ক্যাফে গল্পে সুমন

স্মৃতি

ছবিটা খুব ভাবাচ্ছে প্রীতিময় বসাককে। অনেকদিনের পুরনো হলুদ হয়ে যাওয়া একটা ছবি। ছবিটা প্রীতিময়বাবু হঠাত করেই খুঁজে পেয়েছেন তার শোয়ার ঘরের আলমারিতে রাখা পুরনো একটা বাক্স থেকে। খুব সম্ভবত ছবিটা লুকিয়ে রাখা ছিল। ছবিতে পাশাপাশি দুটো ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। দুজনে একে অন্যের কাঁধে হাত দিয়ে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ছবির বাঁদিকের ছেলেটি নিঃসন্দেহে প্রীতিময় বসাক স্বয়ং। কিন্তু ডানদিকের ছেলেটি কে? কিছুতেই মনে করতে পারছেন না প্রীতিময়বাবু। ছবিতে যে বাড়ির অংশটা দেখা যাচ্ছে সেটাও ঠিক মনে করতে পারলেন না প্রীতিময়বাবু। এমনিতেই বয়স মানুষের স্মৃতিতে যথেষ্ঠ মরচে ফেলে দেয়। তার ওপর বছর সাতেক বয়সে প্রীতিময়বাবুর একটা বড় দূর্ঘটনা ঘটেছিল। তাই তার আগের ঘটনা তার স্মৃতি থেকে এমনিতেই সব লোপ পেয়ে গেছে। দূর্ঘটনাটা যে কি, সেটা প্রীতিময়বাবুর বাবা-মা কোনও আত্মীয়-স্বজন কেউ কিছু তাকে খোলসা করে বলেননি। তাই সেই স্মৃতিও তার নেই। ছবিতে নিজেকে দেখে প্রীতিময়বাবু বুঝলেন এটা তার ছ’সাত বছর বয়সেরই ছবি। পাশের ছেলেটিও প্রায় তারই বয়সী, কিন্তু কিছুতেই ছেলেটির কথা স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনতে পারলেন না। এদিকে তার বাবা-মা দু’জনেই অনেক কাল হল দেহ রেখেছেন। বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে সেরকম কেউ আজ আর জীবিত নেই। এদিকে নিজেও তিনি সংসার ধর্ম পালন করেননি। তাই ছবিটার বিষয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করার মতও কাউকে পেলেন না তিনি। ফলে ছবিটা পাওয়া ইস্তক একটা অস্বস্তি উত্তরোত্তর তার মধ্যে বাড়তেই থাকল।
এক ডিটেকটিভ এজেন্সির সঙ্গেও যোগাযোগ করলেন তিনি। সেখানকার কর্ণধার জানালো যে এত পুরনো সময়ের কোনও কেসের এভাব নিষ্পত্তি করা খুবই কঠিন। তবে প্রীতিময়বাবু চাইলে তিনি খবরের কাগজে এবিষয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে দেখতে পারেন। তবে তাতেও কতটা কাজ হবে সেটা বলা যায় না।
একটা অদ্ভুত অস্বস্তি ক্রমশ গ্রাস করতে থাকল প্রীতিময়বাবুকে। তার স্মৃতি কাজ না করলেও তার মনে বারবার উদয় হতে থাকল একটা দুশ্চিন্তা। তার বার বার মনে হতে থাকল এই ছবিটার সঙ্গে কোনও এক অপ্রীতিকর ঘটনা জড়িয়ে আছে। এমন কোনও ঘটনা যার শেষটা ঠিক সুখকর হয়নি। নাকি আদৌ সেই ঘটনার কোনও শেষ ছিল? যতবার ছবিটা দেখেন প্রীতিময়বাবু ততবার অন্য ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে তার একটা অপরাধবোধ জেগে ওঠে। মাঝেমধ্যে ঘুমের ঘোরে কোনও বালকের আর্তনাদ শুনতে পান। কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। এই ছেলেটির বিষয়ে কিছুই মনে না পড়াটা প্রীতিময়বাবুর মনের উদ্বেগটা আরও বাড়িয়ে দেয় দিন কে দিন। নানারকম আশঙ্কা এবং সংশয় দেখা দেয় তার মনে। নিজের জীবনের সবচেয়ে আগের থাকা স্মৃতিগুলোকে মন্থন করেও কোন কুলকিনারা করতে পারেন না প্রীতিময় বসাক। আর কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকার আশঙ্কাটা আরও দিন দিন পীড়াদায়ক হয়ে উঠছে প্রীতিময়বাবুর কাছে। এই রহস্যের কিনারা না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছেন না তিনি। শেষে এবিষয়ে আর কোনও উপায় না দেখে প্রীতিময়বাবু ঠিক করলেন ছবিসহ তিনি কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন। অবশেষে বেশ কয়েকটি নামকরা বাংলা এবং ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্রে ছবিসহ বিজ্ঞাপন দিলেন প্রীতিময়বাবু। ছবিটার সঙ্গে তিনি নিজের নাম-ঠিকানা, ফোন নাম্বার সবদিয়ে লিখে দিলেন যে ছবিটিতে ডানদিকে যে ছেলেটি রয়েছে তার পরিচয় যদি কেউ জানে সে যেন যত শীঘ্র সম্ভব তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিজ্ঞাপনটা সবকটা কাগজে একসাথে একই দিন প্রকাশিত হল। এর দুইদিন পর একটা ফোন পেলেন প্রীতিময়বাবু। একজন ভদ্রলোক ফোনে বললেন তিনি এই ছবির বিষয়ে কথা বলতে চান। প্রীতিময়বাবু আর বিলম্ব না করে সেইদিনই সন্ধ্যেবেলায় ভদ্রলোককে আসতে বললেন। ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা নাগাদ ভদ্রলোক এসে উপস্থিত হলেন। প্রীতিময়বাবু দেখলেন যিনি এসেছেন তাকে অল্পবয়সী ছেলে বলাই ভালো। ছেলেটি নীচের বৈঠকখানায় বসে ছিল। প্রীতিময়বাবু তার চাকরের কাছ থেকে খবর পেয়ে নীচে নেমে এলেন। তাকে দেখেই ছেলেটি উঠে দাঁড়ালো। বছর তিরিশেক কি তারও কম বয়স ছেলেটির।
প্রীতিময়বাবু তাকে বসতে বলে নিজেও একটা গদি লাগানো চেয়ারে বসলেন। তারপর বললেন, ‘বয়সে তুমি আমার থেকে অনেকই ছোট দেখছি। তাই তুমি বলেই সম্বোধন করলাম। কিছু মনে কর না। তা এবার বল ছবির এই ডানদিকের ছেলেটি কে?’
ছেলেটি এবার একটা খবরের কাগজ নিজের হাতের প্যাকেট থেকে বের করে আনল। তাতে একটা বিশেষ খবরের দিকে আঙুল নির্দেশ করে সে কাগজটি প্রীতিময়বাবুর হাতে তুলে দিল। প্রীতিময়বাবু সংবাদটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন ছোট একটা কলাম। তার শিরোনাম, ‘বিশিষ্ট চিত্রকর এবং শিল্পী প্রমোদ মুন্সীর জীবনাবসান’ এবং এই শিরোনামের তলায় এই সংক্রান্ত ছোট একটি প্রতিবেদন। প্রীতিময়বাবু খবরটা পড়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকালেন। ছেলেটি এবার একটু গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলতে শুরু করল, ‘আপনি যাঁর ছবি আপনার বাল্যবয়সের ছবির সাথে কাগজে ছাপিয়েছিলেন তিনি ইনি। যে খবরের কাগজটা আমি আপনাকে দেখালাম সেটা মাস চারেক আগেকার। এই প্রমোদ মুন্সী ছিলেন আমার বাবা। আমি তাঁর একমাত্র সন্তান বিনোদ মুন্সী। যে ছবিটি আপনি ছাপিয়েছেন সেটি সম্ভবত দেওঘরের কোনও লজ-এ। কারণ আমার যখন বছর দশেক বয়স তখন বাবা আমাকে আর মাকে নিয়ে দেওঘরে বেড়াতে গিয়ে ঐ লজেই উঠেছিলেন। আপনাদের ছবির পেছনে যে দেওয়ালটা দেখা যাচ্ছে আমরা যখন দেওঘরে গিয়ে ঐ লজে উঠি তখনও ওটা ওরকমই ছিল। আমার এখনও মনে আছে বাবা ওটা দেখে বলেছিলেন, ‘আজও দেখছি সেই একইরকম রয়েছে’। বাবা তখনই আমাদের কাছে গল্প করেছিলেন যে খুব ছোটবেলায় বাবা-মা’র সাথে বাবা দেওঘরে বেড়াতে এসে এই লজেই উঠেছিলেন। তখন নাকি এখানে আরও একটি বাঙালি পরিবার ছিল। তারাও বেড়াতেই এসেছিল। বেশ অনেকদিনই দুই পরিবার এখানে কাটায়। ঐ পরিবারের একটি ছেলে যে নাকি বাবারই সমবয়সী তার সঙ্গে বাবার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনই একদিন ওখানকার কোনও পাহাড়ী এলাকায় ঘুরতে গিয়ে একটি দূর্ঘটনা হয়। ঐ দ্বিতীয় পরিবারের ছেলেটি একটি টিলার থেকে নীচে পড়ে যায়। নেহাত দূর্ঘটনা। কিন্তু ঐ ছেলেটির বাবা-মায়ের মনে হয় বাবা ইচ্ছে করে তাদের ছেলেকে নীচে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন। ঐ ছেলেটিকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ছেলেটির নাকি স্মৃতিভ্রংশ হয়ে গিয়েছিল। আমার ঠাকুর্দা ঐ পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় ফিরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ঐ পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে ঐ ছেলেটির জীবন সংশয় কাটানোর জন্য ডাক্তার নিদান দিয়েছেন দেওঘরে বেড়াতে যাওয়ার কোনও স্মৃতি যেন আর তার সামনে রাখা না হয় এবং ওনারা আমার ঠাকুর্দাকে ওনাদের সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ রাখতে বারণ করে দেন। একথা আমি বড় হওয়ার পরেও বাবা অনেকবার বলেছেন। আমি নিঃসন্দেহ এটি সেই দেওঘরেরই ছবি আর এই দ্বিতীয় ছেলেটি আপনি। বাবার স্মৃতি থেকে আপনার নামটা মুছে গিয়েছিল কিন্তু ঘটনাটা তিনি কোনওদিনই ভুলতে পারেননি। যেহেতু দূর্ঘটনার দায়টা ওনার ঘড়েই পড়েছিল। ওনার মনে হত অন্তত একবার যদি আপনাদের পরিবারের কারও সঙ্গে দেখা করে নিজের নিরপরাধ সত্ত্বার কথা বলতে পারতেন। কিন্তু সেটা আর হল না। আপনি যদি কয়েকমাস আগেও বিজ্ঞাপনটি দিতেন তাহলে হয়ত আমার সঙ্গে বাবাও একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। কিন্তু আজ সেটা আর সম্ভব নয়’। এতটা একবারে বলে বিনোদ একটু থামল। প্রীতিময়বাবুও একটা অদ্ভুত আচ্ছন্ন অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন। বিনোদ এত ঘটনার কথা বলার পরেও তার মনে বিন্দুমাত্র কোনও স্মৃতির উন্মেষ ঘটেনি কিন্তু বিনোদের চোখের দৃষ্টি আর তার বাচনভঙ্গি দেখে তিনি এটা স্পষ্ট বুঝেছেন যে বিনোদ যা বলছে তার সব একশোভাগ সত্যি।
এরপর বিনোদ নিজের হাতের প্যাকেট থেকে একটা ক্যানভাস বের করল। তারপর প্রীতিময়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা বাবার আঁকা শেষ ছবি। বাবা হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন তার হাতে আর বেশি সময় নেই। তাই মৃত্যুর মাসখানেক আগে আমাকে এই ছবিটা দিয়ে বলে যান আমি যদি কোনওভাবে সেই পরিবারের কারও খোঁজ পাই তাদের যেন বাবার তরফে এই ছবিটা দেখাই। এই নিন’। এই বলে বিনোদ ছবিটা এগিয়ে দিল প্রীতিময়বাবুর দিকে। প্রীতিময় বসাক ছবিটা হাতে নিয়ে দেখলেন সুনিপুণ হাতের আঁকা একটি ছবি। একটা টিলার শিখর, পিছনে ঝর্না বয়ে যাচ্ছে। টিলার ওপর দুটি বছর সাত-আটের দুটি ছেলে আর কেউ নেই। একটি ছেলে টিলার সামনের দিকে পাথরে হোঁচট খেয়ে নীচে পড়ে যাচ্ছে আর অন্য ছেলেটি বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে। দ্বিতীয় ছেলেটির হাতের ভঙ্গি বুঝিয়ে দিচ্ছে সে প্রথম ছেলেটিকে পড়ে যাওয়া থেকে আটকাতে চাইছে কিন্তু দুজনের মধ্যে দূরত্ব এতটাই যে দ্বিতীয় ছেলেটির পক্ষে প্রথম ছেলেটি পর্যন্ত পৌছানো সম্ভব নয়। দ্বিতীয় ছেলেটির মুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে সে সাহায্যের জন্য চীৎকার করছে’। ছবির দৃশ্যটা এক লহমায় প্রীতিময়বাবুর চোখের সামনে বহুবছরের পুরনো এক স্মৃতি যেন এক লহমার জন্য জীবন্ত করে দিয়েই আবার নিভে গেল। ছবিটা হাতে ধরে থাকা অবস্থাতেই প্রীতিময়বাবুর চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ক্যানভাসের ওপর।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।