।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় সৌম্যজিৎ আচার্য

ছোপ

|| ১ ||
দুপুরবেলা এঁটো বাসন পুকুরঘাট থেকে ধুয়ে আনছিলো ফুলমণি। পথে একটা চোরকাঁটা ঢুকে গেল ওর বাঁ পায়ে। আঃ, বলি ফোটার আর সময় পেল না কো! এই সময় ধোয়া বাসনগুলো কোথায় রাখে? এভাবে তো হাঁটা যাবে না। অগত্যা ঘাসের ওপর বাসন আর জল ভরা বালতিটা নামিয়ে রাখল। ওখানেই থেবড়ে বসে বাঁ পা-টা ভাঁজ করে চোখের সামনে আনল। আঃ, এটুকু কাঁটা – তার দেমাগ দেকো! রক্ত বের করে দিলে! নখ দিয়ে চেপে একরত্তি কাঁটাটাকে টেনে বার করলো ফুলমণি। বালতি থেকে একটু জল ঢাললো পায়ে। বাসনগুলোকে তুলে ডান হাতের চেটো দিয়ে বাসনের গায়ে জল ছিটোলো। যদি কিছু ধুলোবালি লাগে, এতেই ধুয়ে যাবে। বাসন আর বালতি তুলে আবার হাঁটা দিল মেঠো পথে। হাঁটতে হাঁটতে ফুলমণি বুঝলো, সে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে। আজ ভোগান্তি আছে।
পথে মিত্তির বাবুদের পুজোর দালান পড়ে। পথের একদম গায়েই নয়, একটু তফাতে। তবে হাঁটতে হাঁটতে আড়চালার ঠাকুরের মুখটা দিব্যি দেখা যায়। গণেশ, কার্তিকরা নাহয় বাপু ছোটো। এত লোক ভিড় করেছে, তাও ওদের মুকুটের চূড়া দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দুগ্গাঠাকুরের তো স্পষ্ট মুখ, বড় বড় চোখ, দশ হাত – দেখা যাচ্ছে সব। জয় মা, মা-গো, আমার অণিমাকে ভাল রেখো। ওর বড় সর্দির ধাত। এবছর ওর শরীরটা যেন ভাল থাকে। পড়াশোনায় মন নেই। একটু নেকাপড়ায় যেন মন বসে। আর কি? সোয়ামিটা যেন ঠিকঠাক বাড়ি ফেরে। এসব তোমায় আগেই বলেচি, তবে যেতে যেতে আবার জখন তোমার দর্শন হল, আর একবার বলি। তুমি তো গরীবের কথা একদম শোনো না। তাই বারবার বলি।
ঢাক বাজছে। জোর কদমে মন্ত্র পড়ছে মুখুজ্জে মশায়। বোধহয় সন্ধি পুজো শেষের দিকে। অয়, এবার নবমী পড়ে গেল। আর একটা দিন। একটা দিনই বা কোতায়। আজকের রাতটাই। কাল তো দশমী পড়ে যাবে। অণিমার বাবা ফিরবে পরশু বিকেলে।
অণিমার বাবা, মানে গগন গেছে মুর্শিদাবাদ শহরে। শহরের এক প্যান্ডেলে ঢাক বাজাতে। এবছর ফসল তেমন হল না। মরশুম আর আগের মতো নেই। রোদের সময় রোদ ঠিকঠাক ওঠে না। শীতের সময় শীত নেই। বর্ষাকাল কখন আসে, কখন বেশি জল ঢালে তা কেউ ঠাওর করতে পারে না। গগনের একটা এক ফসলী জমি ছিল। দেনার দায়ে আধা তো বেচেই দিতে হল। বাকি আধা জমিতে ফসল ফলে না ফলারই মত। বুধুয়া একদিন বলল, চ’না এবার শহরে। তোর ঢাকের হাত তো ভাল। মা সরস্বতীর কৃপা আছে। এখানে, এ গ্রামে, ও গ্রামে যা পাবি, শহরে তার চার গুণ বেশি। ওখানে লোকের হাতে পয়সাকড়ি বেশি। একটা বারোয়ারি প্যান্ডেলে চান্স যদি পাস, তবে তোর দেনার টাকার কিছুটা শোধ দিবি। আহা, আমি শুধু আমার লগে কইছিনা, তোরই সুবিধা হবে।
গগন পুজোর সময় সাত জন্মে গ্রাম ছেড়ে যায় নি। কিন্তু ফুলমণি আর বাচ্চাদুটোর মুখ চেয়ে রাজি হয়েছিল। অণিমা যাবার আগে গগনের হাত চেপে ধরে বলেছিল, আমার জন্য শহর থেকে নতুন জামা আনবে তো? গগন হেসে বলেছিল, হ্যাঁ রে বাবা, আনবো। কিন্তু তুই তো বললি না, কোন রঙ তোর পছন্দ?
অণিমা একটু ভেবে বলেছিল, গোলাপী। না-না, নীল। এক রঙা না। জামার গায়ে যেন ছোপ ছোপ আঁকা থাকে বাবা। গগন বলেছিল, বেশ।
ফুলমণি আগ বাড়িয়ে বলেছিল, মেয়ে বলেচে বলে শুধু ওর জন্যই এনো। বেশি খরচা কোরো না। কোলের ছেলেটার কিন্তু জামা আছে। বাড়ন্ত বয়স। এক গাদা লাগবে না। ছোটো হয়ে যাবে।
ঘর ছেড়ে মেঠো পথে হেঁটে যেতে যেতে গগন পেছনে তাকিয়ে দেখছিল, বছর চোদ্দর অণিমা দাওয়ায় দাঁড়িয়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। এই বয়সেই মেয়েটার রূপ হয়েছে বেশ। কোমল স্বভাব। বাবা অন্তঃপ্রাণ। মন খারাপ হয়ে গেছিল গগনের। ও নিজেও জানে, পুঁচকে ছেলেটার থেকে মেয়েটার ওপরই ওর টান একটু বেশি। বড্ড মায়াবী ওর চোখ দুটো। মনে মনে ভেবেছিল, খুব শিগ্গির সে ঘরে ফিরে আসবে।
|| ২ ||
মন্ত্রী বললেন, মেয়েরা হ’ল আসলে মা। কিন্তু আমরা আমাদের রোজকার জীবনে এই সত্যটা ভুলে যাই। তাদের অবহেলা করি। জেনে-না জেনে তাদের হেনস্থা করি। মা দুর্গা তাই প্রতি বছর আসেন নারীর আসল রূপ চিনিয়ে দিতে। দুঃখনাশিনী, বিঘ্ননাশিনী মা হয়ে। মনে রাখুন, এই উৎসব আমাদের সেই বার্তাই দেয়। কিন্তু বহু মানুষ এই সত্যটা ভুলে যায়। তারা সমাজে বিশৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করে। ষড়যন্ত্র করে। জেনে রাখুন, আমাদের সরকার সেটা কিছুতেই মেনে নেবে না। আমরা তাই উদ্যোগ নিয়েছি যে….
হাঁ করে কথাগুলো শুনছিল গগন। আর ভাবছিল, মন্ত্রীমশাই কী সুন্দর কথা বলে। একটু আগে ক্লাবের প্যান্ডেলে ঠাকুর উদ্বোধন করেছে। তখন দুলে দুলে উদ্দাম ঢাক বাজিয়েছে গগন। কর্মকর্তাদের নির্দেশ ছিল। বলেছিল, ভাল বাজাতে পারলে উপরি বকশিশ দেবে। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে গগন। আর ভেবেছে, এখানে না এলে এত কাছ থেকে মন্ত্রীকে দেখাই হত না। দেখা যেত না, এত নতুন নতুন জামাকাপড় পড়া মানুষজন! ও ভাবছিল, সত্যি, গ্রামে এর ছিটেফোঁটাও নেই। এখানে ষষ্ঠীতেই এত ভিড়, এত লোকজন বেরিয়ে পরেছে রাস্তায়। আর ওখানে, অষ্টমী-নবমীতেই যা লোকজন একটু গতর নড়ায়।
ধুনুচির তালে তালে, কাঁসর ঘন্টার আবহে গগন ঢাক বাজাচ্ছিল নেচে নেচে, দুলছিল ঘুরে ঘুরে। কত লোক আসছে, প্রতিমা দেখছে, প্রণাম করছে। কত রঙবেরঙের জামা, শাড়ি, ফ্রক। ঢাক বাজাতে বাজাতে গগন ভাবছে ওর বউটার কথা। কোলের ছেলেটার কথা, মেয়ে অণিমার কথা। আহা-রে, বেচারাদের একটাও নতুন কিছু কিনে দিতে পারে নি এবার। ভাল করে বাজাই। আরো ভাল করে। আঙুলে ব্যাথা করছে-তাও। ফেরার সময় মেয়েটার জন্য একটা নীল ফ্রক কিনে নিয়ে যেতে হবে।
|| ৩ ||
বাসন আর বালতি নিয়ে দালানে আসতে আসতে ফুলমণি দেখলো সব শুনশান। পুটুর মা – রাও বোধহয় পুজো দেখতে গেছে। কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ কেন? ভাইটা ঘুমোচ্ছে, দেখতে বললাম, অণিমা নিজেও দেকো ঘুমিয়ে পরলো। ফুলমণি আস্তে করে দুবার টোকা দিল। অণিমা, অ অণিমা! ঘুমুলি নাকি? বাচ্চাটা জেগে যাবে। তাই বেশি জোরে ধাক্কা দিতে ভয় পাচ্ছিল ফুলমণি। আবার টোকা দিল। অণিমা, ওয় মা, ওঠ, দরজা খোল। ফুলমণি শুনলো, ভেতরে কারা যেন ফিসফিস করছে। ভয় পেয়ে গেল ফুলমণি। এবার জোরে ধাক্কা দিল দরজায়। অণিমা – অণিমা – রে।
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো। কিছু বোঝার আগেই একটা হাত ফুলমণিকে জোরসে টান দিল। সমস্ত বাসন ঝনঝন করে বিকট শব্দ করে ছড়িয়ে পরলো দরজার সামনে।
অন্য একটা লোক ফুলমণির মুখ চেপে ধরেছে। কোনও মতে মুখ সরিয়ে ফুলমণি বিকট শব্দ করে উঠলো।
ফুলমণি বিস্ফোরিত চোখে দেখল, ঘরের কোণে অণিমার মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা। বেঁধে রাখা হয়েছে ওর হাত দুটোও। চারজন লোক মেয়েটার ওপর হামলে পরেছে। ওর পেটে, বুকে মুখ ঘষছে। ওর ফুল ছাপ ছাপ ফ্রকটা দোমড়ানো অবস্থায় পরে আছে একটু দূরে। যে দুজন ফুলমণিকে চেপে ধরেছিল আটকানোর জন্য, বার বার চাপা গলায় বলছিল, – চুপ, চুপ শালি। বারবার কাকুতি মিনতি করতে লাগলো ফুলমণি। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ওকে ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও তোমরা। পায়ে পড়ি। গড় করি। আমার মেয়েটাকে নষ্ট করে দিও না – আ – আ….।
কিন্তু এই প্রায়-অন্ধকার ঘরে কেউ তার কথা শোনার মত অবস্থায় ছিল না। সবাই তখন উদোম আনন্দে বিভোর। ততক্ষনে কেউ খুলে ফেলেছে প্যান্টের চেন। কেউ উঠিয়েছে লুঙ্গি। অণিমা, এইটুকু মেয়ে – তাদের সঙ্গে পেরে উঠবে কেন? সে শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে গোঙাচ্ছিলো। ছটফট করছিল। আর ফুলমণিও মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রবলভাবে চিৎকার করছিল। কিন্তু তার চিৎকার একটুও শব্দ হয়ে বের হচ্ছিল না। কারণ তার মুখ ছিল বাঁধা। বাচ্চাটা ঘুম থেকে উঠে কাঁদছিল। ওদের একজন একটা ছুরি নিয়ে বাচ্চাটার কছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, যদি বাচ্চাটাকে প্রাণে বাঁচাতে চাস, চুপ করে থাক মাগী। একটাও শব্দ করবি তো তোর বাচ্চার গলা চিরে দেব। ঘাঁটালে কিন্তু তোকেও ছাড়বো না। তোর মেয়ের মতই…..
ফুলমণি বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বারবার শুধু বলেছিল, বাবারা, তোমরা একসঙ্গে যেও না। একে একে যাও। একে একে যাও। ও বড্ড ছোটো। ও পারবে না। পারবে না ও……
বাইরে তখন একটু দূরে কাশ ফুটে আছে। হাওয়ায় দুলছে অল্প করে। আরও দূরে, গগন বকশিশের টাকা দিয়ে একটা নীল রঙের জামা কিনে থলেতে ঢোকাচ্ছে। জামার গায়ে সাদা মেঘের ছোপ। এবার ঘরে ফিরবে সে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।