কাউকে কাউকে নামে চেনা যায়। কাউকে কাউকে টাকায়। চেহারায় কেউ কেউ চেনা হয়ে যায়। নিজের স্বপ্নের ছোয়াঁচ যে লাগিয়ে দেয় অন্য অনেক মনে, তাকে তো বাস্তবেও চিনতেই হয়। সুলগ্নাদিকে আমি চিনতাম ওর মুখটার জন্য। ওরকম একটা মুখ কলকাতার তিরিশ কিলোমিটার দূরের এই মহল্লায় আর একটাও ছিল না। অন্তত আমি দেখিনি। আমার মা একটা নাম দিয়েছিল সুলগ্নাদির। চিনিটোরা। এত মিষ্টি যে আর অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা করা চলে না। শুধু মিষ্টি বললে অবশ্য কিচ্ছু বলা হয় না। সুলগ্নাদির মুখটাকে বলতে হয়, নিখুঁত। প্রকৃতি হোক, ঈশ্বর হোক, যদি কোথাও কোনো শিল্পী থেকে থাকেন তিনি অনেকটা সময় হাতে নিয়ে সুলগ্নাদির মুখটা তৈরি করেছিলেন। শুধু মুখটাই নয়, সুলগ্নাদির চেহারার মধ্যেও একটা ব্যাপার ছিল। ও যখন হেঁটে যেতো রাস্তা দিয়ে, তখন হাত তুলে বাস দাঁড় করাতো কিংবা ট্রেন থেকে নামতো স্টেশনে, সমস্ত কিছুই কেমন যেন অলৌকিক লাগত। কিন্তু সেসব নিয়ে ও নিজে কিছু ভাবত বলে মনে হয় না।
পাড়ার একটা পিকনিকে একবার সুলগ্নাদির মুখ চোখ লাল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে। পাড়ারই এক দাদা সেই দৃশ্য আমায় দেখিয়ে বলেছিল সুলগ্নাদিকে গিয়ে বলতে যে ওর অতটা তাত লাগানো ঠিক হচ্ছে না। আমি গিয়ে বলেছিলাম, সরে যাও , তোমার মুখটা লাল হয়ে গেছে একদম। সুলগ্নাদি আমার কানটা আলতো করে মূলে দিয়ে বলেছিল, সেটাই তো মজা। এই যে নিজের হাতে আনাজ কাটছি, জলে ধুচ্ছি, মশলা মাখাচ্ছি, রান্না করছি, আর এই যে ধোঁয়াটা মুখের মধ্যে এসে লাগছে, ওটাই তো আনন্দ। আর আনন্দ ডবল হবে যখন খেয়ে সবার মুখে হাসি খেলে যাবে।
সেই প্রথম একটা মেয়েকে দেখেছিলাম যে অপূর্ব সুন্দরী হয়েও কমপ্লিমেন্টের ভরসায় বাঁচে না। মনে হয়েছিল সুলগ্নাদির রূপ যেন ওর কপালের টিপের মত যা ও অনায়াসে খুলে আয়নার গায়ে লাগিয়ে রাখতে পারে কারণ রূপের চেয়েও বড় জিনিস ওর আছে। তার নাম উদাসীনতা। ‘সুলগ্নাদি’ বললেও বয়সের তফাৎ এমন কিছু ছিল না আমাদের। দু-তিনবছর ম্যাক্সিমাম। তাই বেশ কয়েকবার শেষরাতে ঘুমের মধ্যে যখন জেগে উঠেছি অস্বস্তিতে আর টের পেয়েছি সুলগ্নাদির কথাই ভাবছি তখন রূপের পাশাপাশি ওর ওই ঔদাসীন্য ঘুরপাক খেয়েছে মাথায়।
সে একটা সময় ছিল যখন পলকে নিজের হৃদয় দিয়ে দেওয়া যেত একেবারে সর্বস্ব সমেত। বোকার মত কিন্তু বীরেরও মতো। সেভাবেই পাড়ার কত কত ছেলে সুলগ্নাদিকে হৃদয় দিয়েছিল। সুলগ্নাদি তাদের কারো হৃদয় পথে ফেলে দেয়নি আবার কুড়িয়েও নেয়নি। অদ্ভুত একটা হাসি আর একটা দুটো শব্দ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সুলগ্নাদি কারো হতে পারে না। ওর সঙ্গে শুধু চলতে হয়। সুলগ্নাদি কি পাগলি? ওর কি বড় গাছে নৌকো বাঁধার ইচ্ছে? এরকম নানান তর্কে পাড়ার রক কেঁপে উঠত এক একটা সন্ধ্যায়। কিন্তু সেইসব ঝড়, হাওয়ায় ভেসে ভেসে ওর কাছে ক্কচিৎ-কদাচিৎ পৌঁছালেও ওকে স্পর্শ করতো না বোধহয়।
মেয়েদের রূপ থাকলেই যে দেমাক হবে সেটাকেই সুলগ্নাদি কোথাও একটা অস্বীকার করত।পাড়ার ক্রিকেট টুর্নামেন্টে মাইক হাতে ধারাবিবরণী দেওয়াতে ওর যতটা উৎসাহ ছিল,কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঞ্চালিকার ভূমিকা পালন করায় ঠিক ততটা নয়।তাই বলে কি গেছো ছিল?না তাও না।আসলে ও একটা অদ্ভুত ককটেল ছিল যার প্রথম পেগ থেকে শেষ পেগ পর্যন্ত একটা ধুনকি লেগে থাকত।