সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সায়ন (পর্ব – ১৯)
অমৃতায়ণ
আর্য প্রতিদিন বিভিন্ন ভাবে নিজের যন্ত্রণাগুলোর সঙ্গে যুঝে গেছে। আর্য ম্যাসেজের ছবিটা বার বার দেখছে। ” ছিঃ… একটা মানুষ নিজে পয়সা শরীরের সুখের জন্য এই পথে নেমে যেতে পারে !” দিল্লির রাস্তায় এখন আলোর শেষ প্রলেপ ।
হঠাৎ আস্তে আস্তে আর্যর কাছে চারপাশটা খুব অচেনা লাগছে । গরম লাগছে খুব – খুব গরম ! একি এটা কোথায় , এত পাথরের মতো অন্ধকার !
প্রায় সাড়ে ছ’ বছর আগের ঘটনা। ইরাকের প্রাচীন, সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের উপর নির্দ্বিধায় অত্যাচার শুরু করে ISIL; শয়ে শয়ে ইয়াজিদি পুরুষকে খুন করা হয়। উইকিপিডিয়া খুললে সেই ঘটনা আজ জেনোসাইড রূপেই পরিচিত, সকলেই হয়তো জানেন। অপহরণ করা হয় ইয়াজিদি মহিলাদের।
এই এত বছর তাঁরা ISIL এর “sex slave” হয়ে ছিলেন। সম্প্রতি ISIL ক্ষমতা হারানোয়, এখন ইরাকের ইয়াজিদি সম্প্রদায়ে সামান্য খুশির হাওয়া — বহু বছর পর অপহৃত মহিলারা ফিরে এসেছেন/ আসছেন নিজেদের বাড়িতে।
কিন্তু না। আসল গল্প অন্যখানে। sex slave হয়ে থাকাকালীন এই মহিলাদের অনেকেই জন্ম দিয়েছেন সন্তানের। এখন ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের ‘বরিষ্ঠ’রা বলছেন, মহিলাদের তাঁরা ফিরিয়ে নিচ্ছেন সম্প্রদায়ে, কিন্তু ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর স্থান নেই কোনও তাদের সমাজে। কেন? কারণ তাদের জন্ম হয়েছে ISIL এর ‘মুসলিম’ রক্ত থেকে। তারা ইয়াজিদি মায়ের হলেও, পিতৃপরিচয়ে ভিনধর্মের।
ইয়াজিদিরা তাদের ঘরফেরত মহিলাদের সামনে দুটি পথ খুলে দিয়েছে — হয় সম্প্রদায়, নয় সন্তান, কোনও একটি বেছে নাও।
মায়েদের কাছে এখন প্রশ্ন, ঘরে ফিরবো না বেঘর হবো? ঘরে ফিরলে, তাঁদের অন্তঃজেরা হবে ঘরছাড়া। ঘরে না ফিরলে কোন অনিশ্চয়তায় তাঁরা এই শিশুগুলির ঘর হয়ে ওঠার সাহস করবেন? আশ্রয় কোথায়? সঞ্চয়, উপার্জন, ছাদ — কোথায়?
শিশুগুলির মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড় যারা, তারাও টেনেটুনে পাঁচ বছরের। বাকিরা আরও ছোট। যে শৈশবে শিশুরা রূপকথা শোনে, পুতুল খেলে, ঘুড়ি উড়ছে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, আর কিছু বুঝুক না বুঝুক ‘মা’ নামক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তটি বুঝে হাসতে পারে, সেই শৈশবে এই শিশুদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, তারা ইয়াজিদি, না মুসলিম? তারা মায়ের কাছে থাকতে পারবে তো? নাকি তাদের ছেড়ে চলে যাবে তাদের মায়েরা?
এই ধর্ম, না ওই ধর্ম? এই দেশ, না ওই দেশ? সর্বত্র এক, এক, শুধু এই এক প্রশ্ন।
আমাদের আরামের ড্রয়িংরুমের “অ্যা ছি ছি” শব্দ sex slave, প্রসঙ্গক্রমে যাদের পরিচয় মানুষ, নারী, মা, তাদের বেছে নিতে হবে — সমাজ, না সন্তান? আর পিতৃপরিচয়কে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া সমাজে ছোটরা আজও মানুষ নয়, ধর্মের বন্দি।