|| কালির আঁচড় পাতা ভরে কালী মেয়ে এলো ঘরে || T3 বিশেষ সংখ্যায় রণিত ভৌমিক

একটি মিথ্যে প্রেমের গল্প

আচ্ছা, মৃত্যুর পরও যদি আবার একটা দিন আগের মতোই বাঁচা সম্ভবপর হয়, তাহলে কেমন হত? না, মানে মৃত্যু তো কেবল মাত্র শরীরের হয় শুনেছি, আত্মা বা ভালোবাসার সম্পর্কগুলোর হয়কি??
বর্তমান সময় দাঁড়িয়ে তাই কঠিন বাস্তবটা কিছুক্ষণের জন্য দূরে সরিয়ে রেখে, মিথ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা এই প্রেমের গল্পটায় আসুন, একবার চোখ রাখা যাক।
দিনটা শহরের বাকি আর পাঁচটা ব্যস্ততম দিনগুলোর মধ্যে একটি হলেও, রাহুলের কাছে আজকের দিনটার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। হ্যাঁ! এতদিনে পৃথিবীর সমস্ত সাহস নিজের মধ্যে একত্র করে, এবার সে পারমিতাকে নিজের মনের কথাটা বলতে চলেছে। বাইকে যেতে যেতে, ফের একবার ওঁর মনের মধ্যে ভয়টা উঁকি দিচ্ছে। ভালোবাসা প্রকাশের পর পারমিতা যদি রেগে যায়, তখন ওদের এই এতবছরের বন্ধুত্বের কি হবে?
এদিকে, বিগত কিছুদিন ধরে এতো বৃষ্টি হয়েছে যে শহরের নানান অলিগলি একেবারে জলে ডুবে রয়েছে। রাস্তাগুলোর অবস্থা তথৈবচ। যাইহোক, রাহুল কোনও মতে পারমিতার বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলো। পারমিতা আগে থেকেই রেডি হয়ে অপেক্ষা করছিল সুতরাং ওঁরা আর দেরি না করে, রবীন্দ্র সরোবরের দিকে অগ্রসর হল। বাইকে যেতে যেতে পারমিতার প্রশ্ন,

  • এই বর্ষার জলের মধ্যে আসতে গেলি কেন?
  • (রাহুলের উত্তর) আজকের তারিখটা মনে আছে?
  • ওহ, একদম ভুলে গেছিলাম। আজ তো তোর চলে যাওয়ার পালা, ধুর! ভালো লাগে না।
  • হুম। ট্রেন তো রাতে। তাই ভাবলাম চাকরির জন্য অন্য শহরে যাওয়ার আগে তোকে একটা কথা বলে যাই।
  • গত এক সপ্তাহ ধরে তোর এই এক কথা শুনে আসছি। একটা কথা আছে। কিন্তু কি কথা, এবার তো বল।
  • আরে, বলব। বলব। কথাটা বলার জন্যই তো আজকে যাওয়ার আগে দেখা করতে চেয়েছিলাম।
    কথার মাঝেই ওরা রবীন্দ্র সরোবরের মূল গেটের সামনে এসে পৌঁছলো। বাইকটা সামনে রেখে ওরা দুজনে ভিতরে ঢুকল। তখনও হয়ত পারমিতা বুঝতে পারেনি যে রাহুল ওঁর মনের কথাটা এতদিন পর বলে উঠতে পারবে। সরোবরের কাছে একটা বেঞ্চে বসার পর রাহুল পারমিতার দিকে চেয়ে বলল,
  • একটু চোখটা বুজবি?
  • একি কেন?
  • যা বলছি, সেটা কর প্লিজ।
  • আচ্ছা, বেশ করলাম।
    তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহুল ওঁর ঠোঁটটা আলতো করে পারমিতার গালে রেখে বলল,
  • যাওয়ার আগে তোকে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে গেলাম। এতদিন ধরে একটা কথা তোকে বলতে চেয়েও পারিনি বলতে। পারমিতা, তুই হবি আমার সপ্ত সুর? আমার মনের সিম্ফনি?
    রাহুলের প্রতিটা কথা শোনার পর মনে হচ্ছিল পারমিতা যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে, হয়ত চোখের কোণ থেকে ঝরে পড়া অশ্রুজল ওঁর মনের সম্মতির জানান দিচ্ছিল। স্থির ভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওঁর অন্তর থেকে কে যেন বলে উঠল,
  • হ্যাঁ, হব তোর সপ্ত সুর। যদি তুই রাজি থাকিস হতে আমার ভাবনাদের কলম। যেই কলম দিয়ে আমি লিখব, আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিতা।
  • তোকে ছেড়ে যেতে যে ইচ্ছা করছে না, পারমিতা।
  • ব্যাস, ওমনি না। যদি ‘না’ বলতাম, তাহলে কি করতিস? এখনই ট্রেন ধরতিস?
  • না রে পাগলী, আমি সত্যি হয়ত জানিনা কি করতাম। তবে বলতে পারিস, সেইজন্য আজকের দিনটাই নিজের মনের কথাটা বলার জন্য বেঁছে নিয়েছি। প্রত্যাখ্যান হলে নিজের দুঃখটা এই শহরে নয়, অন্য শহরের কোলেই মাথা রেখে চোখের জলের দ্বারা ঝরিয়ে দিতাম।
  • হুম, বুঝলাম। তা ঘড়ির কাঁটা কিন্তু বলছে আমরা এক ঘণ্টা ধরে এখানেই বসে আছি। সময় কিন্তু বয়ে চলেছে রাহুল।
  • চল বাইকে করে আজ শহরটা ঘুরি। চলে যাওয়ার আগে কয়েকটা সুন্দর মুহূর্ত, স্মৃতির অ্যালবামে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাব আরকি!
  • আচ্ছা, তুই এতো স্বার্থপর কেন রে?
  • যাহ, বাবা! স্বার্থপর হওয়ার মতো কি কথা বললাম আমি?
  • চলে যাওয়ার কথাটা কেন বারবার বলছিস তুই? আমার কি কষ্ট হয় না? কি ভাগ্য বলত আমার, আজ এমন দিনে সবকিছু ঘটল, যখন আর কিছু ঘণ্টার পর তুই অনেক দূরের একটা শহরে চলে যাবি। চেয়েও তোকে ছুঁতে পারব না, রাহুল।
  • এই দেখো, কেমন ঝগড়ুটি! আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথাটা নিয়ে মহারানীর ঝগড়া না করলে হয় না!
  • এই, এই, কী বললি! আমি ঝগড়ুটি? দাঁড়া তোর হচ্ছে…
  • আরে, মারিস না, মারিস না। এই দেখ কান ধরে উঠ বস করছি। এই এক, দুই, তিন…
  • কী মজা, কী মজা! হি হি হি…
  • এই তো এই হাসিটার অপেক্ষাতেই ছিলাম, এটা একবার দেখে নিলাম ব্যাস। এবার গোটা একবছর দিব্বি শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারব।
  • ওমা, আমি তো সব সময়ই হাসি, তার জন্যে আবার এইসব করার কী আছে?
  • তাই বুঝি?
  • হ্যাঁ। তো তুই বল আমাকে কখনও কাঁদতে দেখেছিস?
  • তুই বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস, বৃষ্টির জল তোর চোখের জল ঢেকে দিলেও, তোর ওই কাদুনে গলার আওয়াজটা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি।
    আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পারমিতা। তারপর বলল,
  • ব্যাঙ চেনো! কিচ্ছু চেনো না। চিনতে পারলে এতদিন অপেক্ষা করাতে না। কথাটা বলার জন্য আর দিন খুঁজে পেল না। একেবারে যাওয়ার দিন এসে বলছে।
  • অপেক্ষাতেও তো ভালোবাসা থাকে, তাই না…
  • মোটেই না।
  • তাহলে এতদিন এতো গুলো ছেলের প্রপোসাল ঝুলিয়ে রেখেছিলিস কেন?
  • ছেলে দেখছি, বেশ ভালোই খবর রাখে। এতদিন আমাকে স্টক করতিস নাকি? আমি তো কখনো এই ব্যাপারে তোকে কিছু বলিনি।
  • রাখতে হবে না বুঝি! আমার দশটা না, পাঁচটা না, একটাই মাত্র ভালোবাসা যে!
    কথায় কথায় ওরা একটা মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল। সেই এক পরিবেশ। দুপুর হলেও, নানান আলোয় সেজে উঠেছে মন্দির, বাজছে শাঁখ, ঘন্টা। পুরোহিত করে চলেছেন আরতি। একজনের হাতে বড়ো প্রদীপ। যে প্রদীপের আলোয় বিনাশ ঘটছে সব অশুভ শক্তির, সৃষ্টি হচ্ছে শুধুই প্রেম, ভালোবাসা, বৈরাগ্য।
    আজ প্রথমবার কোনও মন্দিরে এসে পারমিতাকে এক হাতে জড়িয়ে রেখেছে রাহুল। আজ ওঁরা দুজন এক হয়ে অর্পণ করছে ওঁদের মিলিত শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাসকে। আজ ওঁদের মিলিত সমর্পণ রাধাকৃষ্ণের দরবারে। আরতি দেখে, ফের একবার বাইকে ওঠার সময় রাহুলের পকেট থেকে একটা জিনিস মাটিতে পড়তেই, পারমিতা সেটা দেখে ওই আনন্দের মুহূর্তেও হঠাৎ করে চমকে উঠল। এই জিনিসটা যে পারমিতার খুব চেনা।
    একটা ফেন্সি ব্রেসলেট। এটা যে ওঁর নিজেরই সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ওঁর। কিন্তু এই ব্রেসলেটটা রাহুলের কাছে কি করে আসলো? এটা তো অনেকদিন আগেই…।
    এইসব এলোমেলো চিন্তার ভিড়েই রাহুলকে প্রশ্নটা করেই ফেলল পারমিতা,
  • এই ব্রেসলেটটা তুই কোথায় পেলি?? মানে এটা তো…।
  • হ্যাঁ। হারিয়ে গেছিল সেটাই ভাবছিস তো?
  • হ্যাঁ। কিন্তু?
  • সেবার কলেজে তুই এটা হারিয়ে ফেলার পর যা কেঁদেছিলিস, আমার এখনো মনে আছে। ওইদিন ক্লাস শেষে সবাই চলে যাওয়ার পর আমি গোটা ক্লাসরুম খুঁজেও যখন ব্রেসলেটটা না পাওয়ার কারণে দুঃখী মন নিয়ে বেড়িয়ে আসছিলাম, ওই মুহূর্তে জানালার বাইরে একটা কাককে ব্রেসলেটটা মুখে নিয়ে চুপটি করে রেলিংয়ে বসে থাকতে দেখলাম। ব্যাস! জেদ চেপে গেল। অনেক কাঠখড় পুরিয়ে যখন ব্রেসলেটটা হাতে এলো, তখন দেখি আমার ঠাকুমার দেওয়া ঘড়িটা আর আমার হাতে নেই। পুরনো ঘড়ি ছিল বলেই হয়ত রেলিংয়ের ঘষাঘষিতে ছিঁড়ে পড়ে গেছিল। অনেক খুজেও আর পাইনি জানিস।
    কথাটা শোনার পর লক্ষ্য করলাম পারমিতা নিজের ব্যাগ খুলে একটা প্যাকেট থেকে পুরনো সেই ঘড়িটা বের করে রাহুলের হাতে দিয়ে বলল,
  • পরদিন সকালে কলেজে ঢোকার মুহূর্তে ঘড়িটা আমার চোখে পড়েছিল। তবে, সবার সামনে নর্দমার ধার থেকে তুলব কিনা চক্ষুলজ্জার ভয়ে একটু দ্বিধাবোধ করছিলাম। পরে অবশ্য, চুড়িদারের ওড়নার আড়ালে ঘড়িটা তুলে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম এবং সেই থেকেই ঘড়িটা আমার কাছে রয়ে গেছে।
  • তাহলে এতদিন আমাকে দিসনি কেন?
  • ঠিক যেই কারণে তুইও আমাকে আর ব্রেসলেটটা ফেরত দিসনি।
  • আজ থেকে তাহলে আমাদের ভালোবাসার স্মৃতি হিসেবে একে অপরের এই দুটো প্রিয় জিনিস দুজনের কাছে রয়ে যাক।
    রাহুলের মুখে এই কথাগুলো শোনার পর পারমিতা যেন পুরোপুরি ভাবে স্থির হয়ে গেছিল। অনেক কথা ওঁর মনে এসে ভিড় করছিল। আর ও খুব শান্ত ভাবে রাহুলের দিকে চেয়ে ওর কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল।
  • পারমিতা তোর লেখা ওই কবিতার শেষ চারটে লাইন একবার শোনাবি??
  • কোন কবিতার কথা বলছিস, বলতো?
  • আরে, যেটা তুই আমাকে বলেছিলিস যদি কখনো প্রেমে পরিস, তখন তোর প্রিয়কে শোনাবি।
  • আচ্ছা, আচ্ছা। বেশ, শোনাচ্ছি।

এলোমেলো বিষন্নতা ভুলে,
পরিপূর্ণতায় মিল পাবে ভূবন।
অমিলগুলোকে হারিয়ে যেতে দিয়ে,
সপ্তপর্নীর সমাপ্তি লিখবে জীবন।

অনেক দিন ধরে আটকে থাকা একটা গল্প যেন আজ নতুন করে একটা আশ্রয় এবং পরিচয় পেল। এলোমেলো সুরের সাগরে মুক্ত প্রাণের ঢেউ স্পর্শ করল। ফেরার সময় পারমিতা রাহুলকে জড়িয়ে ধরে বলল,

  • শোন না, বলছি একবছর হওয়ার আগে যদি সুযোগ পাস, ছুটি নিয়ে আসিস প্লিজ।
  • আচ্ছা, সবকিছু ঠিক থাকলে আমি জলদি ফিরে আসব।
  • আর শোন, সাবধানে থাকিস, অপেক্ষায় থাকব।
    পারমিতাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে রাহুল ওঁর বাড়ির দিকে আগ্রসর হল। বাইক নিয়ে কিছুটা পথ যেতেই ওঁর চোখের সামনে গোটা পৃথিবীটাই যেন হঠাৎ করে থমকে দাঁড়াল। লোকজনের ভির দেখে ও বাইক থেকে নেমে সামনে একটু এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল ওঁর দেহটা তখনও বাইকের সঙ্গে রাস্তায় পড়ে রয়েছে। পুলিশ ও মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার লোকগুলো প্রবল বৃষ্টির কারণে, তখনও কাজে হাত দিতে পারেনি। সেদিন বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাহুল পারমিতাকে নিজের মনের কথা বলতে তো বেরিয়েছিল কিন্তু বাস্তবে পথদুর্ঘটনায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার কারণেই ওঁর মনের কথা পারমিতা অবধি আর পৌঁছতে পারেনি।
    তবে, সত্যি ভালোবাসা যে কখনোই মরে না। যেকোনো ছুতোয়ে পৌঁছে যেতে চায় তার নিজের প্রিয় মানুষটির কাছে। আর তাই তো কিছু গল্প মিথ্যে হয়েও, সত্যিকারের অনুভূতি আমাদের উপহার দিয়ে যায়।

সমাপ্তি

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।