সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শক্তিনাথ ভট্টাচার্য্য (পর্ব – ১০)

হোয়াটস্অ্যাপে পরকীয়া -১০

(সারাদিন আর উত্তর দিতে ইচ্ছে করেনি অর্কপ্রভর…  রাতে লিখল…)

—   এটাই এই অধ্যায়ের শেষ লেখা।
দুটি প্রশ্নের উত্তর আমার দেওয়া হয় নি :

১) দু’ বছর আগে এমনই এক অধ্যায়ের সূচনা হওয়া সত্ত্বেও কেন আমি আর যোগাযোগ রাখিনি ;
২) কী এমন চেয়েছিলাম যা ‘সামলানো’র চ্যালেঞ্জে কিছু ‘পুরস্কার’ বা ‘শাস্তি’ পাবার কথা উঠেছিল।
এর মধ্যে আরো দুটি তীক্ষ্ণ বাণ এসে বুকে বিঁধল। আমি রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছি। তারও উত্তর দিতে হলো।
আমার ‘চাওয়াপাওয়া’কে রহস্যাবৃত করে রাখায় ‘আপনি’ ( হ্যাঁ, ‘আপনি’ বলাই এখন  যথাযথ ) বলেছিলেন : “কী চাও বলতো…..!? দেখি কত অকপট হতে পার!?”… (ভাবা যায়!) ; এর সঙ্গে অনেক রোমাঞ্চকর, আকর্ষক ( provocative!) কথাবার্তা ছিল ; সেগুলিকে এখন ‘মজা’ বলছেন। অথচ, আমি তার উত্তর না দেওয়াতে ক্ষোভ, অভিমান উগরে দিয়েছেন।
জানেন কি, মজা আর ছলনায় কিছু পার্থক্য থাকে ! বলেছিলাম না, বুদ্ধি দিয়ে বেশী খেললে ছলনা  মিশে যায়!! ‘অকপট’ভাবে কেউ যদি আপনার ওই প্রশ্নের উত্তর দিত, তাহলে সেটা আপনার চোখে আর ‘মজা’ মনে হত না, ‘অন্যায়’ মনে হত…  ‘আপত্তিকর’ মনে হত। কিন্তু, কিছু না বলা সত্ত্বেও, আপনি আমার ওপর ‘দুদিনের সাক্ষাতে সহবাসের ইচ্ছা’ কিংবা ‘একরাশ অতৃপ্তি নিয়ে অভিসন্ধিমূলক ভালবাসার অভিনয়’ (এটি হয়তো নিজেকে নিয়েই বলেছেন, কিন্তু অন্যকেও বেঁধে) প্রভৃতি আরোপ চাপিয়ে দিতে পারলেন!!!
আপনাকে তো জানানোর সুযোগ হয় নি যে , আমার একজন ‘রাধারানী’ও আছেন ( হ্যাঁ, এই অধ্যায়ের কথা তাঁর অগোচরেও হচ্ছিল না) ; তাঁর নাম  ‘মণিকর্ণিকা’।… অনেক অনুরাগিণীও আছেন (গোপিনী বলতে পারেন !… তবে,’ভীড়’ নয়, যেমনটা বলেছিলেন), যাঁরা আমার ওপর প্রশ্নাতীত ভরসা রাখেন!! কিন্তু, আমি তো আপনার মধ্যে ’মীরাবাঈ’কে খুঁজে পেতে চেয়েছিলাম! আপনার মধ্যে আমি যে সেই সম্ভাবনা দেখেছিলাম!! আমার তো আর কোন ‘শ্রীরাধা’র প্রয়োজন ছিল না!
রাধারানী আর মীরাবাঈ কেউ তো কারুর পরিপূরক নয়, তাদের মধ্যে বিরোধিতাও নেই!! অথচ, দুজনেই একই সত্ত্বাকে কেন্দ্র করে আলাদা ভূমিকায়, আলাদা দূরত্বে থেকে গেছে… আবহমানকাল… সংঘাতও  নেই !! তাই, মীরাবাঈ হিসেবেই ভেবেছিলাম।
বলেছিলাম তো ‘কুলুঙ্গীতে ধূপধূনো দিয়ে পূজো করলেও আপত্তি নেই!’ আপনার ‘যা ইচ্ছে সেটাই হবে ‘!!
আমি ‘দুদিনের ভালবাসার খেলা’ খেলতে চাই নি তো!!  সারা জীবনের একটা পরিক্রমা তৈরি করেছিলাম যে!! এখুনি সেটা বলবো। এর সঙ্গেই প্রথমে উল্লিখিত প্রশ্নের উত্তরগুলি জড়িত।
আমি যদি আপনার বহিরঙ্গের প্রত্যাশী হতাম, তাহলে দু’বছর আগে ছেড়ে চলে আসতাম না। সে সময়ও বলেছিলাম, আপনার গান, কথাবার্তা,  ভঙ্গিমা ভীষণ ‘আগ্রাসী’। যে কোন সাধারণ মানুষ তাতে ঘায়েল হতে যেতে পারে। অবশ্য, অতি সুচতুর ব্যক্তি উলটোটাও করে যেতে পারে। কিন্তু, আমি তো খুব সাধারণ বা সুচতুর নই ; তাই, আমি শুধু রূপপিয়াসী নই, রূপের পূজারীও। রূপের মধ্যে দিয়ে ‘অরূপরতনের’ সন্ধানই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, সেই সময়ে, আপনার কন্ঠের সপ্রেম অভিব্যক্তি, লেখা, আমার প্রতি একটা অনুরাগ বা inclination (আজ মনে হচ্ছে ‘মজা’ও হতে পারে) সব মিলিয়ে কেমন মনেহয়েছিল, আমার সরে আসা উচিত, নয়তো একটা সুখী সংসারে চিড় খেতে পারে, অবিশ্বাসের বাতাবরণ গড়ে উঠতে পারে। সরে এসেছিলাম। সেই জন্যেই তো আজ দুবছর পরে আপনি প্রশ্ন করেছেন ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ এমনকি, আজও আপনি ‘সাহস’ করে আমায় ফিরিয়ে এনেছিলেন।
তৃপ্ত মনে হয়েছিল ; কেননা ‘মীরাবাঈ’ তো জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক !!… তার গভীর, ‘নিষ্কাম, নির্দ্বন্দ্ব’ প্রেমনিবেদনের অমোঘ টান তো “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে” অধরাকেই ছুঁয়ে থাকে !!
কী মনে হচ্ছে?  – ‘অতৃপ্ত আশার অভিসন্ধিমূলক  ভালবাসার অভিনয়’!… ‘দুদিনের সাক্ষাতে সহবাসে’র ইচ্ছা !!
ইস্, আপনি ‘অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ’ দিলেন ; আমাকে হারিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষায়  নিজেও কি হেরে গেলেন না, ছোট হয়ে গেলেন না!! অবশ্য সেটা ব্যক্তিগত চেতনা!
আপনার বহিরঙ্গের প্রতি লোভ থাকলে সরে আসতাম না ; ছলে বলে, কৌশলে থেকে যেতাম। কিন্তু আমি আপনার অন্তরঙ্গে মুক্তোর সন্ধান পেয়েছিলাম। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেটার দাবীদার মনেকরেছিলাম। মনেহয়েছিল, আপনার যা কিছু ব্যথা, বেদনা, চাওয়া, না-পাওয়া (যেগুলিকে এখন ‘মজা’ বলে চালাতে চাইছেন) সবই আপনার অন্তরঙ্গের বহিঃপ্রকাশের অভাবজনিত। সেইখানেই আমার ‘চাওয়াপাওয়া’, ‘পুরস্কার’ এবং ‘শাস্তি’র চিরজীবনের একটা পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু রহস্যটা বলার জন্য আর একটু সময় দরকার ছিল। সেটারও ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু, সেই সময়টুকু পাইনি।
এবার সেই পরিকল্পনাটা শুনুন।
(অর্কপ্রভ লিখে চলছিল….)
জানেন, পরিকল্পনাটি বড় অদ্ভুত… রোমাঞ্চিত হবার মত তো নয়ই…  কাজেই, ‘মজা’ও নেই… যদি কিছু থাকে, সে এক প্রবল ইচ্ছাপূরণ!
আপনার সঙ্গে এই কথোপকথনের ভিত্তিতে মনের দেওয়ালে আলোআঁধারি ছায়া ছায়া কিছু আঁকিবুঁকি বিচিত্রভাবে রূপ পরিগ্রহ করছিল। ফেসবুকে এবং বাস্তবে অনেক নারীর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের interaction তো হয়েছেই… অনেকেরই যেমন হয়… আপনার মতই! তাতে, তিক্ততা, প্রতারণা, তর্কবিতর্ক, বিচ্ছেদ প্রভৃতির সঙ্গে সঙ্গে ‘নির্দ্বন্দ্ব, নিষ্কলুষ’, ভালবাসাগন্ধী অভিব্যক্তিও তো থাকত!!… আপনার ক্ষেত্রে সেগুলি একটি পরিপূর্ণতার দিকে এগোচ্ছিল। এই উপকথনের মাধ্যমে জীবনের একটি অপ্রকাশ্য নিরুচ্চার  রহস্যযাপন (পরকীয়া) উন্মোচন করার বাসনা হয়েছিল। শুধু কাল্পনিক লেখাতে নারীমনের অদেখা অপার সৌন্দর্যটি তার চেতনার উদ্ভাসে ও প্রেমের স্নিগ্ধ বিভায় হয়তো সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা যেত না। তার বেদনা, অবহেলা, আকাঙ্ক্ষা, প্রেম, আত্মপরিচিতি প্রভৃতি অনেককিছুই, কোন পুরুষের পক্ষে বোধহয় সম্পূর্ণভাবে বোঝা সম্ভব হয় না! বুকে ঢেকে রাখা সে কাহিনী উন্মোচিত হতে গেলে দুজনের প্রয়াসে একটি নিভৃত বাসর রচনার প্রয়োজন হয়। আপনার লেখার ঝাঁঝে এবং উচ্ছ্বাসে সে ‘সহবাসের’ সম্ভাবনা উঁকি মেরেছিল… হ্যাঁ, ‘দুদিনের সাক্ষাতেই’!
আমাদের এই ‘মেলামেশা’র ফলশ্রুতি হিসেবে একটি নবজাতক আসবে না, তা কি হয়!!… সেটাই তো চেয়েছিলাম!!… যার ঝক্কি ঝামেলার ( পরকীয়াজাত তো!!) সবকিছু আপনার ঘাড়ে থাকবে… আর, সমস্ত দায় নিয়ে আমি তার আত্মপ্রকাশের ব্যবস্থা করবো।…  আপনি আমার সেই অবৈধ ‘চাওয়ার’ ঝামেলা ‘সামলাতে’ পারবেন কিনা, সেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলাম।
একটি উপন্যাসের জন্ম দিতে চেয়েছিলাম।
‘রাধারাণী’ও এই পরিকল্পনার কথা জানেন এবং তিনি এর পৌরহিত্য করতেন, এমন কথাই হয়েছে।
এই চ্যালেঞ্জের ‘পুরস্কার’ হিসেবে ভেবেছিলাম, আপনার নামেই সে উপন্যাসের পরিচিতি স্বীকৃত হোক ( কারণ, মহিলাদের নামে তাড়াতাড়ি স্বীকৃতি আসে, শরৎচন্দ্রের আমলেও তাঁকে মহিলার ছদ্মনাম নিয়েই লেখার স্বীকৃতি পেতে হয়েছে )… আপনার সারাজীবন তাতে গৌরবান্বিত হয়ে থাকুক।…  একবার অন্তরের আলো ছড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে পারলে, আরেকটি আশাপূর্ণা দেবী বা সুচিত্রা ভট্টাচার্য তৈরী হতে পারত… আইডেন্টিটি বা আত্মপরিচিতি প্রকাশের সে সম্ভাবনা আপনার মধ্যে ছিল… আমি তো তার গৌরব উপভোগ করতামই!!
আর যদি, সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা না-ই হল,  যদি তা কোন সন্তানের জন্ম না-ই দিল, তাহলে এসব কল্পিত প্রেমের বাস্তবিক প্রাপ্তিই বা কী রইল!? প্রেমের যে আগুন জ্বালাতে চেয়েছি, সেটাতে পুড়ে না গিয়ে আলোকিত করে তুলুক না চারপাশটা!!
কিন্তু, সেটা যদি না হয়, সে ক্ষেত্রে, ‘শাস্তি’ হল, ‘আমার চলে যাওয়া’।….  শেষপর্যন্ত, সেটাই অবশ্য হল।
কী মনেহয়!?… বলেছিলেন,  ‘আপনারা পুরুষরা শুধু নারীর শরীরই বোঝেন’ !!…  আমার এই ‘চাওয়া’টা যে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী ছিল !!… শরীর তবু দুর্লভ নয়, কিন্তু, এ তো সহজে পাওয়া যাবে না!!
মীরার ভজনে, ‘বুকের বোতাম’ খুঁজে পাওয়ার আনন্দময় সংকেতের হাতছানিতে সন্তুষ্ট হওয়ার উপযুক্ত, আমি বোধহয় ছিলাম না!! হয়তো, আমারই ভুল হয়েছিল বুঝতে !!
বুঝেছি  না যত
না-বোঝার বোঝা  ছিল তার শতগুণ,
অন্তরে দীপ জ্বালাতে চেয়েছি —
গ্রাস করেছে আগুন।।
*   * *    * *
(কিছুক্ষণ পরে মোহনা সাড়া দিল )
—   শুধু এটা পড়লাম…  বাকি গুলো এখন পড়তে পারছি না…  যেতে হবে মেয়েকে আনতে…!
বাকিটা এসে পড়বো…!!
তবে একটা কথা শুনুন…  আমার ভালোলাগার মানুষটিকে…  হয়তো ভুল বোঝাবুঝি বা সাময়িক হতভম্বতা বা রাগের কারণে…  আমি যদি যা খুশি তাই বলতেই না পারলাম… তবে আর ভালোবাসার সার্থকতা কোথায়…!?
(অর্কপ্রভর তরফে কোন উত্তর না পেয়ে দুঘণ্টা পরে মোহনা আবার লিখল…)
—   আপনার রাধারানী,  গোপিনী সবাই থাকুক…  আমি তো জানতে চাইনি কিছু…  আর না-ই কারোর অধিকারে আমার ভাগ বসানোর ইচ্ছে আছে….  আসলে ছিনিয়ে আজ পর্যন্ত কিচ্ছু নেওয়া যায়নি… যায়ও না…  তাই সেই অভিপ্রায় আমার নেই….!
সকাল থেকে ভারি কষ্ট হচ্ছিলো…  বার বার হোয়াট্সঅ্যাপ খুলে দেখেছি…  মনে হয়েছিলো বলি… ” এত নিষ্ঠুর যে একটি উত্তরও দেওয়া যায় না…!? “…  কিন্তু বলিনি…
ডিপিটা খুলে গালে দুটো চুমু খেতে মনে হলো…  ভালোবাসা আসলে ভারি নির্মল… তাতে শুধু স্নেহ আছে…  পাপ নেই… ভুল বোঝাবুঝি টুকু তাই আর প্রখর হতে পারলো না…
আমি মিথ্যে বলিনা…  জানালাম… বিশ্বাসের গুরুভার নেই কোন…  তবু জানালাম…
জানি না গৃহীত হবে কিনা…  তবু লিখলাম…
আপাতত যাচ্ছি…!
( অর্কপ্রভ মোহনার কথায় কোন গুরুত্ব না দিয়ে সারাদিনের পরে বাড়ী ফিরে লিখল…)
—    শেষ কথা বলে বিদায় নেবো।
ভালোলাগাটুকু মুক্তো হয়েই থাকুক ঝিনুকে
না-লাগাটুকু পড়ে থাক বালুচরে,
জীবন সে তো বলা না বলার কথামালা
কিছু পড়া যায় কিছু থেকে যায় অগোচরে!!
জানি তো সেকথা বলা রয়ে যাবে বাকী
সময় খুঁজবে অসময় কানাগলি…
গোপন জবানবন্দীতে রাজসাক্ষী
রক্ত দিয়ে তো সাজিয়েছে রঙ্গোলী!!
জানেন,
সব পুরুষ সমান নয় (সব নারীও নয়)। ‘ফেসবুকীয় অভ্যাসে’ নিজের সৌন্দর্যকে তারিয়ে উপভোগ করার জন্যে লালায়িত দৃষ্টিসম্পন্ন পুরুষের আয়নাও যেমন আছে, তেমনই আপনাকে সৌন্দর্যময়ী করে তোলা পিতাও একজন পুরুষ, সেই সৌন্দর্যকে আবৃত করে রেখেছেন যিনি, তিনিও একজন পুরুষ। কাজেই সব পুরুষ একইরকম নয়। আমিও নই, তাহলে দু বছর আড়ালে থাকতাম না।
এ ক’দিনের অভিঘাত বড় কম নয়! কোন কম বয়সী অনভিজ্ঞ পুরুষ হলে হয়তো আত্মঘাতী হয়ে যেতেও পারতো!! কিন্তু এই অভিঘাতের রেশ থেকে যেতে পারে আপনার জীবনেও।
বিদায়, চিরবিদায়।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।