সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সাহানা ভট্টাচার্য্য (পর্ব – ৫)

অস্ত্রদান – একটি কাল্পনিক কথা

পর্ব  ৫ – অসি/খাঁড়া

 ১৯১৩ সাল, পরাধীন ভারতে প্রায় দেড়শো বছরে অনেক রক্ত বয়েছে, অনেক মার্ খেয়েছে ভারতীয়রা। অহিংসা-হিংসা সবই কেমন ম্রিয়মাণ। দিকেদিকেই বন্দেমাতরম ডাক, যুবক-যুবতীদের লাশ, গোরা সাহেবদের গুপ্তহত্যা বা হত্যার প্রকল্প, স্বাধীনতা আন্দোলন জোরকদমে। লালা হরদয়াল, রাসবিহারী বসুর মতন নেতারা নিয়েছেন অন্যরকম যুদ্ধনীতি, প্রতিষ্ঠা হয়েছে গদর পার্টি। দুর্গাপুজো এখন নমো-নমো করেই, কিছু রায়বাহাদুর উপাধিপ্রাপ্ত ব্রিটিশ-ভৃত্যেরা শুধু জাঁকজমক করে পুজো করে, তবে দুর্গা মা সেসব জায়গায় বেশিক্ষণ বসেন না। মনখারাপ করেন মা, ভারতীয়দের করুণ দশা দেখে। যে পরাধীনতার অসুখে ভুগছে ভারত, তার জড় অনেক গভীরে। মা দুর্গা বোঝেন – এ হলো বিস্বাসঘাতকতা ও মানসিক দুর্বলতার ফল। সততা ও ঐক্যের অভাব যতদিন থাকবে, ততদিন ভারত স্বাধীন হবে না কিছুতেই। অশিক্ষা, দারিদ্র্য আর ভেদাভেদের ঘিতেই জ্বলছে পরাধীনতার আগুন। মা দুর্গা আজও সকাল-সকাল কিছু রায়বাহাদুরের পুজোয় অল্প থেকেই চলেছেন বাংলা ছেড়ে। দেশের মানুষের চিতার ওপরে বিদেশী ও পরজীবীদের আড়ম্বর ভালো লাগছে না মায়ের। পাঞ্জাবের একটা ছোট্ট গ্রামের একটা দোতলা পাকাবাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন মা।
যদিও বাঙালীদের মতন চকমেলানো বাড়ির আদল পাঞ্জাবিদের হয় না, তবু বড় বাড়িটির চারিদিকে বারান্দায় ঘেরা, মাঝের চৌকোনা উঠোনে চলছে ছদ্মলড়াই। বাড়ির লোকজন উপরে বারান্দায় ভিড় করে, পাশে রঙ্গ দেখতে বসলেন মা দুর্গা। গোলাপী ওড়না শক্ত করে কোমরে বাঁধা, সাদা পাতিয়ালা-কুর্তিতে টানটান যুবতী শরীর আকর্ষণীয়, নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত, অসিচালনায় মত্ত গোলাপের মতন সুন্দরী গুলাব। রিভলবারের পাশাপাশি শিখনীর শখ – অসিচালনাতেও পারদর্শিতা চাই। মা দুর্গা মাঝেমধ্যেই ফেন্সিংক্লাবে হানা দেন, অসিচালনা দেখতে মা খুব পছন্দ করেন। গুলাবকে সেখানেই দেখেছিলেন তিনি। মুগ্ধ হয়েছিলেন তার দক্ষতায়। তবে ফেন্সিংক্লাবের প্রশিক্ষণের বাইরেও ভাইবোন বা খুড়তুতো-জ্যাঠতুতোদের ওপর গুলাবের অস্ত্রপরীক্ষার অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাড়িশুদ্ধ। আজ বাদে কাল বিয়ে, তবু বাপের আদরের মেয়ের ডাকাতিপনার কোনো কমতি নেই। তবে পাঞ্জাবী পরিবারে মেয়েদের অস্ত্রশিক্ষার প্রচলন থাকে। গুলাবের নিজেরও ঝোঁক ছিল অস্ত্রে, কাজেই সে যে খুব ললিতলবঙ্গলতা হবে না, তা মোটামুটি সবাই বুঝতো। পাত্র মান সিং খুব বড় পরিবারের ছেলে। বিয়ের পরে সুখেই থাকবে আশা করা যায়!
দুধেআলতা চুড়িদার, হাতের টাটকা মেহেন্দি-চূড়া, মাথায় নববধুসুলভ লাল ওড়না, পায়ের মল-মেহেন্দি-সোনালী জরির জুতি – চোখ ঝলসে যায় গুলাবকে দেখে। কোমরে কৃপাণ আছে, তবে ছোট ছুরির মতো! শিখনী আজ স্বামীর সাথে জাহাজে গিয়ে বসতে চলেছেন। গন্তব্য ফিলিপিন্স। রূপের জেল্লায় চারিদিকে আলো করে আছে। ভ্যানিটি ব্যাগে লিপস্টিকের পাশে রাখা রাসবিহারী বসুর দেওয়া রিভলবারটা অবশ্য মা দুর্গার চোখ এড়ায়নি। স্বামী মান সিং জানেন, তবে রিভলবারের কথা অন্য কেউ জানতে পারেনি। জাহাজের সুরক্ষাকর্মীরা ভালমতন নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করলেও নববধূর ভ্যানিটি ব্যাগের লিপস্টিকের ছোট বটুয়া খুলে কেউ আর পরীক্ষা করে দেখেনি। তবে কৌতূহলী মা দুর্গা ছাড়তে পারেননি এই নবদম্পতির কীর্তিকলাপের কৌতূহল। কেন মেয়েটা রিভলবার নিলো?
ফিলিপিন্সের গদর পার্টির গোপন আস্তানা থেকে বোরখা পরা যে দুই দীর্ঘাঙ্গী বেরিয়ে গেলেন, তারা যে আসলে মান সিং আর গুলাব কাউর, তা কেউ জানলো না। সুদর্শন পুরুষটি ও তাঁর বুদ্ধিমতী সুন্দরী স্ত্রী গোপনে ছদ্মবেশে বেশ কিছুদিন হল ফিলিপিন্স-আমেরিকা শাখায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গদর পার্টির গুপ্তচরের কাজ করে চলেছে। প্রবল কৌতূহলে মা দুর্গাও পিছু নিলেন। রাস্তায় একটি হোটেলে চটজলদি পোশাক পরিবর্তন।আলোর রোশনাই, শ্যাম্পেনের ফোয়ারা, জ্যাজ মিউজিকের সাথে প্রসাধন-সুগন্ধী-বাহারী পোশাক ও রাজনীতির সমারোহ এই পার্টি। দুই গুপ্তচর এসে গেছেন পার্টিতে, চেষ্টা করছেন সমস্ত তথ্য নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করতে। কাজ ভালোই এগোচ্ছিল কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। ধরা পড়লেন দুজনে।
প্রিয় স্বামীকে পুরুষদের জেলে নিয়ে গেলো। বিয়ের পর থেকে এই প্রথম পরমপ্রিয় বান্ধবটির থেকে আলাদা হলো গুলাব। মহিলা জেলের অন্ধকূপে যাওয়ার আগে পোশাক-গহনা-রিভলবার সবই কেড়ে নেয়া হলো। কেড়ে নেওয়া হলো কৃপাণটিও। ছোট্ট রূপক-কৃপাণ ধর্মীয় চিহ্নহিসাবেও রাখতে দেয়নি ব্রিটিশ পুলিশ। দুবছর অনেক যন্ত্রণা পেয়ে যখন জেল থেকে মুক্তি পায় গুলাব, ততদিনে স্বাধীনতা সংগ্রাম এগিয়েছে কিছুটা। সুচতুর গুলাবের নিজস্ব প্রশিক্ষণ ও সাহসে এগিয়েছে গদর মুভমেন্ট। গুলাবের জেল থেকে মুক্তিলাভের দিনে মা দুর্গা কালীরূপে এলেন দেখতে – মায়ের হাতের অসি খাঁড়া হয়ে ঝলমল করছে, ভারতের ইতিহাসে তখন সুভাষ বোসের আবির্ভাবকাল। অহিংসা, না আঘাতের লড়াই, দ্বন্দ্ব সারা ভারত জুড়ে!
নাঃ, অসি সঠিক মানুষটির হাতেই উঠেছিল! গুলাবের জেল থেকে বেরোনোর মুহূর্তে কেমন আলো ছড়িয়ে পড়লো মায়ের মুখে। বিশ্বাস হলো – অসি ঝলকাবেই, আলো আসবেই, পরাধীনতার কালো কাটবেই!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।