সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ১০৬)

রেকারিং ডেসিমাল

বর্তমান থেকে ফিরে যাই ফেলে আসা হেমন্তের দিনে, শরতের রোদে।
বেনারস।
প্রথম দিনে শাহি ভোজন সেরে রুপোলি তবক মোড়া পান খেয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম। রাজবাড়ি। তার প্রধান দরজার দু পাশের কামান, তার বিরাট তোরণদ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসা রাজকীয় সাজে সাজানো হাতির সারি, গঙ্গার বুকে পর পর ভাসানো বন্ধ পিপে এবং তার ওপরে নিমেষে তৈরী হয়ে যাওয়া সেতু, কত কিছু দেখে হাঁ করে আছি সবাই। সেই সেতুর ওপর দিয়ে রাজার হাতিরা ওপারে পৌঁছে ও গেলো। কি আশ্চর্য!
রাজবাড়ির ওপরে চড়ে একেবারে মাথায় রানিমাদের পুজো করার শিব মন্দিরে নমো করে আবার কেল্লার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম ঘুরে।
ফের চলল গাড়ি।
দু পাশে গম আর গন্না মানে আখের ক্ষেত পেরিয়ে প্রয়াগের দিকে।
নানান কিছু দেখে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল।
সোজা চলে এলাম গঙ্গা মায়ের পাড়ে। আরতি শুরু হয়েছে তখন।
হাজার প্রদীপ ঊর্ধ্বে শিখা জ্বালিয়ে বলছে, হর হর গঙ্গে!

সমস্ত মন্দিরে বেজে চলছে আরতির কাঁসর ঘন্টা। জলে ভাসছে আলোর মালা। এদিকে মণিকর্ণিকা দশাশ্বমেধ ঘাটের চিতা জ্বলছে অনির্বাণ।
কী যেন কালের গণ্ডীর বাইরের মায়াবি ঘোরের মধ্যে জাল দিয়ে ঘিরে ফেলার মত ঢেকে ফেলছিল কাশী।

নৌকায় উঠলাম সবাই মিলে।
গঙ্গায় স্রোতে ভেসে যেতে যেতে তাকিয়ে দেখলাম, মাঝি একজন দাঁড় টানছে, আর একজন লম্বা মানুষ হালের কাছে একটা বাঁশ ধরে দাঁড়িয়ে। অন্ধকার নদীর ওপরে চেহারাগুলো ভালো করে বোঝা যায় না
ফের আরতির দিকে চোখ ফেরাই।
এক হাতে ছেলের ছোট্ট হাতখানা ধরা শক্ত করে। আরেক হাত মেয়ের কাঁধে। সেও জড়িয়ে আছে আমার কোমর। পাশে তাদের বাবা, ঠাকুর্দা, ঠাকুমা।
হঠাৎ কি রকম অদ্ভুত অনুভূতি হল। শিরশির করে ঠাণ্ডা কিছু বইছিল ভিতরে। মনে হল, হালের মাঝির পাশে, আরও কেউ, ছায়ার মত, দীর্ঘদেহী, এসে দাঁড়িয়েছে এক হাত দূরেই।
কে যেন বলল।
এরই নাম মৃত্যু। চিনে রাখো।
এখন থেকে তুমি একে দেখতে পাবে। হয়ত আর কেউই পাবে না।

বুকের ভেতর শিউরে শিউরে উঠে, অন্তরাত্মা, দুই শিশু মানুষকে শক্ত করে ধরে বলল, ওঁ নমঃ শিবায়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।