সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ২)

পুপুর ডায়েরি

৩|
তখন আমার জন্য ” ঝুমঝুমি” আসতো। তার মলাটের ওপরে লেখা থাকতো, খুদে পাঠকের খুদে পত্রিকা। পাক্ষিক পত্রিকা।
সরল দে আর গীতা দত্ত সম্পাদক ছিলেন। সে ছোট্ট পত্রিকা যে কি ভালোই ছিলো। এখনো বাঁধানো বইগুলো পড়ে আমার ছেলেমেয়ের মন ভালো হয়ে যায়

ছোট্ট বই, চার পাঁচ ইঞ্চি। যে দিন নতুন সংখ্যা আসতো,বাড়িতে আমাদের তিন জনেরই মনে হত উৎসব।
“বা” পড়ে শোনাতেন বেশী ভালো ছড়া বা গল্পের টুকরো, শুনতে শুনতে আমি আর মা হেসে কুটিপাটি হতাম।
মনে হত তিন জনে মিলে স্বর্গে আছি।
টের পাইনি, মা আলাদা করে খেতে বসে না, আমার থালায় আমার সঙ্গে দু এক গ্রাস খেয়েই উঠে পড়ে। কিংবা সারা বছরে একটাই ভালো জামা হয়।
এ নিয়ে বোধ বা দু:খ কোনটাই ছিলো না। এত আনন্দে থাকতাম, ইংরেজিতে যাকে বলে, আই ফেল্ট লাইক আ প্রিন্সেস, রাজকন্যেরাও এত আরামে থাকে না বোধহয়।

৪|
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, সেই পু-দাদের বাড়ির কথা।
ওখানে আসতে আসতে, আমি পড়তে শিখে গেছিলাম।
তখন আমি দুই বছর।
ইংরেজিটা পড়তে একটু দেরি হত।
খুব সুন্দর একটা রাইমসের বই কিনে দিয়েছিল “বা”। সেই ছড়ার বইখানা নিয়ে ছবি দেখতাম বসে। কিন্তু, “স্পেলিং ” করে পড়তে হত বলে রাগ হত।
এখনো আছে সে বই। মোটা মোটা পাতা, অপূর্ব সব ছবি, নতুনের মতো ঝকঝকে।

কিন্তু বাংলা পড়তে একটুও দেরি হত না।

সেই যে আমার নিজের ” খুদে পাঠকের খুদে পত্রিকা “, তিন চার ইঞ্চি মত পত্রিকা, ঝুমঝুমি, মাসে দুবার আসে, তার জন্য ত অধীর আগ্রহে তিন জনেই বসে থাকতাম। তাই বলে বাকি বই পড়তে ও কোনো কমতি ছিলো না।

খুব বেশি বারে বারে পড়া হত, ” বিদ্যার্থী রঞ্জন “,আমাদের নিজেদের পত্রিকা।
রাসবিহারীর মোড়ের ম্যাগাজিন স্টলে মাসের প্রথমে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম বাবার সঙ্গে। বই বিক্রি হচ্ছে দেখতে কি ভালোই লাগতো। সে একটা অন্যরকম উত্তেজনা।

“বিদ্যার্থী রঞ্জন” একটি অভিনব বাংলা পত্রিকা। তার কপি এখনও ন্যাশনাল লাইব্রেরী, বা গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশনের লাইব্রেরীতে রাখা আছে, পাওয়া যায়।
আমার জন্মের আগের দিন, ২৭শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৭ সালে জন্মেছিল এই পত্রিকা।
সেদিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাইয়ের জন্মদিন, তাই। বিদ্যাসাগরই ছিলেন এই পত্রিকার ভাবধারার শিকড়, আজকাল যাকে বলে থিম।

বাবা এবং মা, যিনি আইনগত ভাবে এ পত্রিকার সম্পাদিকা, কেবলই ভাবতেন, ছোটো মানুষদের জন্য একটা ভালো পত্রিকা, মানে যে পত্রিকা আমাদের দেশের ইতিহাস, স্বাধীনতার লড়াই আর রেনেসাঁর রাস্তাটুকু সম্বন্ধে জানাবে, এমন পত্রিকা বড়ো দরকার। পঞ্চাশ বছর আগেই এই দুই বুদ্ধিমান মানুষ টের পাচ্ছিলেন, আমরা কত তাড়াতাড়ি ভুলে যাচ্ছি ভারতীয় সংস্কৃতিকে খুঁজে বের করতে পরাধীন দেশের মানুষ কত পরিশ্রম করেছে।

Spread the love

You may also like...

error: Content is protected !!