আজ মেয়েটার লেখা বইয়ের প্রথম প্রকাশ। ছোট বইয়ের দোকানটিতে মেয়েটি এসেছে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। কোণায় বইয়ের আলমারির পাশে বসে কৌতূহলী মা দুর্গা। রূপ, অর্থ, খ্যাতি – কিছুরই অভাব নেই, তবু নিজের সাহিত্যিকসত্তা প্রকাশের প্রথম দিন বলে কথা! মেয়েটির জীবনে আজ সত্যি সত্যিই এক বিশেষ দিন। ঠোঁটে শানিত হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে মেয়েটা। চারদিক থেকে ছুটে আসছে প্রশ্নবাণ, আর সেগুলোকে হাসিমুখে কাটতে কাটতে চলেছে ঠোঁটকাটা মেয়েটা। সত্যিই ঠোঁটকাটা। রূপের দীপ্তি আছে, কিন্তু ওই যে উঁচু মাথা, তা শুধু রূপের দেমাক নয়। মা দুর্গার বিস্ময় জাগে এই মেয়েটাকে দেখে, আজ থেকে তো দেখছেন না! এ মেয়ে পৃথিবীর কোন কিছুর কাছেই মাথা নিচু করতে জানেই না! নিমেষের মধ্যে সমাধান করতে পারে পৃথিবীর জটিলতম অঙ্ক। রূপ-গুণ-বিস্ময়কর প্রতিভার ঝলকে ঝলমল করে মেয়েটা – না, কোহিনুর হীরের মতো স্তব্ধকরা সৌন্দর্য্য না, এ ঝলমলানি যুদ্ধক্ষেত্রে সূর্যের আলোয় ঝলসে ওঠা বর্শার মতো। অনেকে বলে দেমাকে মেয়েটার মাটিতে পা পড়ে না! মেয়েটা মনে মনে বলে – ‘বেশ হয়, মাটিতে পা পড়ে না! আমি সেরা, কেউ তো নেই এ পৃথিবীতে আমার মতো! কেন মাটিতে পা পড়বে?’
বাস্তব কথা। সার্কাসের সামান্য ট্রাপিজের খেলা দেখানো ভাঁড়, সিংহের রিংমাস্টার বাবার যৎসামান্য রোজগারে পেট চলতো না! ছোট মেয়েটা তিন বছর বয়স থেকে কঠিন কঠিন পাটিগণিতের অংকের জবাব বলতে পারে। গরীব বাপমা রোজগারের পথে নামিয়ে দিয়েছিলো ছোট্ট মেয়েটাকে। এক মাথা চুল, বড় বড় চোখের মেয়েটা চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে কঠিন কঠিন অংকের উত্তর বলে দেয়। প্রতিদিন সিংহের খাঁচায় প্রাণহাতে করে কাটানো বাবা, নির্বাক শোষিত মা সুখের মুখ দেখার আশায় রোজগারে নামাতো। খোলা রাস্তায় ‘শো’ করতো মেয়ের প্রতিভা। জটিল গাণিতিক সমস্যার নির্ভুল সমাধান পলক পড়তে না পড়তে বলতে পারা বাচ্ছা মেয়েটা সেই ছোট্ট বয়স থেকেই টাকা চিনে গেছিলো। মেয়েটা বুঝে গেছিলো চারপাশে ভিড় করা ভক্তরাই ওর পেট চালানোর পথ। টাকার অভাবে সামান্য রোগে বিনা চিকিৎসায় দিদির মৃত্যু মেয়েটাকে স্বার্থপর কঠিন করে দিলো। ক্ষুরধার বুদ্ধি আর নিরাবরণ নির্লজ্জ দেমাকী স্বভাব মেয়েটা এ দুনিয়ায় কাউকে আপন ভাবে না। সমকক্ষ তো দূরের কথা, মেয়েটার কোনো বন্ধুও নেই। সবাই ওর বন্ধুহীন স্বার্থপর জীবন দেখে শিউড়ে ওঠে। কিন্তু মা দুর্গা মনে মনে হাসেন এটা ভেবে যে মেয়েটার বন্ধু দরকারই হয় না। জগতের সমস্ত সংখ্যা ওর বন্ধু। সংখ্যারা খেলা করে – ছন্দে-গন্ধে-প্রেমে – ওর চিন্তায়, চেতনে, অবচেতনে! মেয়েটা সম্রাজ্ঞী হতে জন্মেছে। না, সম্রাটের স্ত্রী হয়ে নয়, খ্যাতির ওই কণ্টকাকীর্ণ সিংহাসনে মেয়েটা নিজে রাজত্ব করতে চায়। ক্ষমতার লড়াই জেতার পথে কেউ থাকে না মেয়েটার সামনে। নিজের বাবা মা তো নয়ই, স্বামী এমনকি সন্তানও অন্তরায় হতে পারে না মেয়েটার খ্যাতির শীর্ষে ওঠার পথে! মেয়েটা একাকিত্বকে মাথায় চড়তেই দে না – ঋষিতুল্য আত্মমগ্নতা তার। মা দুর্গা বোঝেন, সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত এই আত্মমগ্নতা, তাই তারা স্বার্থপরতা বলে ভুল করে। হয়তো মেয়েটা নিজেও নিজেকে স্বার্থপর ভাবে, কিংবা হয়তো ভাবে না। মেয়েটার আত্মমগ্ন ভাবনায় সংখ্যা, ক্ষমতা, অর্থ, খ্যাতি ছাড়া হয়তো আর কিছু নেই, কে জানে?
বই প্রকাশের পরে বেশ কিছু বছর কেটেছে। মা দুর্গা আবারো আজ মেয়েটার পাশে বসে, বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দেখছেন। ইম্পিরিয়াল কলেজ অফ লন্ডনের গণিতবিভাগের সেমিনার রুমে আজ বিশ্বের মহান গণিতজ্ঞরা স্তম্ভিত হয়ে কাটাচ্ছে মূহুর্তগুলো। তেরো অংকের দুই সংখ্যার গুণফল বের করতে দেওয়া হয়েছে মেয়েটাকে। মহাকালের ঘড়ি, থিওরি অফ রিলেটিভিটি – সব একসাথে কাজ করছে মা দুর্গার মনে আজ। সূচীভেদ্য নৈশব্দকে উপভোগ করতে আজ মা দুর্গা কালচক্রকে ধীরগামী করে দিয়ে মেয়েটার চিন্তায় প্রবেশ করে টের পেলেন সেখানে কি চলে। হ্যাঁ, কালচক্রকে নিয়ন্ত্রণ করার ঐশ্বরিক ক্ষমতা রাখে মেয়েটা। আলোর গতিকেও বোধহয় চ্যালেঞ্জ করে মেয়েটা। মুহূর্তের ভগ্নাংশে চিন্তার বিশাল স্লেটে বুদ্ধির খড়ি দিয়ে গুণফল বের করে চললো মেয়েটা। আঠাশ সেকেন্ড সময় যেন আঠাশ যুগ পেরোনোর সমান। উত্তর দিলো সে – নির্ভুল, অলৌকিকরকমের অবাস্তব, কিন্তু নির্ভুল।
মা দুর্গার অস্ত্র বর্শা – সরলরেখায় চলে আলোর মতো, লক্ষ্যভেদ করে নিঠুর নিয়তির মতো, গেঁথে যায় রূঢ় বাস্তবের মতো! ইম্পিরিয়াল কলেজের কক্ষে মা দুর্গা সদ্য গিনেস রেকর্ড জয় করা শকুন্তলার চোখে দেখতে পেলেন সেই দুর্বার দুর্জয় অস্ত্রকে। এ শকুন্তলার দুষ্মন্ত হওয়ার যোগ্যই নয় কেউ এ পৃথিবীতে। সত্যের আবার অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় দরকার হয় নাকি? সত্য ঝলসে ওঠে, শকুন্তলার অঙ্কের উত্তরের মতো, আলোর মতো, মা দুর্গার বর্শার মতো।