শুভ আঢ্যর গপ্পো

কলকাতায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা। লেখালিখি মূলত প্রিন্টেড ও ওয়েব ম্যাগে। প্রকাশিত বই তিনটি, ব্লেড রানার, আওকিগাহারা ও জোকিং – আ – পার্ট। বিষণ্ণতা ছাড়া আর ভালবাসা কিছু নেই

জেনারেটর ও সানি লিওনের গপ্পো

এ ভরা ভাদর মাহ, পচনশীল। দেকতে দেকতে কলকেতার লোকগুলো টমেটোর মতো পচে যাচ্চে। তাদের ঘামের দুর্গন্ধ থেকে ককনও ককনও উটে আসচে সেই পচনশীল তরলের খোশবাই। মানে বলতে চাওয়া হচ্চে, কুকুরেরা লক হয়ে যাবার পর, যকন ঢ্যামনা ও ড্যাকরারা তাদের চাবি ছুঁড়ে দিতে বদ্ধপরিকর সের’ম একটা সময় পেরিয়ে গেলেই অটোস্ট্যাণ্ডের পেচনে, রিস্কাস্ট্যাণ্ডের পাশে, গলির মোড়ে খানকয় বাঁশ লাগিয়ে, কোনোমতে দায়সারা ভাবে একটা প্যাণ্ডেল করে, সেকানে কোনোমতে কুঁচি দেওয়া সাটিনের কাপড় ঝুলিয়ে যে কাঠামো দাঁড় করানো হয় তার সাথে ‘বাবা বিশ্বকম্মা মাই কি জয়’ ব্যাপারটার একটা যোগ আচে। কে সি নাগের বইতে সে যোগের অঙ্কের হিসেব পাওয়া না গেলেও তা যে বত্তমান সে নিয়ে কলকেতার লোকের কোনো সন্দেহ অব্দি নেই।

দেকতে পাওয়া যাচ্চে সেকানে লাগানো রয়েচে কালীপুজোর আগে টেস্টিং করতে দেওয়া টুনিবাল্বেরা, সেকানে রাকা ডেও-ডেকনার মদ্দে থেকে উঁকি মারচে বড় হাতা, ছান্তা – এসব। এসব দিয়ে খানিক পরে ভোগ রান্না হবে। এসব দিয়েই সাড়ে বারো কিলোর খাসির মাংস রান্না হবে, রগরগে করে ঝাল আর হেব্বি করে পেঁয়াজ আদা রসুন ঠুসে। তেল গড়িয়ে চলে যাবে এ পাড়া থেকে সে পাড়া। সেকানে দেকতে পাওয়া যাচ্চে একটা ছেলে হাতে করে শোলার থালা আর পেলাস্টিকের গেলাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আচে, পাশে রাকা একটা বিটকেল সাইজের শতরঞ্জি ঢাকা দেওয়া সাউণ্ড বস্ক। তার ওপর ‘চড়তি জবানি’, ‘লায়লা ও লায়লা’ লেকা কতগুলো সিডি। সেগুলো খুব সম্ভব না, সিওর করেই লুপে ফেলে বাজানো হবে। পুজোর দিনের জন্য ঠাকুর একনও না এলেও এসব ব্যবস্তা এক্কেবারে পাকা করে ফেলা গেচে। পুরুতের মোবাইলে বারকতক ফোন করা হয়েচে। সে মাল টেনে ঝিমুচ্চে কি না জানা নেই, আসলে তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্চে না। তার দক্ষিণে হিসেবে পাঁচশো এক টাকা ধার্য করা হয়েচে, সবার মতামত নিয়ে এটাও ঠিক করা হয়েচে, পরের দিন দধিকম্মা করতে আসবে কতা দিলে, একটা নাম্বার ওয়ানের পাইটও তাকে দেওয়া হবে। ছেলেটা সরে দাঁড়ালে দেকতে পাওয়া যাবে সাউণ্ড বস্কের পাশেই একটা ঢাউস জেনারেটর। তার পাশে সার দিয়ে দাঁড় করানো ক’টা পেডেস্ট্রিয়াল ফ্যান, যা একসময় এসির বাপ ঠাকুদ্দা মনে লোকে পেন্নাম করত, তবে একন আর কেউ তেমন পোঁচে না। তবে এই পচা গরমকে কাহিল করতে সের’ম কিচু নিয়ে আসা হয়েচে। পাশে একটা দড়িতে কারোর একটা হাফ প্যাণ্ট আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি ঝুলচে।

নির্ঘণ্ট মেনে পুজো আসতে আর সাড়ে সতেরো ঘন্টা বাকি। এতসবের মদ্দে বেড়ালটা ডেকরেটারের একটা চৌকির তলায় ঢুকে পড়েচে। জুলজুল করে সে দেকতে পাচ্চে, একটা সাইকেল ভ্যানে জিভ বের করে টানতে টানতে বিশ্বকম্মা কে নিয়ে আসতে ক’জন। এদের আসার পরে সামান্য জলযোগ আর চাটের ব্যবস্তা আচে, জেনেই তারা এ কাজে রাজি হয়েচে। হুকিং করা ইলেকটিক পোঁদে যাওয়ায় কিচু টুনি জ্বলে উটেচে। যেসব টুনিদের পোঁদ অতটাও পাকেনি তারা জ্বলচে নিভচে। গানের সিডি চালানো হয়েচে। চোঙা থেকে সানি লিওন গেয়ে উটচে ‘লায়লা ও লায়লা…’ যাদের শোনার কতা চিল, তারা কতটা শুনচে ঠাহর করা যাচ্চে না, তারা লাচতে শুরু করে দিয়েচে। এই লাচ নিয়ে একটা সময় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ রিসার্চ করবে এমন ভুল ধারণা বেড়ালটার নেই। সে বেচারি শুদু দেকচে ঠাকুর নামানোর সময় থেকেই কেউ কেউ দম মেরে দিয়েচে।

দেকতে দেকতে দিন ও ক্ষণ এয়ে পড়েচে। আজ হপ্তাহিক চানের দিন। গায়ের মোবিলটোবিল ধুয়ে, লাস্ক বা লাইটবয় সাবান নিয়ে কেউ পুকুরে গেচে, তো কেউ পুরসভা থেকে করে দেওয়া কলের তলায় বসেচে। সেকান থেকে উপচে জল পড়ে নালায় চলে যাচ্চে। সেই জলই তাদের সাবান মাকার পর তাদের গা ধুইয়ে দিচ্চে। সাবানের ফেনায় আশপাশ বড় পিচল বলে বেড়ালটা সেকানে যেতে চাইচে না। একন ঘটনা হল, এসবের মদ্দেই পুজো শুরু হয়ে গেচে। তবে সেকানে থাকার লোক পাওয়া যাচ্চে না বলে কিচু অটো আর রিস্কাকে সেকানে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েচে। স্ককালবেলা জিলিপি কিনে আকাশ দেকতে থাকা কিচু লেবারও সেকানে যে নিজে থেকেই দাঁড়িয়ে যায়নি এমন নয়। মোটের ওপর খুব জাঁকজমক করে না হলেও পুজো শুরু হয়েচে। আর কিচুক্ষণের মদ্দেই তা শেষও হয়ে যাবে। যাবার সময় পুরুতের চটি পাওয়া যাবে কি না এব্যাপারে কোনো সিওরিটি নেই। গানের জন্যে সামান্য অসুবিদে হচ্চে বটে পুজোর মন্তর শুনতে ও আশেপাশে ভদ্দরলোকেদের, তবে কে’ই বা একানে পুজোর মন্তর শুনতে এয়েচে। আর এত বড় ব্যাপারে সামান্য ক’টা অসুবিদে যে হবেই তা’ও জানা। সুতরাং… কেউ সে নিয়ে মাতা ঘামাচ্চে না।

বিকেল সাড়ে চারটে। সার দিয়ে বয়ে পড়েচে সক্কলে। সবার সামনে শোলার থালা। সেকানে ধোঁয়া ওটা ভাত পড়চে। তাঁর ওপর পড়চে খাসির রাং, চর্বি, মেটে আর বিচি… আলুও পড়চে সেকানে একটা করে। খাওয়া শেষ হবার পর লুপে ফেলা সানি লিওনের মতো করে আবার ভাত আর খাসি এসে পড়চে। খাসিটি জানত না এর পর তাকে মদ দিয়ে ম্যারিনেট করা হবে পাকস্থলীর ভেতর, যদিও রান্নার আগে তাকে দই দিয়ে ঘণ্টা দুই-আড়াই ম্যারিনেট করা হবে এ কতা জেনেই সে বলি হয়েচিল। খাওয়ার পর মৌরি এয়েচে। মুকে মৌরি দিয়ে পেলাস্টিকের গেলাসে একন সামান্য জলপান হবে। একে অবাক জলপানও বলা যেতে পারে। পাড়ার ভদ্দর লোকেরা ততক্ষণে সেকান থেকে সরেচে। যেসব কুকুরের পার্মানেণ্ট মনিব আচে, যারা রেকর্ড পেলেয়ারের সামনে বসে মনিবের দুঃখে গান শোনে, আর যাদের ছবিকে লোগো হিসেবে ব্যবসা করে লোকে গানের কোম্পানী খোলে, তেমন ডগিগুলো ধারেবাড়ে নেই। কিচু লাতখোর কুত্তা একন সেকানে এয়ে বয়েচে। তাদের করার কিচু নেই। ভাগাড় থেকে এঁটো খাসি চেবানোর পর তাদেরও সামান্য আহ্লাদ হয়েচে আর কি!

ওদিকে গান কিন্তু ননস্টপ চলেই যাচ্চে। হেলেনের কোমরের বল-বিয়ারিং ঢিলে হয়ে গেচে, কেউ মেরামত করে দেবার নেই। করলেই টান্টু। কাচাকাচি কোনো বান্টুও নেই। ঘড়ি একনও যারা দেকে টাইম বুজে উটতে পারচে, তারা জানে একন সাড়ে ন’টা বাজে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে পড়েচে। মামুণিরা এ পত দিয়ে আজ হাঁটাচলা না করে ঘুরে ওপাড়া দিয়ে বাড়ি ঢুকচে। লোকেদের গায়ে বাংলা মেশানো ইম্পেরিয়াল ব্লু’র খোশবাইয়ের চোটে আশেপাশের দোকানদারেরা বসতে অব্দি পারচে না। এমন দিনে অন্দকারে ড্রেনের দিকে মুততে যাবার আগে সেকানে ভালো করে ছানবিন করে মোতা শুরু করা ভালো। না হলে, না দেকে কারোর গায়ে মুতে ফেললে, সে বাওয়াল সামলানোর দায় কেউ নেবে কি না বলা যাচ্চে না। বেড়ালটা দেকতে পাচ্চে, প্যাণ্ডেলের পেচনে সকালের কেটে যাওয়া ঘুড়ি পড়ে রয়েচে। বেড়ালটা লাটাই খুঁজে পাচ্চে না। বেড়ালটা জানতেও পারচে না, সে লাটাই ছাদেই থেকে গেচে, তবে দেকতে পাচ্চে, রেশন দোকানগুলোতে একনও বেশ ভাল রকম লাইন। কেউ নিদেনপক্কে কিচু একটা পাবার জন্য সেকানে লাইন দিয়েচে। এসবের মাজে লুপে ফেলা গান বন্দ হয়েচে। আলো চলে যেতে যকন বে-বাড়ির ফ্যানগুলো বন্দ হয়ে যায়, গরমে তকন কারোর কারোর খোঁয়ারি কাটে।

মা কালী ইলেকটিকের দোকান খুলিয়ে তার আর ব্ল্যাক টেপ নিয়ে আসা হয়েচে। একন জেনারেটার দিয়ে পাকাগুলো চালানোর চেষ্টা হবে। ঠাকুরের মুকে একটা হ্যালোজনেও কানেকশন দেওয়া হবে। অনেকেই এর মদ্দে আরেকবার জলপানের অচিলায় দোকানে ছুটেচে। অনেকের দাবি মতো সানি লিওনকে আবার গানের রিকোয়েস্ট করানো হচ্চে, তবে জেনারেটারে সে গান চালানো যাচ্চে না। বেড়ালটা দেকচে, জেনারেটর কানেকশনে ফ্যানগুলো ঘুরতে শুরু করতেই পেলাস্টিকের গেলাস উড়তে শুরু করল। কয়েককজন এরই মদ্দে জেনারেটরের সাতেই লাচ শুরু করেচে। দূর থেকে ভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুটভুট শব্দ ছাড়া আর কিচুই শুনতে পাওয়া যাচ্চে না। লাচ একনও বন্দ হয়নি। দিগন্ত থেকে দেকতে পাওয়া যাচ্চে, বারমুডা আর লুঙ্গি পরে উদয়শংকর মুদ্রা। দেকতে পাওয়া যাচ্চে, সেকানকার ছবি ছাপিয়ে লোকগুলো এই দুহাজার ঊনিশেও কি নিদারুণ… লেচে চলেচে। পাশে একটা ঘিয়ে ভাজা নেড়ি। তাদের কেউ বলেনি, ‘বাসন্তী, ইন কুত্তোকে সামনে মাত নাচ না…’

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।