গল্পের বড়দিনে উজ্জ্বল দাস

খ্রিষ্টমাস

|| ১ ||
– ক্রিং ক্রিং ক্রিং,,,,,,, ক্রিং ক্রিং ক্রিং,,,,,
বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে বেরোনোর সময় সদরের তালাটা লাগাতে লাগতেই ঝন ঝন করে বেজে উঠলো মজুমদার বাড়ির ড্রইংরুমের ল্যান্ডলাইনটা। আবার বাড়ির ভেতরে ঢুকে মজুমদার বাবু ফোনটা তুললেন-
– হ্যালো!
– হ্যাঁ বাবা, আমি সুফল।
– আচ্ছা , এবছরেও তিতলি মিসিং তাই তো!
– হ্যাঁ বাবা।
– কী আর করা যাবে এখন। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
-আপনারা বেরিয়ে পড়বেন তো এক্ষুনি?
– বেরিয়েই পরে ছিলাম। আবার ভেতরে ঢুকে ফোনটা ধরলাম। আচ্ছা রাখি তাহলে এখন।
বলে ফোনটা রেখে দিলেন মজুমদার বাবু।
উপায়ই বা কী? প্রত্যেক বছর এভাবেই তিতলি তার হাজবেন্ড সুফলকে একটা চিঠি লিখে উধাও হয়ে যায় হঠাৎ। হয় বাড়ি কিংবা অফিস থেকে না বলেই। বাবা, মা কাউকেই সে জানায় না যে, সে কোথায় যায়। আবার ফিরে আসে ডিসেম্বর শেষ নাগাদ। বহুবার জিজ্ঞাসা করেও কোনো সদুত্তর না পাওয়ায় সবাই তাদের কৌতূহল নিবারণ করেছে অবশেষে।
|| ২ ||
মজুমদার দম্পতি ছোট্ট মেয়েটাকে এক প্রকার আস্তাকুঁড় থেকে কুড়িয়ে এনেই নিজেদের মেয়ে হিসেবে বড় করছেন। ছোট্ট তিতলি অতীব সচ্ছল পরিবারে মজুমদার বাড়ির মেয়ে হয়ে কাটিয়ে দিয়েছে বহু বছর। সত্যি কথা বলতে মজুমদার কত্তা বা গিন্নি তিতলিকে কোনদিন তার জন্ম বৃত্তান্ত লুকোননি উল্টোদিকে তিতলিও তার বাবা মায়ের অভাব বিন্দুমাত্র অনুভব করেনি।
আসা যাক আসল কথায়। সালটা ১৯৮০। আর ২০২০ তে দাঁড়িয়ে তিতলির বর্তমান বয়স খুব সহজেই অনুমেয়। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে মধুচন্দ্রিমা করতেই মজুমদার দম্পতির বিয়ের পর প্রথম দার্জিলিং যাওয়া। প্রায় সদ্যোজাত তিতলিকে পাওয়া সেখানেই। পরম অপত্য স্নেহে তিতলিকে বড় করার পাশাপাশি তারা তাদের নিজেদের সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর একজন আদর্শ মানুষ তৈরি করে তার অন্তরাত্মা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন তাদের সন্তানের মধ্যে। যেদিন থেকে তিতলি তাদের বাড়িতে এসেছে তারপর থেকে বেশ কয়েক বছর ডিসেম্বর মাসে ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে তারা দার্জিলিংয়ের সেই হোমে আসতেন ঠিক যে হোমের বাইরে থেকে পড়ে থাকা তিতলিকে কুড়িয়ে এনেছিলেন তারা। আর ওখানেই তিতলির জন্মদিন পালন হতো ডিসেম্বর মাসে সমস্ত অনাথ দুঃস্থ শিশুদের নিয়ে। এখন সেই হোমে অন্তত আশিটি অনাথ শিশুর বাস। কালক্রমে প্রত্যেক বছর সেই হোমে এখন আর আসা হয় না তাদের।
|| ৩ ||
মজুমদার দম্পতির ক্রমশ বয়স হয়েছে। ছোটবেলা থেকে তিতলি প্রত্যেক ডিসেম্বর মাসে সান্তা ক্লজের থেকে নানা রকম উপহার পেয়ে আজ এত বড় হয়েছে। বাবা মা কখনো তিতলিকে বুঝতে দেননি যে আদৌ সেই উপহার তাঁরাই তিতলির ঘুমের সময় মাথার কাছে এসে রেখে দিতেন। আজ বড় হয়েও তিতলি সেই সান্তার ওপর আস্থা রাখতেই অভ্যস্ত। আবদার, বায়না সবটাই এখনো পুরোটা তার বাবা মা। যদিও সেদিনের ছোট্ট মেয়েটা আজ বিবাহিত এবং দুই সন্তানের মা।
অনেক বয়স হয়ে যাবার ফলে তিতলির বাবা-মা এখন আর তেমন বেড়াতে যান না। কিন্তু এবছর হঠাৎই তাদের মনে হলো তারা শেষ বারের জন্য হলেও একবার দার্জিলিংয়ের সেই হোম থেকে ঘুরে আসবেন সঙ্গে একটু এদিক ওদিক সময়ও কাটাবেন। যদিও এই সিদ্ধান্ত একটু সাহসী সিদ্ধান্ত বলেই মনে করলেন নিজেরা।
যথারীতি ভাবা মাত্রই কাজ। ২৫ শে ডিসেম্বর অরফেনেজে কাটানোর উদ্দেশ্যে পৌঁছে গেলেন তাদের পরিচিত গন্তব্যে দুদিন আগেই। ২৩ আর ২৪ তারিখ একটু পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখার পর পঁচিশ তারিখ বড়দিনের যাবতীয় খাবার-দাবার, কেক, মোয়া, কমলা লেবু, ড্রাই ফ্রুটস, জামাকাপড় টুপি সমস্তটা নিয়ে পৌঁছোলেন সেই হোমে।
ঢোকার আগেই বড় মত একটা লোহার গেট। হোমের সাইন বোর্ডের ওপর দুদিকের দুটো গাছের পাতা ভরা ডাল ঝুলে এসে পড়েছে। বাম দিকে একটা বিরাট বড় নোংরা ফেলার জায়গা । আর সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন দুজনে আর চোখের পাতা ভিজে দুগাল বেয়ে যেন অকারণেই অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। মনে মনে ভাবলেন তাদের মেয়ে যত বড়ই হোক বা মানুষ হোক এই হোমে তারা না আসতে পারলেও তাদের তিতলি তো একটু ঘুরে যেতে পারে এখান থেকে। দুঃস্থ শিশুগুলোর কথা ভেবে তারা বড় বিমর্ষ হয়ে পড়লেন।
|| ৪ ||
ভাবতে ভাবতে হোমের ভেতরের রাস্তায় হাঁটা শুরু করলেন দুজনে। উঁচু নিচু পাহাড়ী রাস্তা কেটে কেটে তৈরি হোমের ভেতরের বাগান, চলার পথ, থাকার জায়গা। দেখলেন চারদিকে খ্রিস্টমাস ট্রি দিয়ে সাজানো। শ্রুতি মধুর একটা বড়দিনের গানের তাল বেজে চলেছে গোটা হোম জুড়েই। একটা খুশি খুশি আমেজ গোটা পরিবেশে ছেয়ে। তাদেরও এই বার্ধক্যে এই পরিবেশ পেয়ে মনটা বেশ ভালো হয়ে গেলো। আরোও এগিয়ে এলেন ভেতরে। ফাদারের বসার অফিসে দেখা করতে গিয়ে দেখলেন চেয়ার ফাঁকা। ক্রমশ প্রার্থনা হলের দিকে এগোতেই চোখে পড়লো ছোট ছোট বাচ্চাদের হাসি মজা গল্পে মেতে ওঠা এক স্বর্গীয় পরিবেশ। সবার মাথায় লাল টুপি। পরনে সবার লাল রঙের সান্তার পোশাক। সবাই খুব খুশি হয়ে হাতের প্লেটের কেক, কমলা লেবু, মিষ্টি, চকলেটস খেতে ব্যস্ত। তবে মুখোশ পরে থাকায় মুখ দেখা যাচ্ছে না কারুরই। সঙ্গে আরও বেশ গোটা জনা পাঁচেক প্রাপ্ত বয়স্ক সান্তা। হাতে বিভিন্ন রকমের জিনিস নিয়ে মিশে গেছেন ওই শিশুদের সাথে।
মজুমদার দম্পতিও ক্রমশ তাদের সঙ্গে তাদের আনন্দে মিশে যাবার চেষ্টা করলেন। মেতে উঠলেন কচিকাঁচাদের সঙ্গে তাদের উৎসবে। বেশ খানিকক্ষণ এভাবে চলার পর একজন প্রাপ্তবয়স্ক সান্তা কে দেখলেন হাঁপিয়ে গিয়ে বসে পড়েছেন একটা চেয়ারে। মুখোশটা খুলে ফেলতেই দেখলেন তিনি হোমের ফাদার। তখন মিস্টার এন্ড মিসেস মজুমদারও গিয়ে বসলেন ওনার পাশে। বহু বছর পর দেখা হওয়ায় আর চেহারায় পরিবর্তন হওয়ায় ফাদার কে নতুন করে নিজেদের পরিচয় দিতে হলো তাদের। ফাদারের মুখ চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল খুশিতে, আনন্দে। দু-চার কথায় কুশল বার্তা বিনিময় সেরে নিলেন নিজেদের। ফাদার হোমের একজন কর্মচারীকে দুকাপ কফি এনে দিতে আদেশ করলেন। শীতের আমেজে দার্জিলিংয়ে পাহাড় ঘেরা হোমে বসে গরম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে তারা নানান রকম পুরনো গল্প, স্মৃতিতে মশগুল হয়ে পড়লেন। আরো কিছু কথা বলে নিজেদের আনা উপহারগুলো মজুমদার দম্পতি অনাথ শিশুদের উদ্দেশ্যে রেখে বিদায় চাইলেন ফাদারের কাছে। তারপর প্রার্থনা হলে ঢুকে ঈশ্বরের কাছে তাদের মেয়ে তিতলির জন্য প্রার্থনা করলেন, এবার ধীরে ধীরে পেছনে ফিরলেন হোম থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্য।
কয়েক পা হেঁটেছেন গেটের বাইরে যাবেন বলে। পেছন থেকে দুটো আস্থাভাজন হাত এসে জড়িয়ে ধরল তাদের। অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হলো তাদের মনে। পেছন ফিরে তাকাতেই অবাক বিষ্ময় হতে বুঝি আরো বাকি আছে। একজন বড় মুখোশ পরা সান্তা। একটু অবাক হলেন দম্পতি। প্রশ্ন করলেন,
– কে তুমি বাবা!
অচেনা সান্তা তার মুখোশটা সরিয়ে নিলেন মুখ থেকে। মুখোশের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো তাদের মেয়ে তিতলি। আচমকা তিতলিকে দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। কিছুই বুঝতে পারলেন না। বাবা মা কে হোমের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে তিতলি বসলো এক জায়গায়। বসিয়ে বলতে শুরু করলো-
– “জানো বাবা আমি শেষ আট বছর ধরেই এখানে আসি প্রত্যেক ডিসেম্বরে। একটু শিশুদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে যাই। আজ তোমরা আমার আশ্রয় হয়ে উঠেছো, আমি আমার বাবা মা কে পেয়েছি কিন্তু সবাই তো তাদের বাবা মা কে পায়নি।”
এগিয়ে এলেন ফাদার। তিতলিকে থামিয়ে দিয়ে বলে চললেন,
– “আপনাদের সেই ছোট্ট তিতলি আজ একটা বিরাট ছায়া এই দুঃস্থ হোমের শিশুদের জন্য। এই যে দেখছেন আজকের এই পরিবেশ, এত খাদ্য সামগ্রী, ছোট ছোট শিশুগুলোর মুখে এই মিষ্টি পবিত্র হাসি, এই সব কিছুর পেছনে রয়েছে আপনাদের তিতলি। ঈশ্বর যীশুর কাছে প্রার্থনা করি যেন সব শিশুর পিতা মাতার শিক্ষা আপনাদের দেওয়া শিক্ষার থেকে কোনো অংশে কম না হয়। এমন সন্তান যেন বাবা মায়ের কোল আলো করেই থাকে।
বড় হও মা। ভালো থেকো সবাই।”
বলে ফাদার দুহাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। তিতলি বাবা মায়ের হাত ধরে রওয়ানা দিলো বাড়ির পথে। তখনও গোটা হোম জুড়ে বেজে চলেছে,,,,
Jingle bells, jingle bells
Jingle all the way
Oh, what fun it is to ride
In a one horse open sleigh
Hey, jingle bells, jingle bells
Jingle all the way
Oh, what fun it is to ride
In a one horse open sleigh
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।