ক্যাফে কলামে সঙ্কর্ষণ

সমুদ্রের তীরে নুড়ি কুড়িয়েছিলেন যিনি
তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগসমূহের অন্যতম ছিলো যে নারীজাতির প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব পুরুষের তুলনায় অধিকতর। এতদ্দ্বারা তিনি যে কেবল আপন পৌরুষেরই অবমাননা ক’রছেন তা’ই নয়, আপামর বাঙালির পুরুষতান্ত্রিক সমাজবোধও ধিক্কৃত হ’চ্ছে। কোনো এক পরিচিতকে এর স্বপক্ষে তিনি যুক্তি দিচ্ছেন যে বাল্যকালে রাইদিদির সান্নিধ্যলব্ধ মানুষ যদি নারীকূলের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ না থাকে, তবে তার মতো কৃতঘ্ন, পামর পৃথিবীতে দ্বিতীয় নেই।
রাইদিদি অর্থাৎ শ্রীমতী রাইমণি দাসী ছিলেন ভূস্বামী শ্রী জগদ্দূর্লভ সিংহের বিধবা বোন, যিনি উল্লিখিত ব্যক্তির সম্পর্কিত কোনো স্বজন আদৌ নন, বরঞ্চ তাঁদের পরিবারের অন্নদাতা মাত্র। আপন জমিদারীর হিসাবরক্ষকের জ্যেষ্ঠপুত্রটির ইংলিশ ও গণিতে বাল্যকালে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি দেখে শ্রী সিংহ তাঁদের মানুষ ক’রে তোলার দায়িত্ব নেন। সেখানেই তাঁর প্রাথমিক অধ্যয়ন। কারো মুখাপেক্ষী হ’য়ে থাকতে অনভ্যাস সত্ত্বেও স্নেহকে উপেক্ষায় তিনি অক্ষম।
ধর্তব্য যে স্বাধীনচেতা মনোভাবের সঙ্গে হৃদয়ের কোমলতার যে সহাবস্থান, তার শিক্ষা অন্যান্য স্বনামধন্য মণীষার মতো কেবল স্বতঃস্ফূর্তভাবেই গ’ড়ে ওঠেনি তাঁর মধ্যে। বস্তুতঃ এই প্রেক্ষিতে অনেকের তুলনায় তিনি উচ্চস্থানে আরোহণ ক’রেছেন যে নিদারুণ আর্থিক সমস্যার মধ্যে থেকেও তাঁর অভিভাবকগণ নৈতিক শিক্ষাটুকু স্বস্থানে প্রবেশ ক’রিয়ে দিতে সক্ষম হ’য়েছিলেন। তাঁদের সম্পর্কে বাঙালি হয় নিতান্ত অজ্ঞ, নতুবা সম্পূর্ণই অজ্ঞাত।
বাল্যকালীন পাঠশালার শিক্ষক শ্রী শম্ভুচরণ বিদ্যারত্ন যখন শ্রী ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানান যে হিন্দু কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানেই পুত্রের আদর্শ বিকাশ হবে, তখন গর্বিত পিতার বক্তব্য অনুযায়ী বিদেশী শাসকের সেবা করার জন্য নয়, বরঞ্চ দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিসাধনেই সন্তানকে উপযুক্ত ক’রে তোলা তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। বাঙালি কেবল জানে যে সেই লক্ষ্যে শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পুত্রকে রাত্রে গ্যাসের আলোয় অধ্যয়নে বাধ্য ক’রেছেন।
কিন্তু অধিকাংশেরই যেটুকু অজ্ঞাত, তা হ’লো কেবল আহ্নিকের মন্ত্র মুখস্থ রাখতে অসমর্থ হওয়ায় আপন দশমবর্ষীয় সন্তানটিকে সম্পূর্ণ ২দিন অভুক্ত রেখেছিলেন তিনি, কেবল জলগ্রহণেরই অনুমতি ছিলো। প্রতিদিনের বাজার ক’রে এনে, সেই একই আলু, পটল দিয়ে বাটামাছের ঝোল রান্নাশেষে আহার সেরে, সন্ধ্যেয় ৩টি ঘণ্টা কোনোক্রমে কিছু ‘সংস্কৃত শ্লোক’ মুখস্থ ক’রে, রাত্রি ৯টায় ছেলেটি চোখ বুজতে পারতো, রাত্রি ১২টায় ওঠার শর্তে।
আর্মানি চার্চের ঘণ্টা শুনে উঠতে মুহূর্তকাল বিলম্ব হ’লেও পুত্রকে বীভৎস প্রহার ক’রতেন পিতা। সকলের খাওয়া শেষ হ’লে তবে সে বসার অনুমতি পেতো। যেখানে রান্নাঘর তার পাশে প্রতিবেশীগণের পয়োঃপ্রণালী থাকায় সেই মলের কীট উঠে আসতো রান্নাঘরে খেতে বসা ছেলেটির পাতে। ঐ অবস্থাতেই একহাতে জল ছুঁড়তে ছুঁড়তে অন্য হাতে খাওয়া চ’লতো তার। অন্নদাতা নিজগৃহেই থাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাকে, কিন্তু গৃহীত হয়নি।
শ্রী চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে জনৈক গবেষকের লেখনীতে প্রথম মায়ের ডাকে বর্ষণস্ফীত দামোদর পার করার কাহিনীর প্রচলন হয়, যাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ ক’রে দেন আলোচ্য ব্যক্তির কনিষ্ঠ সহোদর শ্রী শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন। তাঁর বক্তব্য ছিলো যে ব্যক্তিপূজন যখন মাত্রাতিরিক্ত হ’য়ে পড়ে, তখন এহেন কল্পকাহিনীর প্রয়োজন হয়। তাঁর অগ্রজের জীবন স্বাভাবিকভাবেই ঘটনাবহুল ও জনপ্রিয়, তা অহৈতুকি অতিরঞ্জিত করার অর্থ কেবল তাঁর অপমান।
প্রশ্ন হ’লো, পার্শ্ববর্তী এই প্রত্যেকটি মানুষ, প্রধানতঃ তাঁর পিতৃদেব ঠিক কতোখানি প্রভাবিত ক’রেছিলেন শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে? সত্যিই কি কবিগুরুর কথানুযায়ী, বাঙালি নির্মাণে রত বিধাতাপুরুষ ভুলবশতঃ একটি ‘বিদ্যাসাগর’ গঠন ক’রে ফেলেছিলেন? নাকি সংস্কৃত কলেজের মাসিক বৃত্তি থেকে কেবল প্রয়োজনীয়টুকু রেখে অবশিষ্ট অবৈতনিক পাঠশালা খুলতে গ্রামে পাঠানোর পিতৃ-আদেশই তাঁর দানসাগর হ’য়ে ওঠার প্রাথমিক পাঠ?
এমন এক চরিত্র, যাঁর বিশ্লেষণ করাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধৃষ্টতা, সেই জীবনচরিত অনুধাবনে বোঝা সম্ভব যে কষ্টসহিষ্ণুতার পাঠই ভবিষ্যতে তাঁর অন্তস্থ ইস্পাতকঠিন মনোভাব ও সহানুভূতির কোমলতাকে পরস্পরের পরিপূরক হ’য়ে উঠতে সাহায্য ক’রেছিলো। পিতৃ-আদেশে যিনি সরকারি ‘জজ পণ্ডিতের’ মতো লোভনীয় পদ প্রত্যাখ্যান ক’রতে সমর্থ, একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব সংস্কৃত কলেজের সহ-অধ্যক্ষের আসন এককথায় ত্যাজ্য করা।
সেইসময় সংস্কৃত কলেজ ব্যবস্থাপনাতেও আলোড়ন যে চাকরি ছেড়ে তাঁর চ’লবে কীভাবে? অথচ তত্ত্বাবধানে থাকা একাধিক ছাত্রের (যাদের একজন সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে বাংলা শিখতে আসা মারাঠী পণ্ডিত) কাউকেই সেই বিষয়ে দুশ্চিন্তা ক’রতে হয়নি। পরবর্তীকালে যখন উচ্চতর পদে স্বয়ং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিকতর বেতনে তাঁকে নিয়োগ ক’রেছে, তখন তাদেরই জনৈকের অনুরোধে তিনি খিচুড়ির পরিবর্তে ২বেলা মাছের ব্যবস্থা করেন।
প্রচারবিমুখ ও বেশভূষা অতি সাধারণ হওয়ায় কেউ তাঁকে মালী বা কুলী ব’লে ভুল ক’রতো, কেউ তাঁকেই সরাসরি জানাতো যে সে স্বচক্ষে দেখেছে যে বিদ্যাসাগর ব্রিটিশ পোষাকে বিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ ক’রে থাকেন। তবে এই একই পরিচ্ছদে বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে মানুষের হতাশার কারণ হন বহুবার। বাঙালি জাতির চিরাচরিত আদর্শ ‘সাধারণ যাপন ও অসাধারণ চিন্তনের’ (সিম্পল লিভিং অ্যান্ড হাই থিঙ্কিং) প্রতিমূর্তি ছিলেন শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়।
ইদানিং বঙ্গীয় নবজাগরণ সম্পর্কে নূতন প্রজন্মের বিতৃষ্ণার অন্যতম স্থল, এককালে ব্রিটিশ শাসনের সহযোগিতা প্রার্থনা। কিন্তু মিস্টার ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের নিকট নারীশিক্ষা সম্পর্কে সাহায্য গ্রহণের বহু আগে, স্বয়ং কোম্পানিশাসিত শিক্ষাপর্ষদ যে কেবল তাঁর কর্তৃত্বে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য একটি নূতন পদ ‘বিশেষ পরিদর্শক’ বা স্পেশাল ইন্সপেক্টর সৃষ্টি করেন, তা নিয়ে গর্বিত হওয়ার মানুষ নিতান্ত কম। বেতনক্রম ঠিক হয় ৭০০/-।
কিন্তু একথাও শত শতাংশ সত্য যে যখন মাসিক ২/- বেতনে প্রায় ৬জনের একটি পরিবার নিশ্চিন্তে গ্রাসাচ্ছাদন চালাতে সমর্থ, সেই সময় উক্ত বেতন না পেলে তত্ত্বাবধানে থাকা এতো সংখ্যক মানুষ, এতোগুলি অবৈতনিক পাঠশালা, স্ত্রীশিক্ষাবশতঃ অজস্র উদ্যোগ, সর্বোপরি নারী ও নিম্নজাতির অধিকারের আন্দোলনগুলি বজায় রাখা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিলো। সহস্র অবিচারেও তুচ্ছ প্রাপ্তিবশতঃ স্বজাতির প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ ছিলোনা তাঁর।
ফলস্বরূপ সামান্য দড়ির টুকরোও যত্ন ক’রে আলমারিতে রাখতেন তিনি, লোকে কৌতুক ক’রতো তা’ই নিয়ে। অথচ ১৮৬০এর আশেপাশে সামান্য পরিচিত এক যুবক যখন সুদূর ইংল্যাণ্ড থেকে সাহায্য চাইলো তাঁর কাছে, তিনি পত্রপাঠ ব্যবস্থা করেন প্রায় ১৮০০/- তাকে পাঠানোর। এই ছেলেটির প্রতিভা তাঁর গোচরে আসে প্রায় ১৫বছর আগে, যখন তাঁরই উদ্যোগে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নিয়ে করা এক রচনা প্রতিযোগিতায় উক্ত প্রথম হয়।
বস্তুতঃ দেশীয় ও বিদেশী উভয় ভাষা সম্পর্কেই ছেলেটির অগাধ পাণ্ডিত্য তাঁকে আকর্ষণ ক’রেছিলো, উপরন্তু বিদেশ থেকে উত্তীর্ণ বাঙালি ব্যারিষ্টার চর্মচক্ষে দেখা ছিলো তাঁর সারাজীবনের স্বপ্ন। ফলস্বরূপ শ্রী রাজনারায়ণ দত্তের পাশাপাশি প্রায় সমগ্র জাতির দুর্দশার কারণ হওয়া সত্ত্বেও এই উচ্ছৃঙ্খল যুবককে সাহায্য ক’রেছিলেন তিনি। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ যিনি লিখতে পারেন তাঁর সমস্ত অপরাধ ক্ষমার যোগ্য, এমন একটি যুক্তিও তাঁর ছিলো অবশ্য।
কিন্তু সে যুক্তিতে এর লক্ষগুণ অপরাধ ক’রে তিনি নিজেকেও ক্ষমা ক’রতে পারতেন, কিন্তু ষষ্ঠবর্ষীয়া একটি কিশোরীকে বিবাহের অপরাধে যিনি আপন শৈশবের শিক্ষাগুরুর বাড়িতে কখনও জলগ্রহণ করেননি, দারোয়ান দিয়ে ভিক্ষুককে বিতাড়িত করার অপরাধে বন্ধুকে চিরকালের মতো ত্যাজ্য ক’রতে দ্বিধা করেননি, তাঁর চরিত্রের কোনোরূপ স্খলিত হওয়ার আশাই নেই, তিনি লোকচক্ষুতে নিজেকে কীভাবে দোষী প্রমাণ করবেন, তা’ই তো মূল প্রশ্ন।
ব্রিটিশ নিয়মে সপ্তাহের প্রতিটি রবিবারে পঠনপাঠন বন্ধ থাকার যে প্রথা, সংস্কৃত কলেজে তার সূচনাও তাঁরই হাত ধ’রে। তার আগে কেবল মাসের প্রতিপদ ও কৃষ্ণা দ্বাদশীতে বন্ধ থাকতো শিক্ষায়তনগুলি। এর পাশাপাশি এই কলেজে কায়স্থ জাতির প্রবেশাধিকারও শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অন্যতম বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ। সমাজে এতো সংখ্যক পরিবর্তন আনতে গিয়ে তিনি যে কেবল অবস্থাপন্নদের বিরোধিতার মুখে প’ড়েছিলেন তা কিন্তু নয়।
বিধবাবিবাহের বিরোধিতায় ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে সরাসরি আক্রমণ করেন শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অবশ্য পরবর্তীকালে ঐকমত্য না হ’লেও তাঁদের সম্পর্ক বিনষ্ট হয়নি কখনও। সংস্কৃত কলেজে তাঁর কঠোর নিয়মানুবর্তিতা এমনই পর্যায়ে উপনীত হ’য়েছিলো যে কতিপয় ছাত্র নিজেরা অন্যায় ক’রেও তাঁর বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ জানায় এবং তাঁরই হস্তক্ষেপে বহিষ্কৃত হওয়া থেকে রক্ষা পায়।
তাঁর জীবনচরিত ও কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ ক’রলে দেখা যায় যে স্ত্রী, পুত্র, পরিবারের প্রতি তাঁর মনোযোগের নিতান্ত অভাবই পরবর্তীতে তাঁকে কার্মাটাঁঢ়ে স’রিয়ে আনে। একদা ব্রিটিশের মুখের সামনে যিনি চটি তুলে ব’সতে ভয় ক’রতেননা, ভবিষ্যতে আপন পরিবারকে বিশ্বাসঘাতক ব’লতেও পিছপা হননি তিনি। যখন তিনি চ’লে গেলেন, তখন দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘ’টে গেছে। সেই ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ কোম্পানির সর্বোচ্চ বিনিয়োগ।
ছাত্রদের সুবিধার্থে সাপ্তাহিক ছুটির উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। তৎসত্ত্বেও যেদিন আপন উদ্যোগে স্থাপিত পাঠশালায় অতিরিক্ত ছুটি উপলক্ষ্যে নিতান্ত অসন্তুষ্ট হ’লো ছাত্ররা, সেদিন বিদ্যালয়ের পরিদর্শক হিসাবে তিনি পত্র লিখছেন শিক্ষাসমাজের অধ্যক্ষ জনৈক মিস্টার ময়েটকে যে কৈশোরের আলস্য বাগদেবীর আরাধনার নিকট পরাজিত, পঠন সম্পর্কে অভিভাবকগণের উৎসাহ, এর তুলনায় গুরুতর প্রাপ্তি এক সামান্য শিক্ষকের কীই বা হ’তে পারে…
পরমহংসদেব কি অকারণে ব’লেছিলেন, “নোনাজল কী গো? তুমি যে ক্ষীরসমুদ্র। “।
ধন্যবাদ