অর্থাত্, “”দ” অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, “গ” অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।”
অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলেছে, “দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা”। অর্থাত্, যিনি দুর্গ নামে অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সব সময় দুর্গা নামে পরিচিত।শ্রীশ্রীচণ্ডীঅনুসারে যে দেবী “নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ” (সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি), তিনিই দুর্গা।
আবার আমার শ্রীপাদ আমায় মনে করিয়েছে, “বিশ্বানি নো দুর্গহা”।
দশমী পড়েছে অনেকক্ষণ, দেবী বিসর্জনও হয়ে গেছে প্রায় সর্বত্র। কিন্তু এই দশমী বিজয়া কেন। বিজয়া দেবী অপরাজিতার জন্য। দশমীর দিনে বিসর্জনের পুজো সমাপ্ত হলে হয় দেবী অপরাজিতার পুজো। আর দশমীর বিসর্জনের পুজোতেও সাদা ও নীল অপরাজিতা থাকবেই। এদিন নীল অপরাজিতায় গাঁথা মালা পরানো হয় দেবীকে। মূলত বাড়ির পুজোতেই এই অপরাজিতার পুজোর চল রয়েছে। দেবী দুর্গারই অন্য রূপ অপরাজিতা। সব বাধা-বিপদ দূর করতেই অপরাজিতার পুজো প্রচলন হয়। আগেকার দিনে দশমীর দিন রাজারা যুদ্ধযাত্রায় যেতেন। এছাড়াও এই দিন রাবণ বধ হয় সর্বত্র। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রয়েছে যুদ্ধযাত্রার জন্য এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।
স্কন্দপুরাণে দেবী দুর্গার একটি মূর্তির নাম ‘অপরাজিতা’। আশ্বিনের শুক্লাদশমীতে একে ঈশান কোণে রেখে অপরাজিতা ফুল দ্বারা অর্চনা করলে গৃহীর মনোবাসনা পূর্ণ হয়। তাই আজও বাংলার তন্ত্রসাধকগণ শারদীয় দুর্গাপূজার কাজ শেষ করেন অপরাজিতা লতার বেষ্টনী ও ফুল দ্বারা। আবার অথর্ববেদের রাজকল্পে আছে দুর্গ বিজয়ের পর নিজের বিজিত সীমানা চিহ্নিত করার জন্য অপরাজিতা রোপণ করে। ফুলটির নামই যে অপরাজিতা।আবার অপরাজিতা-বিদ্যাটি এককালে মনীষীদের কাছেও খুবই মাননীয় ছিল। কালিদাস শকুন্তলা কাব্যে অপরাজিতা-বিদ্যা ও অপরাজিতা পুষ্পের উল্লেখ করেছেন। অপরাজিতা-বিদ্যা দ্বারা দেবরাজ ইন্দ্র বৃত্র নামক অসুরকে বধ করেন। এই বিদ্যা হলো প্রথমে কপট উপায়ে ইন্দ্রকে বৃত্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে। মিত্রতাসূত্রে ইন্দ্রের প্রতি বৃত্রের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালে বিষ্ণু বজ্রের মধ্যে গুপ্তভাবে প্রবেশ করবেন। সেই বজ্রের আঘাতে ইন্দ্র বৃত্রকে বধ করবেন। বজ্র হলো ইন্দ্রের অমোঘ অস্ত্র। অপরাজিতা-বিদ্যা হলো তাই দৈবের আশ্রয়ে চিকিৎসা। অর্থাৎ মন্ত্রতন্ত্র দ্বারা চিকিৎসা। এই বিদ্যা প্রাচীন কালে খুব মাননীয় ছিল। এখনও কোথাও কোথাও গুপ্তবিদ্যা হিসাবে প্রচলিত আছে। এখন শারদীয় পূজা, মা দেবী দুর্গার আরাধনা। তিনি পরমপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ ও শিবপত্নী। মহিষাসুরকে বধ করার জন্য দেবতাদের সমবেতভাবে উৎপন্ন তেজ হতে তিনি আবির্ভূত হন। সকল দেবতা তাঁদের নিজ নিজ অস্ত্রসমূহ এঁকে দান করেন। এভাবে মানব ও দেবতাদের অজেয় মহিষাসুরকে তিনি দমন করেন। সত্য যুগে সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য দুর্গামূর্তি প্রস্তুত করে তিন বছর পূজা করেছিলেন।
দশমীর পুজোর পর অপরাজিতা গাছকে পুজো করা হয়। বাড়িতে যদি সাদা অপরাজিতার গাছ থাকে তাহলে খুব ভালো। দেবীরূপে অপরাজিতাকে ফুল, বেলপাতা দিয়েই পুজো করা হয়। অনেক বাড়িতে ঘটস্থাপনও করা হয়। পুজোর শেষে হাতে বেঁধে দেওয়া হয় অপরাজিতার ডাল। প্রার্থনা জানানো হয়, ‘অপরাজিতা, তুমি সর্বদা আমার বিজয় বর্ধন কর। তুমি শত্রু নাশ করে নানা সমৃদ্ধির সহিত আমাকে বিজয় দান কর। রামচন্দ্র যেমন রাবণের উপর বিজয় লাভ করেছিলেন, আমারও যেন সেইরূপ জয় লাভ হয়।’
আমরাও সেই প্রার্থনাই করি। মা সকলকে বিজয়ী করো। উদ্ভাসিত করো।