T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় অনুপ ঘোষাল

পথের কথা

প্রতি সপ্তাহের এই কলকাতা জলপাইগুড়ি যাতায়াতটা আমার অনেক কলিগের মতেই বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু নয়। প্রতি মাসেই টিকিট কেটে রাখতে হয় । টিকিট বাতিলও করতে হয় অনেক। একগাদা টাকা নষ্ট। তার উপর শরীরের ধকল। কোনওদিন দার্জিলিং মেইল লেট করলে কানেক্টিং হলদিবাড়ি প্যাসেঞ্জার পাওয়া যাবে না। তিনি ঠিক ন’টার সময় এন. জে.পি স্টেশন ছেড়ে চলে যাবেন। তখন দৌড়াও বাস ধরতে তেনজিং নোরগে বাস স্ট্যান্ডে।

ফেরার সময় বাধ্যতামূলক ভাবেই এন.জে.পি-তে এসে খাবার কিনে ট্রেনে উঠতে হয়। প্রথম দু’একবার রেলের ফুড কোর্টের খাবার খেয়ে টাকা নষ্ট করেছি বেশ কিছু। তারপর খুঁজে নিয়েছি কম পয়সার খাবার দোকান।

এতো অসুবিধা সবাই বোঝে আর যে এই যাতায়াতটা করে সে বোঝে না, তা তো নয়।
কিন্তু,যাওয়ার সময় দার্জিলিং মেইলের এস ওয়ানের ওই চল্লিশ নম্বর বার্থ, সাইড আপার, আর ফেরার সময় এস ওয়ানের থার্টি টু, ওর এক অমোঘ আকর্ষণ আছে। সে আমি বোঝাতে পারব না কাউকে। বাসেও আসা যাওয়া করতে হয়েছে বহুবার। সে সবই বাধ্য হলে।

এবারও হলদিবাড়ি প্যাসেঞ্জারটা ঠিক সময়ে পৌঁছে দিল জলপাইগুড়ি। চাপদাড়িওয়ালা টিকিট কালেক্টরকে হাসি মুখে পেরিয়ে সার্কিট বেঞ্চকে বামদিকে রেখে টুক করে ঢুকে পড়লাম তেলিপাড়ার দিকে। ঘরে ঢুকে রুকস্যাকটা কোনওরকমে রেখে সিগারেট ধরিয়ে বাথরুমে। আজ তাড়া আছে। স্নান সেরে আসতেই গরম গরম খাবার রেডি। প্রায় এক বছর হল এই বাড়িতে ভাড়া আছি। থাকার সূত্রেই বাড়ির যিনি মালকিন তাঁর হাতের অসাধারণ সব রান্নায় ভুঁড়িটা বেশ বাড়ছে । আজও তাই।

খাওয়া শেষ করে আজ বেশ ওয়েল ড্রেসড হয়ে অফিসের দিকে। আজ অফিস কম বিয়ে বাড়ি বেশী। মানে, আজ যেতে হবে কলিগের দিদির বিয়েতে। তাও আবার বহুদূর। সেই ফালাকাটা পেরিয়ে …। প্রথমে কেউ যাবে না বলেছিল। অতদূর…ফিরতে রাত হবে…এইসব নানা কথা। আমি শুধু বলেছিলাম যাবই। যাওয়ার ব্যবস্থাও গত সপ্তাহে করে গেছি, মানে, স্যার করে দিয়েছেন। দলেও পেয়েছি আমার থেকে জুনিয়র দুই সহকর্মীকে। এতএব আমাদের তিনজনকে নিয়ে সাদা রঙের অ্যাম্বাস্যাডারটা, যেটা মাঝেমাঝেই দেহ রাখে, ডি.এম অফিসের গেট থেকে বেরিয়ে সোজা চলল তিস্তা ব্রিজের দিকে।

প্রথম কিছুক্ষণ অফিসের কথা তারপর পরিবারের কথা, কবে ট্রান্সফার হবে, কে কতগুলো প্রেয়ার দিয়েছে, কারা কারা বাড়ির কাছে গত প্রায় পনেরো বছর কাকে তেল দিয়ে আছে, একটা ট্রান্সফার লিস্ট পুজোর পর বেরোতে পারে…এইসব কথায় কথায় চলে এলাম ধূপগুড়ি মোড়ে। ডানদিকের রাস্তাটা ধরে এবার যেতে হবে আমাদের। গাড়িটাকে সাইড করতে বললাম চায়ের দোকানের সামনে। সমীরের চা বা সিগারেট কিছুই চলে না। ও আমাদের দু’জনের সাথে গাড়ি থেকে নামল। আমি আর ঋতম চায়ের পর সিগারেট ধরালাম। দুজনের ব্র্যান্ড আলাদা। অবশ্য কোন ব্র্যান্ডটা একটু হলেও শরীরের পক্ষে ভালো তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা ডি.এম অফিসের ছাদে আমরা বহুবার করেছি। আজ আর সে কথার দরকার নেই। সমীর তাড়া দিচ্ছে। টাকা মিটিয়ে আবার উঠে বসলাম গাড়িতে। তখন ঘড়িতে পৌনে চারটে।

“দেরি হয়ে যাবে। এই গাড়ি নিয়ে এতদূর … এ তো চলতেই চায় না।” সমীরের কথায় গাড়ির স্পিডটা একটু বাড়ালো সৌমেন।

দেখতে দেখতে চোখের সামনে বুড়ো হয়ে আসছে রোদটা। রাস্তা হয়ে আসছে আরও ফাঁকা। দু’দিকের সবুজ ধানক্ষেত ধীরে ধীরে কালি মাখছে শরীরে। মাঝেমাঝে উল্টো দিক থেকে হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে দু’একটা এন.বি.এস.টি.সি-র বাস। দূরে জঙ্গলের কালো মাথার সারি। ঘরে ফেরা পাখিদের ডানা ভারি হয়ে আসছে সম্ভাব্য কুয়াশায়। এই গন্ধ, এই আলো, এই পথ … সব আমার চেনা, এ সব আমার সুখী বারান্দায় ফুলেফেঁপে ওঠা দেবদারুবীথি। ওদের সাথে আমার কবেকার সম্পর্ক তা বুঝতেই পারিনি। ওরা কি বহুকাল ধরে অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। আমিও কি তাই…

” এইটা ফালাকাটা মোড়। কোন দিকে যাবা।” সৌমেনের কথায় নিস্তব্ধতা কাটল।

“এবার বাঁদিকের রাস্তাটা ধরতে হবে।”- এ জন্যই সমীর আমার এত প্রিয়। ও সাথে থাকলে সব একেবারে পারফেক্ট। রাস্তার খাবার বা জল কিছুই খেতে দেবে না। আজও টিফিন কৌটো আর দু’টো জলের বোতল সঙ্গে। ঋতম আর আমার পাগলামোটা সমীর থাকলে অনেকটাই বেশ কমে যায়। ঋতম সবার ছোট। ওর উপর সমীরের অভিভাবকত্বটা বেশ অনুভব করি।

গাড়িটা বাঁদিকে টার্ণ নিতেই সমীর বলে উঠল-” দাঁড়াও সৌমেন। দাদা, দাড়িটা কেটে নাও। দেখতে খারাপ লাগছে। সামনেই সেলুন।” মনে পড়ে গেল সকালে অফিসে আসার সময় দাড়ি কাটার কথা মনেই ছিল না। গাড়িটা একটু এগিয়ে দাঁড়ালো।

একদম ফাঁকা। দোকানের উপর বড় করে লেখা শিবাজি সেলুন। খটকা লাগল একটু। অবশ্য ভারতের সব প্রান্তেই ছত্রপতি শিবাজির সাহসিকতার কাহিনী বেশ প্রচারিত।

মধ্যবয়সী একজন লোক খবরের কাগজ পড়ছেন। গায়ের রঙ কালচে। চোখ, নাক, মুখ বেশ কাটাকাটা। এ অঞ্চলে এরকম গড়ন সচরাচর দেখিনি। আমি ঢুকতেই উঠে পড়লেন। বললাম-” একটু তাড়া আছে। দাড়িটা…।”
” অন্য যাগায় যাও। এত তাড়া দিবা না। বসো আগে।” বসলাম। এতক্ষণ যা ভাবছিলাম তা যে সম্পূর্ণ ভুল তা কথা শুনেই বুঝলাম। ভাষার এই টান ইউনিক। এত আপন করে নেওয়া কথ্যভাষা আর শুনিনি আমি। মিঠে, বড় মিঠে।

সামনে একটা দু’ফুট বাই তিন ফুটের আয়না। তাও বেশ পুরনো। কাঁচি, মোটা থেকে সরু হয়ে আসা নীল রঙের একটা চিরুনি, একটা ফাইভ স্টার লেখা সেভিং ক্রিম, একটা ক্ষুর, একটা ফটকিড়ি আর খুব বেশী হলে একশোটা রোঁয়া থেকে যাওয়া একটা সেভিং ব্রাশ। বুকের সামনে যে টাওয়েলটা ঝুলিয়ে দিল সেটা একটু ছেঁড়া হলেও পরিস্কার। পাশের বালতি থেকে জল তুলে নিল একটা বাঁকাচোরা বাটিতে। আয়নার ডানদিকে একটা আঙটায় কাগজ কেটে ঝোলানো আছে। আর মাথার উপর থেকে ঝুলছে একটা বাল্ব।

আয়নার উপরে তিনটে পুরনো কাঁচি পাশাপাশি তিনটে পেরেকের মধ্যে টাঙানো আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরনো। একটার হাতল ভাঙা। এখন সম্ভবত ব্যবহার হয় না। বাতিল কাঁচি অনেক সেলুনেই আমি রেখে দিতে দেখেছি।

সেভিং ক্রিম ব্রাশে লাগিয়ে গালে ঘষতে থাকলেন যতক্ষণ না ফেনা হয়। আমিও কথা বলতে থাকলাম ওঁর সাথে। একবারের জন্যও যে প্রশ্নটা সেলুনের নাম দেখে মনে হয়েছিল সেটাই করে বসলাম।
” আপনি শিবাজির ভক্ত?”
“হ্যাঁ। বাড়ির সবাই তারে মানে। আমিও। পুজো হয়।”
“শিবাজির পুজো হয়? কবে?” একটু হাসলাম।
” হাসছো কেন? তোমরা ঠাকুর পূজা করো না?” একটু রেগেই গেলেন মনে হল।
” না, তা নয়। কিন্তু শিবাজি তো আর ঠাকুর না।”
” আমাদের কাছে তাই।”
“কেন?”
ব্লেড পাল্টে নিলেন ক্ষুরের। গালের উপর বেশ অভ্যস্ত হাতে ক্ষুর চলতে থাকল। আর বলতে থাকলেন ওঁর কথা।
“আমরা সাতপুরষ ধরে ওঁর পুজো করছি। ওঁরে বাঁচানোর জন্য আমার বড় ঠাকুদ্দার বড় ঠাকুদ্দা মরছে।”
হাতের ইশারায় একটু থামতে বলে জিজ্ঞাসা করলাম- ” মানে শিবাজির সৈন্য ছিল তোমার সাতপুরষ আগের কেউ, তাই তো? সে তো অনেকই আছে এ দেশে। তাঁরা সবাই শিবাজির পুজো করে নাকি? ”
” না। আমরা তো নাপিত। আমার সাতপুরষ আগে একজন শিবাজির নাপিত ছিল।”
এইবার হো হো করে হেসে উঠলাম। বললাম-” ও,ওই জন্য নাম শিবাজি সেলুন?”
গলার স্বর বেশ ভারি করেই বলল-” বেশী কথা বল যে! শুনো আগে আমার কথা।”

উত্তর না দিয়ে শুনতে থাকলাম ওঁর কথা।

“ফজল খাঁ আর সিদ্দি জহর পানহালা দূর্গ ঘিরা রাখছিল। এই কথাখানা শুনছো?”
মনে করার চেষ্টা করলাম। বললাম ” সে তো মনে হয় 1660 সালের কথা।”
” অতো সালটাল জানিনে। সে অনেক আগের কথা তা জানি। তুমি শুনছো কি? ”
“হ্যাঁ, জানি”।
“কোলাপুরেই সেই পেল্লায় দূর্গ। সিলাহারা রাজারা বানায়ছিল। আমি সামনাসামনি দেখি নাই কিন্তু ছেলে মোবাইলে দ্যাখাইছে।”

এরপর যা শুনলাম ওঁর মুখে তাতে আমি আর টুঁ শব্দটি করতে পারলাম না।

শিবাজি অনেক চেষ্টা করেও ফজল খাঁ-কে হারাতে পারছিলেন না। আটকে থাকতে হচ্ছে দূর্গের ভিতর। খাবার কমে আসছে। ভেঙে যাচ্ছে সৈন্যদের মনোবল। তাঁর বাইরে বেরিয়ে আসা ভীষণ দরকার। ঠিক হল বিশালগড় দূর্গে নিয়ে যাওয়া হবে শিবাজিকে। কিন্তু কীভাবে? অনেক চিন্তা করে একজনকে শিবাজি সাজানো হল। বাইরে বেরিয়ে আসলেন সেই নকল শিবাজি। ফজল খাঁর সৈন্যদের হাতে ধরাও পড়লেন। বলা ভালো, ধরা দিলেন। সে যে আসল শিবাজি নন তা জানার আগেই পালিয়ে গেলেন আসল শিবাজি। আর যিনি ধরা পড়লেন? সেই নকল শিবাজি? তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল নৃশংস ভাবে এবং তিনি নিজেও নিশ্চিত ছিলেন যে, তাঁকে হত্যা করা হবে। তাঁর কথা ইতিহাসে কোথাও গুরুত্ব দিয়ে লেখা নেই। তাঁর নাম শিবা। একজন নাপিত। শিবাজির সফল রাজা হয়ে ওঠার পিছনে তাঁর অবদান কোনও অংশে কম নয়। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির পূর্বপুরুষ।

ওনাদের আদি বাড়ি মহারাষ্ট্র। গত তিনপুরুষ ধরে বাস ফালাকাটায়। কীভাবে এখানে চলে এলেন তাঁরা, তা অবশ্য জানা নেই ওঁর। কিন্তু ইতিহাসের কথায়, শিবাজির কথায় আর শিবার কথায় বেশ গর্ব আছে ওঁর। গলার স্বরে বারবার ধরা পড়ছিল তা।

দাড়ি কাটা শেষে ফটকিরি ঘষে দিলেন গালে। তোয়ালে সরিয়ে নিলেন। চেয়ার থেকে উঠে টাকা মেটালাম। বেরিয়ে আসতে যাব, বলে উঠলেন-” আয়নার উপরে যে তিনটা কাঁচি দেখতাছো সেগুলা ওনার। আমরা নিয়া আসছি। কেউ জানে না। তুমি জিগাইলা তাই বললাম। কাউরে কোও না।” কথা দিলাম ওঁকে।

ঘুরে দাঁড়ালাম। এগিয়ে গেলাম আয়নার সামনে। হাত বোলালাম কাঁচি তিনটের উপর। শরীরে যেন একটা বিদ্যুত খেলে গেল।
জিজ্ঞাসা করলাম- ” দেওগাও এখান থেকে কতক্ষণ লাগবে।”
” ঘন্টাখানেক লাগব গাড়িতে।”

বেরিয়ে আসার সময় মাথা ঘুরিয়ে আর একবার দেখে নিলাম দোকানের নামটা। সিগারেট ধরালাম। সমীরকে সামনের সীটে পাঠিয়ে পিছনে বসে প্রায়ান্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। ভাবতে থাকলাম আমাদের চারপাশে এরকম কত কত মানুষ ইতিহাসের কত কিছু বহন করে চলেছেন। নিজের যায়গা থেকে এত দূরে এসেও বাঁচিয়ে রেখেছেন এক বিশুদ্ধ ইতিহাসের কথা। কোথায় কোলাপুর আর কোথায় ফালাকাটা!

সিগারেট শেষ। গাড়িটা গতি বাড়িয়ে এগিয়ে চলল দেওগাওয়ের দিকে। আরও অন্ধকারে। এখানে সন্ধ্যা নামলেই কেন জানি বেশ শীত শীত করে। জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিতে বলল সমীর। দিলাম। গিফ্টটা গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আলোটা জ্বালাতে বলল সৌমেনকে। আমাদের দিকে পিছন ফিরে সমীর বলে উঠল-” দাদা তোমার দাড়িটা কিন্তু বেশ কেটেছে। জিজ্ঞাসা করলে নামটা শিবাজি সেলুন কেন?”
“না। ঠিক বলেছিস তো। এটা তো জিজ্ঞাসাই করা হয়নি।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।