সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৭৬)

রেকারিং ডেসিমাল

দুপুরে ভাত খাবার আগে পরে, বা বিকেলের কনে দেখা আলোয় মায়াবী হয়ে আসা মিষ্টি হাওয়া মাখা ছাদে, দুই ননদিনী এ পাড়ার সব গহীন গোপন জরুরি ইতিহাস সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করে তোলে বউমণিকে।
আজকের দিনে যাকে বলে আপডেট করা আর কি।
ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু গভীর রহস্যময় সব তথ্য।
কে কোন বাড়ির মেয়ে কোন বাড়ির ছেলেকে দেখে হাসত। কাদের বাড়ির নারকেল কোন পাশের বাড়ির পার্ক করে রাখা গাড়ির ছাদে পড়ে তাকে তুবড়ে দিয়েছিল, কাজেই দু বাড়ির লোকের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ এদের জন্মেরও আগে থেকে, এইসব রোমহষর্ক তথ্য।
এই রকম একটা দুপুরেই তিন জনে হ্যা হ্যা করছিল সামনের দোতলার বারান্দায়।
একটা বয়সে মানুষের প্রায় বিনা কারণে ও হাসি পায়।
মনে হয় হাসিটা, সুকুমার রায়ের সোডার বোতলের মতই ভিতরে ভরা আছে। একটু ঝাঁকুনি লাগলেই, হো হো হা হা হি হি।
এমন সময় পিওন সিঁড়ির নিচে ডাক দিলো।
বলল, রেজিস্ট্রি চিঠি আছে। সই করে নিন।
তিন জনে দুদ্দাড় করে নেমে গেল।
গম্ভীর মুখে তিন জনের মধ্যে সিনিয়র বৌমণি নিয়ে নিল চিঠি।
পিওন চলে যেতে তিন জনে উলটে পালটে দেখে কোন সিঙ্গারের নামে বন্ধ খাম।
এ ওর মুখ চায়।
কে রে বাড়িতে এত বিখ্যাত গাইয়ে যে সরকার গাইয়ে বলে চিঠি দিচ্ছে ?
নামটাও বৌয়ের চেনা নয়।
ওপরে এসে দাদুর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মেজ ননদের মাথায় বুদ্ধির বালব জ্বলে উঠলো।

হ্যাঁ হ্যাঁ । চিনতে পেরেছি, এত কাকির নাম গো।

দাদু দিদার ঘরে জমা দিয়ে দেয়া হল চিঠির খাম।

তারপর তিন জনে আবার সামনের বারান্দায়।
হ্যা হ্যা  হ্যা,  ও বাবা সরকারি গাইয়ে যে। হে হে,  সেকি কথা।

ভাত খেতে ডাক পড়া অবধি হে হে চলেছিল।
তারপর যে যার ঘরে ঘুম।
সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নামে অন্যান্য দিনের মতই।
রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে মায়েরা খাবার ফ্রিজে তুলছেন। টেবিল মোছা হচ্ছে।
দাদু দিদা আগেই খেয়ে নেন।
তাঁদের ঘরে মশারি টাঙানোর প্রস্তুতি।

নিচের তলা থেকে কাকু ওপরে আসে এ সময়। বাবা মায়ের সাথে কথা বলে,  শোয়ার ব্যবস্থা একটু তদারকি করার মত এটা ওটা নাড়াচাড়া করে, যাতে বাবা মায়ের ভালো লাগে।
আজও তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
আর তার পরেই বিস্ফোরণ।

হ্যাঁ, এই একটা বৌ।
কোথায় বাড়ির বাচ্ছারা তার কাছ থেকে সহবত শিখবে, তা নয়।
শিক্ষা দীক্ষা কিছু…
এইগুলো কি…
কোন সভ্যতা…
আমি নিজে শুনে…

দাদু দিদার ঘরের বারান্দার দিকের জানালা রাতে বন্ধ থাকে। খালি দরজা একটা খোলা।
তাই দিয়েই ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ ভেসে আসছে ক্রমাগত।

বৌয়ের শ্বাশুড়ি মা, একটু কান পেতেই সামনের ঘরে টেনে নিয়ে গেলেন আসামিদের।
একজন চোখ বন্ধ। মাথা টাওয়েল ঢাকা। টাওয়েল কানের পিছনে গোঁজা তুতেনখামেন স্টাইলে। মুখে সাদা ফেস ওয়াশ মাখা।
অন্য জন টেনে দুই মোটা বিনুনি। ঢোলা হাফ প্যান্ট। ফ্যাতলা গোল গলা গেঞ্জি। মুখে ব্রাশ।
বৌ নাইটি পরে মাথায় চিরুনি।
রাতের খাওয়া সেরে শুতে যাবে বলে রেডি হচ্ছে।

কি করেছিস তিন জনে ? হ্যাঁ?
সব্বোনাশ!!
কাকু বলছে কাল নিচের দোকানে দুপুরে কি কিনতে গেছিলো। শুনেছে তোরা ওপরের বারান্দায় এক ঘন্টা হ্যা হ্যা করেছিস অসভ্যের মত। তা আবার গুরুজনদের নিয়ে ছ্যাবলামি। ছি ছি। কি কত বকাবকি করছে দাদু দিদার কাছে।
এই বৌটাকে নিয়ে কি করি আমি…

বলতে না বলতেই ডাক, এই বড় বৌদি। একটু এ দিকে এসো।

এই রে, হয়ে গেল।

তাড়াতাড়ি পা চালান শ্বশুর শ্বাশুড়ির ঘরের দিকে বড় বৌ।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তিন মূর্তি দাঁড়িয়ে ছিলো আলো নেভানো সামনের ঘরের সোফার সামনে।
এবারে আলতো করে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকায়।
ব্রাশওয়ালা মুখের থেকে ব্রাশ বের করে বলে, এমা নিচের দোকানে ছিল কাকু!!
যাঃ
কি করে জানবো?

বাকি দু জনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।
তারপর শুরু হয় হাসি।
সোফায় গড়িয়ে হ্যা হ্যা হ্যা।

এ বাবা!  শুনে নিয়েছে রে। হ্যা হ্যা।
কিন্তু খারাপ কি বলেছি।
খালি বৌমণিকে বলেছি সিঙ্গার বলে চিঠিটা কার নামে এসেছে।
আর বৌমণি বলেছে, প্রফেশনাল গাইয়ে ? অত ত গাইতে শুনিনি।
এতে এত কি আর খারাপ?

বৌমণি হাসির চোটে চোখ থেকে বেরিয়ে আসা জল মুছে বলে, আরে না না। ওদের টেলিফোন আসবে। সিঙ্গারদের আগে আগে কানেকশান আসে। তাই।
আমি শুনেছি একটু আগে বারান্দার বেসিনে মুখ ধুতে ধুতে।

ছোট আসামি করুণ মুখে বলে, আমরা ত খালি অবাক হচ্ছিলাম।

তাই শুনে বড় দু জন আবার হাসতে থাকে।
মেজ ননদ হাত পা নাড়িয়ে বলে, উফ এত হাসাস না, ফেস ওয়াশ ত চোখে চলে যাচ্ছে। ধ্যুত!

বড় জেঠি দরজা খুলে ঢুকে আসেন।
এসে দরজা বন্ধ করে দেন পিছনে।

সামনের দৃশ্যটা দেখে নিজেই হেসে ফেলেন।
তারপর গম্ভীর হবার চেষ্টা করে বলেন,  লজ্জা নেই। একটার ও কোন লজ্জা নেই। দেখো। আবার হাসছিস!!
এই অপদার্থ বৌকে নিয়ে আমার যত জ্বালা।
খেলাম ত গালি?
শিক্ষা দিই না। বাবা মাও কিছু শেখাননি। এখনই শাসন না করলে ভবিষ্যৎ ঝরঝরে। আর তোমরা, এই বাড়ির দুই মেয়ে, এর সঙ্গে মিশে গোল্লায় যাচ্ছো, মনে রেখো, হ্যাঁ ।

হ্যাঁ।
ঘাড় নাড়ে বৌ।

ছোট ননদ খপ করে ধরে জেঠিকে।

শোন না। কি করে জানবো, অত দুপুরে অফিসে না গিয়ে নিচের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে কাকু ? আমরা ত চুপিচুপি হাসছিলাম।
সত্যি।

এই বারে জেঠিও মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে থাকেন।

আধো অন্ধকার ঘরে বিনা কারণেই সেই রাতে হাসির নির্মল ফোয়ারা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।