সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ১০)

রেকারিং ডেসিমাল

১০

বাবার অফিস যেতে ইউনিফর্ম লাগে। সাদা জামা, শ্যাওলা সবুজ প্যান্ট।
দুই সেট আছে। একটা আজ ফিরে কাচতে দেয়া হয়, পরের দিন অন্যটা পরে যাওয়া।
কিন্তু সমস্যা আছে।
এক, শার্টের কলারে কালো দাগ থেকে যাওয়া।
দুই, ইস্তিরি।
শার্ট-প্যান্ট কেচে শুকিয়ে ছাদ থেকে যদি বা চলে এল, ইস্তিরি না হলে পরের দিন আটটার মধ্যে বাবা রেডি হবেন কি করে?
মা জন্মে কখনো নিজের জামাদের ও ইস্তিরি করেননি ।
শিশু কালে তাঁর মা করে দিতেন, বা বেশির ভাগ সময় বি দাস লন্ড্রি রেলব্রিজ পেরিয়েই।
তিনি জানেন কাজের মাসি শাড়ি জামা নিয়ে যায়, নিয়ে আসে খাতায় লেখা থাকে।
তাঁর বাবার অফিসের শার্ট-প্যান্ট কোট পাঞ্জাবি ধুয়ে ইস্তিরি হয়ে আসে মেন রোডের রেশন দোকানের পাশের ড্রাইং ক্লিনিং দোকান ওয়াশোর থেকে। সে সব ব্রাউন পেপারের খামে লাল দিয়ে ওয়াশোর লোগো আঁকা বাবা নিজের আলমারিতে তুলে রাখেন । কখনো কখনো বেশি ভাল শাড়ি বা তাড়া থাকলে মা জামা কাপড় লেকের উল্টো দিকের কোনায় পেট্রোল পাম্পের পাশের দোকান এপারেল-এও পাঠান।
আগে এপারেলের পাশে একটা রেকর্ডের দোকান ছিলো। বাবাদের ছোটবেলায় নাকি নির্মলা মিশ্র ইত্যাদি শিল্পীদের দেখাও যেত সেখানে।
সে যাই হোক।
গরম ইস্তিরি নিয়ে জামা কাপড়ের সঙ্গে ধস্তাধস্তি তাঁর পোশাবে না এটা দু এক বার চেষ্টা করেই মা বুঝেছিলেন।
অগত্যা ভরসা দুলন।
সকালে সাড়ে ছটায় গ্যাসে অফিসের ভাত আর চায়ের কেটলি বসেছে দেখলেই নতুন বউ চুপ করে কেটে পড়ত সিঁড়ি বেয়ে।
রাস্তায় নেমে ডান দিকের দেয়ালে দুলন উনুন ধরিয়েছে দেখলেই শান্তি ।
ছুট ছুট।
-দুলন, দুলন, শিগগির।
দুলন খুব একটা স্নেহের হাসি হাসত এই বউটাকে দেখে।
ভারি দরদের আশ্বাস ভরা হাসি।
–হাঁ হাঁ কি হয়েল ? আহিস্তা আহিস্তা, বোলো বহুদিদি।
– ও দুলন, ইস্তিরি বসাও গো। দাদার জামা!! এক্ষুনি খেয়ে শার্ট চাইবে যে। আটটায় বাস তো। দাও দাও শিগগিরই।
উনুন ধরে নাই গো বহুদিদি।
এবার!! কি হবে তবে? আমি গিয়ে টাকা পয়সা মোজা রুমাল দেব যে, আর আসতে পারব না। বাপ রে, বাড়িতে ত হুলুস্থুল হয়ে যাবে। দাওনা গো করে।
দুলনের সস্নেহ মুখখানা মনে পড়লে বুড়ো বয়েসেও নরম হয়ে আসে মায়ের ভেতরটা।
কে জানে দেশে তার মতই কোন মেয়েকে রেখে এসেছিল নাকি গরীব সাধাসিধে মানুষটা।
খুব মিষ্টি করে বলত, আপ যাও। বহুদিদি। কুছু ফিকর নাই। যাও তুমি। আমি আগ উঠলেই বানিয়ে উপরে দিয়ে আসব, তূমায় নামতে হবে না।
— যাই তবে দুলন?
— হাঁ হাঁ।
চোখ বড় বড় করত দুলন ভয়ের ভাগিদার হয়ে,
জলদি যাও, দাদা ডাঁটে অগর ? যাও যাও।
এত্ত বড় দাদা, ডাঁটে যদি এই এক হাত বউকে?
দুলন ঠিক এসে সিঁড়ির উপরে বেল বাজাতো।
এক ছুটে এসে মা নিয়ে চলে যেত ভিতরে।
দুলন পয়সা পরে দিচ্ছি —
পয়সার জন্য কোন চিন্তা করত না মানুষটা। জানত বাড়ির ছেলেরা কাজে বেরিয়ে গেলে আরও ইস্তিরির কাপড় নিয়ে পয়সা দিয়ে যাবে মেয়েরা কেউ।
বউদিদিকে বকুনি খাওয়া থেকে বাঁচাতেই আনন্দ করে সিঁড়ি ভাঙতে রাজি ছিল মাঝবয়েসী মানুষটা।
মা একেও ভারি ভালো বন্ধুদের মধ্যেই ধরতেন। আজও ধরেন মনে মনে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।