অতীনরূপী ইচ্ছামণিকেও দেখা হল না। স্নানঘরের দরজা খোলার আওয়াজ হল।
তাড়াতাড়ি পাথরটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে আলমারি বন্ধ করতে গিয়ে ঘটাং ঘটাং শব্দ হল। সর্বনাশ! না সর্বনাশ হল না। রুমা বাথরুম থেকে বেরিয়ে শোবার ঘরের বদলে রান্নাঘরে ঢুকল। তোয়ালে জড়ানোর বদলে নাইটি পরেই বেরিয়েছে। ঠং ঠাং শব্দ হচ্ছে। গ্যাস জ্বালানোরও শব্দ হল। রুমা একবার এসে শোবার ঘরের ব্র্যাকেটে তোয়ালেটা ঝুলিয়ে দিল। অতীন মশারির বাইরে চোর চোর ভাব করে দাঁড়িয়েছিল। রুমা দৃকপাত না করে কাজে ডুবে গেল। অতীন ওকে আর কিছু না বলে শুধু অনুসরণ করে গেল। ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ডাইনিং টেবিলে সকালের রান্না, মেয়ে ও বরের টিফিন, রাতের ব্যবস্থা, মায় বিকেলের জলখাবারের উপমা সব তৈরি। স্বগোতক্তি করল, “ঠাণ্ডা হলে বিকেল আর রাতের খাবার ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখতে হবে”।
এরপর এক কাপ চা হাতে বরের ঘুম ভাঙাতে এল রুমা। অতীনের উঠে পড়ার সময় হয়ে এসেছে। এক্ষুণি মোবাইলে অ্যালার্ম বাজবে। অতীন ব্যাজার হয়ে উঠে বলল, “তোমার চা? সারা রাত খ্যাপামো করে খেটে গেলে কেন? তোমার ইচ্ছামণিকে বলে নিজে তো শুতে পারতে।”
চায়ের কাপটা অতীনকে ধরিয়ে নিজে হাই তুলে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল রুমা। অতীন উঠে দেখে বসার ঘরের সোফার কভারগুলো সব খুলে ডাঁই করা আছে কাচার জন্য। এখন কাপড় কাচতে বসবে নাকি, সারা রাত জেগে?
“চা খাবে না? রাতে ঘুম না এলেও চুপচাপ শুয়ে থাকতে হয়।”
ঘুম জড়ানো গলায় রুমা বলল, “চা হয়ে গেছে? ইচ্ছা এতক্ষণে সব রান্নাবান্না সেরে ফেলেছে। চা খেয়ে প্লীজ়, আরও আধ ঘণ্টা যদি শুই কিছু মনে করবে? গুবলুকে আজকের দিনটা তৈরি করে দাও না। সবই তো করা আছে। ওর ফ্যানাভাত করেও চাপা দেওয়া আছে টেবিলে।”

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।