প্রথম ভালোবাসা কবিতা। গল্প, রম্যরচনা,ভ্রমণকাহিনী তে ও স্বচ্ছন্দ। শ্রমনা, যুগসাগ্নিক, জনস্বার্থবার্তা ও আরো কিছু ছোট পত্রিকায় লেখালেখি। গত জানুয়ারি'২০ তে একটি অনুগল্প প্রকাশিত হয়েছে ' তথ্যকেন্দ্র ' পত্রিকায়। ফেব্রয়ারি থেকে Techtouchtalk এর সহযাত্রী। বর্তমানে মনিপুরী কিছু ছোট গল্প ও উপকথা অনুবাদে গভীরভাবে অভিনিবিষ্ট।
দুহাজার সতেরো সালের মাঝামাঝি থেকে উনিশের মে মাস পর্যন্ত রাজস্থানে থাকার সুযোগ এসেছিল। ভয়ঙ্কর শুখা মরুভূমির রাজ্য রাজস্থান। শহরের বুকের ভেতরে বসে সেটা ততটা অনুভব করা যায় না। কিন্তু দু পা ফেললেই ছোট ছোট শিশিরবিন্দু ধরা পড়ে চোখে। এমনিতেই সাজপোশাক, আচার বিচারে বঙ্গ দেশের থেকে পার্থক্য এখানে অনেকটাই। তার উপর অসংখ্য উপজাতিদের মধ্যেও প্রকৃতিগত ফারাক প্রচুর। কিছু না। আমি শুধু জানালাটা একটু খুলে দিয়েছিলাম। হাওয়াটা ওপাশ থেকেই এসেছে। অনেকখানি।
প্রান্তজন
রুকমা আর সরসতিয়ার ঝগড়া লাগে রোজই । ঝগড়া থেকে চুলোচুলি । এই করে তিন তিনটে মটকা ভেঙেছে দুটোতে । আজ সরসতীয়া কে আটকে রেখেছে ওর মা । বেশ হয়েছে ।আর কত পারবে! এক একটা মটকা তিরিশ টাকা দাম। বাধ্য হয়ে এরপর দুটো স্টিলের মটকা চেয়ে চিন্তে এনে দিয়েছে । অল্প অল্প করে হলেও জল আনার কাজ টা তো হয় ওদের দিয়ে। সুভাষনগরের সব্জিমন্ডী তে যাবো ঠিক ছিল সকাল থেকেই । সাতটার আগে বেরোন যায়না, রোদ্দুরের এতো তেজ । ওদিকে গেলেই আমি স্বরাট বস্তি ছাড়িয়ে রংবাড়ি, তারপর আরো কিছুটা হেঁটে আসি । এই রাস্তাগুলো এতো চওড়া আর জনবিরল যে আজকাল আমার হাঁটবার নেশা ধরে গেছে। না বেরোতে পারলে মন খুঁতখুঁত করে । এইরকমই একদিন মন্ডীতে কেজি দুয়েক চিকেন বানানোর (এরা মুরগী কাটাকে বানানো বলে) অর্ডার দিয়ে ঘুরে আসছি বলে চলে গিয়েছিলাম অনেকটা দূর । ফেরার পথে সার্কেল টা আর খুঁজে পাই না । তখনই দেখা ঐ দুই মুর্তিমানের সাথে । ওরা আমায় এগিয়ে দিল, যতক্ষণ না আলো দেখা যায় মন্ডীর ।
প্রায়ই যাই ওদিকে আর দেখাও হয় ওদের সাথে অবধারিত । চম্বলের কিনারে পা ঝুলিয়ে বিস্কুট আর কুড়কুড়ে ভাগ করে খাই তিনজনে । রুকমা একদিন ভাপলা এনেছিল শুধু আমাকে খাওয়াবে বলে। বলে, আন্টি ভাপলা খায়নি, তাজ্জব কি বাত! খাওয়াতো দুরের কথা, তোর দৌলতে জিনিসটা এই প্রথম চোখে দেখলাম রে মেয়ে। কিন্তু কি ঝাল! ভাগ্যিস পানিবটল সাথে থাকে। নদীর জল কি করে খাবো । কেন, ওরা তো খায়; বেঁচেও তো আছে। রোজ এই দুই দুই চার মাইল হাঁটে মেয়েদুটো দিনে অন্তত পনের ষোল বার । দুপুরে চামড়া পোড়ানো লু, পাখীরাও ডাকতে ভুলে যায় । রাস্তায় পিচ গলে যায় জায়গায় জায়গায় । ওদের খালি পা । আমি কিন্তু এখন ওদের পুরো পরিবারটাকে চিনি । রুকমার বাবা মা আর চারটে ভাই বোন। তাছাড়া আছে নানী আর ফুফু । সরসতীয়ার অবশ্য বাবা নেই । একদিন গিয়েছিলাম ওদের ঝোপরি তে । একটা পাথরের ওপর বসেছিলাম কিছুক্ষণ। সরসতীয়া ঘর থেকে শিকঞ্জি এনে দিল মাটির খোরায় । ভয়ে ভয়ে খেলাম । সেই নদীর জল ই তো।
এ যেন শহরের ভেতরে আরেকটা শহর। আমরা যেখানে থাকি, অঢেল জল, বিদ্যুত, চব্বিশ ঘন্টা সব সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকি । মাত্র দু তিন কিলোমিটার দূরে, এদের জীবনশৈলী কি অকল্পনীয় । রুকমার নানী বলল, “বোরিং এর জল কে দেবে আমাদের! নদী ছাড়া উপায় কি? তাও তো গতবছর বৃষ্টি হয়েছিল, তাই এখনো জল আছে। নাহলে কখনও কখনও বালি খুড়তে হয় ।” রুকমার পরিবারে লোক গুনতিতে বেশি । তাই ওকে একটু বেশিবার যেতে হয়। সরসতীয়া সবসময় যেতে চায় না বলেই মারপিটটা চলতে থাকে।
আজকে রুকমার মুখ ভারী। বন্ধু আসেনি। গল্প করলাম ওর সাথে। ব্রিটানিয়া র স্লাইস কেক দুই বন্ধুর জন্যে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকেও এক টুকরো নিতে হল। বললাম, “পড়িস না কেন, স্কুলে যাবি?” ওর সপাট উত্তর, “পড়ে কি হবে? সেই তো বিয়ে হবে আর জলই আনতে হবে নদী থেকে।” বলে কি হাসি কি হাসি। আমি জানতে চাই, “রান্না করবি তো বরের জন্যে?” ” হুউউ, লাল চুরনি, পায়ে পয়জোড়, হাতে চুড়ি, এই এত্তগুলো, টিনটিন বাজবে; রসুই তো করবোই।” হস্টেলে ফিরে দেখি টিভি রুমে তুমুল বচসা। দোতলার প্রাংশু আর সরবজিৎ ওয়ার্ল্ড কাপ এর জ্বরে কাঁপছে। ম্যানেজার তিওয়ারিজি ঘেমে নেয়ে একসা ওদের থামাতে। বাইরে বেশ জোরে বিদ্যুতের ঝিলিক। বৃষ্টি এল। হঠাৎই। একদম ঝমঝমিয়ে। স্বরাট বস্তির টার্নিং টা তে সরকার থেকে বোরিং ওয়াটারের ট্যাপ বসানো হয়েছে। কাল কি সেখানে জল পাওয়া যাবে! রুকমা আর সরসতীয়ার ঝগড়াটাও তাহলে মিটে যাবে নিশ্চয়ই।