সম্পাদকীয়

এই মহামারী আর বিষন্নতার মাঝেও পৃথিবীতে সব কিছুই আসছে যাচ্ছে।
অন্য প্রাণীদের কিন্তু কিছু যায় আসে না।
গুরু পূর্ণিমা এলো, এবং সামনে আসছে শিল্পী শ্রী কিশোরকুমারের জন্মদিন।
এই সব মিলিয়ে স্মৃতির মালা পরাই আজ।
বাবা কখনো জ্ঞান দিতেন না। শাসন বা অনুশাসনের একটাও চ্যাপটার শেখানো তাঁর অভ্যাস নয়। গান তাল রাগও কখনো মুখে বলে শেখাতেন না। সবই তাঁর গলার গান হয়ে কান থেকে প্রানে চলে আসতো।
প্রেমে জল হয়ে গলে যেতে হবে,আর প্রেমধন মায়ের মতন, দুঃখী সুতেই অধিক যতন,সেও শুনি। আর নীচুর কাছে নীচু হতে হবে, সকল ঘরে সকল নরে আছেন নারায়ণ সেও শুনি।
জ্ঞান হতে হতে রোজ রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে বাবার গলায়, মন যদি না মানিক হল, তবে যে মণিহার পড়ে কোন লাভ হয় না, চোখ ভোলানো যায় গো শুধু মন ভোলানো যায় না। আর গুণ না থাকলে রূপের ছটায় যে জন ভোলে সে জন ভালো বাসবে না, এই কথা সুরে গেঁথে বুকের গভীরে দাগ কেটে থেকে গেল।
তাই সাজতে আপত্তি ছিল ছোটবেলায় খুব বেশি রকম। মায়ের শাসনের চেয়ে বাবার ঘুমপাড়ানী গানেরা অনেক বেশি সাবধান করে রাখত মনের ভেতরকে।
কত শিক্ষা অনায়াসে পেতাম।
সেই যে লোডশেডিংয়ের সন্ধ্যে, যাকে চোখ বুঝলেই ছুঁতে পারি।
মা স্ত্রোত্র পাঠ করতে করতে সন্ধ্যা দিচ্ছেন আমাদের ১সি চারু এভিনিউর ঘরে। হাতে ধূপ।
পুজোর কাছাকাছি সময়। মাইকে কিশোর কুমারের গলায় সারাদিন বাজে,
” আমার পুজোর ফুল ভালবাসা হয়ে গেছে, তুমি যেন ভুল বুঝোনা। ”
বাবা বাজারে যাবেন অপেক্ষা করছেন, মায়ের পুজো হলে ফর্দ নিয়ে বেরোবেন।
আমি, চিরকেলে বাপ ক্যাংলা, বাবা জামা গলালেই, আমিও যাবোওও, বলে সানাইয়ের মত পোঁ ধরি, পাশে দাঁড়িয়ে আছি । বাবা চোখ বুজে গাইছেন, ” আমার পুজার ফুল… ”
মা একটু বিরক্তির আওয়াজ করে বললেন, সন্ধ্যা দিই।
একটু গোঁড়া মানুষ ছিলেন তিনি।
বাবা চোখ খুলে বললেন, হ্যাঁ, আমি পুজোর গানই গাইছি যে।
মা একেবারে চুপ।
ক্লাস এইট বুঝে গেল, সারা জীবনের জন্য,
এক ঃগানের কোন জাত হয় না।
দুই ঃ ভালবাসাই ঈশ্বর ।
তাই মহাগুরু বলে বাবা মশাইকেই মানি।
এদিকে মায়ের নিয়মে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল আর ভক্তিগীতি ছাড়া অন্যকিছু শোনা আমার বারন ছিলো ।
আমি ক্লাস ফাইভ পার হয়েই বালিশের তলায় ফিলিপ্সের রেডিও রেখে পুনপুন করে বিবিধভারতীর নিষিদ্ধ গান শুনতাম, ও মেরে দিল কি চেন, ভিগি ভিগি রাতোঁ মে । মা জানতে পারলে কি যে শাস্তি হবে ভাবতে ও পারিনা । আর ভাগ্যিস মাইক আছে। আহা। তাকে কেউ ঠেকাতে ত পারেনি ।
সারা দিন মুচকে হেসে ক্লাস থ্রি গান গেয়েছে , তারে আমি চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি।
আর ভাগ্যিস বাবা আছে।
অফিস থেকে ফিরলে, মা রান্না ঘরে গেলেই আমরা দুই বেস্ট ফ্রেন্ড মুখোমুখি বসে কি দরদ দিয়ে গান গাই, কি আশায় বাঁধি খেলাঘর, আর মহা আনন্দে দম মারো দম গান শেষ হয় দু জনে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে হরে কৃষ্ণ হরে রাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম… বলে হো হো করে হেসে।
কোন পুজোর দৈনিক আচার করতে দেখতাম না যে মানুষটিকে, তিনি রোজ অন্ধকারে আমার মাথার কাছটিতে শুয়ে যখন রোজ আরও অনেক গানের মধ্যে গাইতেন, ফুলের মালা দীপের আলো ধূপের ধোঁয়ার পিছন হতে পাইনে সুযোগ চরণ ছোঁয়ার… তখন অবোধ শৈশবের নবীন প্রাণ কেমন করে টের পেত এইটেই উপাসনা। এই মানুষটিই সত্যিকারের ভক্ত মানুষ ।
অনেক পরে শক্ত পুঁথির পাতায় ভাগবতের উক্তি পড়ে , এই অনুভূতির সমর্থন পেয়ে বেজায় খুশী হয়েছি।
ঈশ্বর নাকি বলছেন, আমার ভক্ত যেখানে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আনন্দে গান গায়, হে নারদ, তত্র তিষ্ঠামি, আমি সেইখানেই আছি জানবে।
আমি তাই সুরের আনন্দকেই ধর্মাচরণ বলে জড়িয়ে রাখলাম।
তাই মনে রাখি সব সময়, প্রাণ থাকলে গান ও থাকবে।
তাই গান ভালবেসে গান।

সোনালি

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।