সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৩৫)

ইচ্ছামণি

পর্ব ৩৫

অতীন বিদ্রূপ করলেও তার মনেও কি পরশমণির ফ্যান্টাসি জেগে উঠল? সব মানুষের মনেই কি এটা থাকে? দারুণ হোত না, এই আজগুবি কথা যদি সত্যি হোত? অতীন বলল, “এখন থেকে তাহলে বোকার মতো ঘরের কাজ না করিয়ে ব্যবসায়িক কাজেও লাগাও। জিনিই হোক বা দৈত্যই হোক কাজ তো সবই পারবে। জিজঞাসা করে দেখতে তো পারো।”
রুমা চিন্তায় ছেদ টানল, “সব পারে তো বলিনি। সংসারে শান্তিরক্ষার কাজটা যে পারে সে তো দেখতেই পাচ্ছ। এটাই বজায় থাকুক না। বেশি লোভ করতে গিয়ে যদি এটাও হারাই। আর তোমার মতো স্টোয়িক মানুষের তো কোনও কালে নিজের জন্য কোনও অ্যাম্বিশন ছিল না। ভালো থাকা, বেড়াতে যাওয়া, ইয়ারএন্ডে পার্টি – এসবের শখ তো শুধু আমার। তাহলে লোভ করছ যে? আমিও কি চাইনি ভেবেছ? কিন্তু ও উত্তর দেয় না। বলে – আমি শুধু তোমার কাজটা করে দেব।”
“যত্তসব গাঁজাখুরি গপ্পো। পাথর ঘষে তার অধিবাসীকে বার কর তো দেখি!”
“গাঁজাখুরি যখন, তখন এত কৌতুহল কেন? আমাদের দুজনকে একসাথে দেখাও দেবে না। বল, এটাও গাঁজাখুরি গোলতাপ্পি। রাশি রাশি ধনরত্ন এনে দিতে পারলে হয়ত গাঁজাখুরি ব্যাপার থাকত না। তোমাকে বলাটাই উচিৎ হয়নি। এর ফলে কোনও গণ্ডগোল হবে কি না, ভয় করছে। বেশ ছিলাম বাবা। তোমার তিনমাস ধরে হারিয়ে ফেলা পেনড্রাইভ ইচ্ছাই খুঁজে বার করেছে। অথচ তাকে নিয়ে এত প্রশ্ন।”
“তাহলে যত জিনিস হারিয়েছে, তাকে খুঁজে দিতে বল।”
“কী বলব, প্লীজ আমায় ঠিক করতে দাও। অন্য কারও কথা ও শুনবে কেন? অবশ্য পাথরটা যদি তোমার জিম্মায় থাকে, তাহলে তোমার কথাই শুনবে।”
“রিয়্যালি?”
রুমা কী উত্তর দেবে?
“তাহলে তুমি বেশ আরামেই আছ বল। তাতে তো শরীর আরও চকচকে হওয়ার কথা। ওজনও বেড়ে যাবে যদি এক্সারসাইজ না করো। কিন্তু তোমার চেহারায় ধকলের ছাপ কেন? চোখের কোলদুটো বসা, কালচে।”
“ওঃ! তোমার ভাবনা তোমার কাছে রোখো। কদিন সুখে আছি – কথাটা যেন আর কেউ জানতে না পারে। তুমি যা, দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ বলে কালই হয়ত পুলিস-গভর্নমেন্ট সর্বত্র খবর করে দিলে। আমার আরাম দেখে তোমার এত হিংসে?”
“মাথা খারাপ? লোকে আমাকেই পাগোল ঠাওরাবে।”
চুপচাপ খেতে খেতে অতীন বলল, “ধরে নিচ্ছি তোমার কথা সত্যি। তাহলে ইচ্ছামণিকে আমায় দুদিনের জন্য ধার দেবে? আমার অফিসে কাজের পাহাড় জমে আছে। তার ওপর টেম্পোরারি ডিউটির জন্য আবার বেরোতে হবে। পেমেন্ট উইক। ইচ্ছা না কি যেন, ও গিয়ে আমার বদলে এই উইকটা অফিসের কাজ সামলে দিক। আমিও দুদিন তোমার মতো আরাম করে নিই। চাও তো বাড়ির কাজে ইচ্ছার প্রক্সি দেব। মানে সব না, হাতে হাতে যেমন সাহায্য করি, তেমন আর একটু বেশি করে করে দেব।”
 “কেন? তোমার তো অফিস অন্ত প্রাণ। হঠাৎ ভাবান্তর? অফিসের কাজ, তাও একরকম। সংসারের কাজ কতটা টায়ারিং একটু আধটু ঠেকজোড়া দিয়ে তুমি বুঝবে না। মেয়ের পেছনেই অর্ধেক শক্তি বেরিয়ে যায়। ইচ্ছাকে বললে হয়তো করে দেবে, কিন্তু ওর খাওয়া, স্নান, হাগু, পড়াশুনো – এগুলো তো এখনও আমায় দেখতে হয়। ইচ্ছা শুধু আমার ঘরকন্নাটুকু সামলে দেয়। সেটাও বড় হেল্প। না হলে ঘর এমন ঝকঝকে আমি রাখতে পারতাম না।”
“আমার কাজ টায়ারিং নয় বলছ? সকাল দশটা থেকে কম্পিউটারের সামনে বসি। লাঞ্চ করার সময় পাইনা। চোখ কর কর করছে, জল ঝরছে; তবু শিডিউল টাইমে রিপোর্ট বার করতেই হবে, প্রতি মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে ইন্ডাস্টরিয়াল এমপ্লয়িদের পেমেন্ট বিল বার করতেই হবে, দশ তারিখের মধ্যে ওটি বোনাস ক্যালকুলেট করে ফেলতেই হবে। দেরি হলে বা পেমেন্ট কম হলে ভেবো না নচিকেতার ‘সরকারি কর্মচারী’ হয়ে রেহাই পাব। আট হাজার ফ্যাক্ট্রি ওয়ার্কার গেটে জমায়েত হলে জিএম-এর প্যান্ট ভিজে যায়। তাও যদি ফ্যাক্টরির দেওয়া প্রাইমারি ডেটা নির্ভুল পাওয়া যেত। অথচ অ্যাকাউন্টস্‌ স্টাফ বলে আমাদের আগে তলব করা হবে। তার মধ্যে একবার এ ডেকে পাঠায়, তো একবার ও এসে কোনও সমস্যা নিয়ে হাজির হয়। চোখ দেখানোর ছুটিটাও পাচ্ছি না। শনি রবি সংসারের হাজারটা কাজ। তুমি তবু দুপুরে শুতে পাও। সকালেও ঘুমোও। এখন তো তোফা আছ। আমার একটানা আট-ন ঘণ্টা চেয়ারে বসে শিরদাঁড়ায় পেইন হয়। এর মধ্যে বড় সাহেবরা ডেকে পাঠালে হয়ে গেল। অনেকেই  কম্পিউটারের বেসিক ব্যাপারটাও বোঝে না, অথচ যা হোক একটা হুকুম করলেই হল। ডাইরেক্ট ক্লাস ওয়ান অফিসার হয়ে এসে আমাদের মাথা কিনে নিয়েছে। এক একজন তো নিরেট গোঁয়াড় আর হামবড়া। কিচ্ছু শুনবে না, কিচ্ছু বুঝবে না। ভাবে কম্পিউটার বুঝি ম্যাজিক করতে পারে। কী ইনপুট দিলে কোন প্রসেসে কী আউটপুট বেরোবে সেসব বোঝার দায় আমাদের মতো ফ্রন্টলাইন অফিসারদের।”
“তাহলে বাপু ইচ্ছাকে বিপদে ফেলা কেন? বরং তুমি ছুটি নিয়ে নিজের চোখ চোখ তো অনেকদিন করছ, দেখিয়ে নাও। অর্থোপেডিকও কনসাল্ট করো। ইচ্ছা সংসারের আনক্সিল্‌ড কাজগুলো পারে। বললে হয়ত ভালো মালিশ মলম বানিয়েও দিতে পারে। কিন্তু তোমার অ্যাকাউন্টস্‌এর মাথামুণ্ডু কি বুঝবে?”
“রান্না কিন্তু আনস্কিল্‌ড লেবার নয়। এনি ওয়ে, বুঝবে কিনা, ওকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখেছ? ও তোমায় কী বলেছে? ও যখন যার অধীনে, তখন তার হুকুম তামিল করবে। দুদিন আমার মালিকানায় থাকলে আমি তো তোমার পাথর নিয়ে পালিয়ে যাব না।”
“তোমাদের ডেপুটি কন্ট্রোলার শুভ্র সামন্ত, যে তোমার ভাগ্নের বয়সী হওয়া সত্বেও তোমায় নাম ধরে তুমি করে কথা বলে, আর তুমি স্যর আপনি আজ্ঞে কর – সে কোনও হেল্প করতে পারছে না?”
“দেখো, ডাইরেক্ট আইএএস অ্যালায়েড পাস করে সে জয়নই করেছে অ্যাসিসটেন্ট কন্ট্রোলার হিসাবে। যে যেমন পজিশনে আছে, তাকে তার মর্যাদা তো দিতেই হবে। সিনিয়রকে সিনিয়র বলে মানতে পারলে না বলেই তুমি টেলিকলিং-এর চাকরিতে টিঁকে থাকতে পারলে না। ঐ কেমিকাল কোম্পানিতেও তোমার সেই ইগো প্রবলেমটাই মেইন ইশ্যু হবে দাঁড়ায়। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে, যেখানে কেউ আমার চাকরি বা প্রমোশন খেতে পারবে না, সেখানেও কিছু ডেকরাম মানতেই হয়। কথা হচ্ছিল তোমার ম্যাজিক পাথর নিয়ে। পড়লে শুভ্র সামন্তকে নিয়ে। ছেলেটা সত্যিই আমার ওয়েল ইউশার। কথা ঘোরাচ্ছ?”
“বেশ। জিজ্ঞাসা করব, ইচ্ছা আমাদের ভাগাভাগি মালিকানা মেনে নেবে কিনা। আমার সারাটা জীবন ফ্রাস্ট্রেশনে ভরা। কত ব্রিলিয়ান্ট কেরিয়ার হওয়ার কথা ছিল, একের পর এক ভেস্তে গেছে। কোথায় কেলেজে পড়ানোর মতো রেস্‌পেক্টেবল কাজ পেয়েছিলাম, তোমার দাদা – যাই হোক হল না। বাধ্য হয়ে মাঝ পথে রিসার্চ ছেড়ে দিলাম। বিয়ের সাত বছর পর কেঁচে গণ্ডুষ করে ডাব্লিউ.বি.সি এস-এর প্রিপারেশন নিয়ে কোয়ালিফাই করলাম; তোমার পরামর্শে এমন চয়েস পোস্টিং দাগালাম যে ইন্টারভিউ বোর্ডের কেউ কনভিন্সড্‌ই হল না। আরে জয়েন্ট বিডিও বেশি সম্মানজনক তো কী হয়েচে, নিজের বৌকে চেনো না? ডিপ্লোমেসির ধার ধারে না। ও চাকরি পেলেও ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হয়ে যেত। বেলেঘাটায় কমার্শিয়াল ট্যাক্স অফিস ফার্স্ট চয়েস দিলে অত ট্যারাব্যাঁকা প্রশ্নের সম্মুখীন না হতেই হোত না, ওরাও কনভিন্সড্‌ হোত। চাকরিটা হয়তো হয়ে যেত।”
অতীন জানে পেশাগত হতাশায় অতীন ও তার পরিবারকে একবার না একবার রুমা কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই। মাথা নীচু করে বলল, “হ্যাঁ, তোমার সব দুর্ভাগ্যের জন্য তো আমি আর আমার বাড়ির লোকেরা দায়ী। বিয়ের আগে বিরাট হোমরা চোমড়া চাকরি করতে কিনা। তোমার ম্যানেজমেন্ট কলেজে জয়েন করার কথা ছিল বলেই কিন্তু আমি প্রিপেয়ার্ড না থাকা সত্ত্বেও আমি মে’র বদলে জানুয়ারিতে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম, চাকরি পেয়ে জামশেদপুরে থাকলে কোথায় থাকবে সেই কথা ভেবে।”
রুমা বলে চলল, “ঐ চাকরি তো তুমি খাওনি। কিন্তু তুমি আমাকে বিয়ের পরে পরে জামশেদপুরে থাকার সময় একবারও ইন্সটিটিউটে নিয়েও যাওনি। তখন আমাকে চক্ষূকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করতে দিলে কথা উঠত না। তখন গরম থাকতে থাকতে খোঁজ নিলে না, নিতেও দিলে না। দু বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর তোমার মনে হল, ওখানে চিঠি লিখে পুরোনোও রেফারেন্স দিয়ে আবার অ্যাপ্রোচ করি। বাদ দাও। আমি আমার ভাগ্যের কথা বলছি। ছোটবেলা থেকে চাপা শখ, সেই অভিনয় করতে গিয়ে কত রকম ছ্যাঁচড়ামি দেখলাম। আমায় লিখতে বলতে। মানে আমার ডাইরিতে তোমার অ্যালার্জি ঠিকই, কিন্তু লিখতে তো তুমিও উৎসাহ দাও, মা বাবাও দেয়। সেখানেও তো দেখছ কত রাজনীতি, নোংরামি, ব্যাকস্ট্যাবিং। কিছু লিটিল ম্যাগে লেখা ছাপানোর প্রিরিকুইজিট হল বিজ্ঞাপণ যোগাড় করে দেওয়া। ভালো জায়গায় দলাদলি। কোথাও শান্তি আছে? কদিন একটু আনন্দে আছি, সহ্য হচ্ছে না? বাড়ির কাজগুলো ঠিকমতো হলে তো তোমারও সুবিধা। তোমার কাজটা তো তুমি ভালোই ম্যানেজ করতে পারো। জানি প্রচণ্ড চাপে থাকো। ঠিক আছে, বলছ যখন, ঐ মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে দেখব। মেয়েটা বলছি কেন? ও যদি তোমার মালিকানায় থাকে তাহলে তো তোমার মতো দেখতে হয়ে যাবে, একেবারে রেপ্লিকা।”

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।