গল্পে ঋত্বিক সেনগুপ্ত

কলকাতায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঋত্বিক সেনগুপ্ত, ছোট ভাই মৈনাকের সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন বাবার চাকরির সুবাদে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেক্ট ঋত্বিক এবং স্ত্রী পর্ণা বাঙালিয়ানাকে ভালোবেসে ছুঁয়ে থাকেন দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কেও। শৈশব আর এখনকার কাজের খাতিরে খুঁজে পাওয়া দেশের বিভিন্ন স্বাদ গন্ধ মানুষের রীতিনীতির গল্প কল্পনার তুলিতে সাজিয়ে ঠাকুমার ঝুলির গল্পের মত পরিবেশন করেন ঋত্বিক। কখনও বা কবিতায় ও ফুটে ওঠে নষ্টালজিক বাংলা, বর্তমান আর অতীতকে মিলিয়ে মিশিয়ে। নবনালন্দার ছাত্র ঋত্বিক তাঁর সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে তুলে দিয়ে যেতে চান পুত্রকন্যা তিথি ও দেবের হাতে। তিনি বলেন, পাঠকদের মতামত জানতে পারলে ভালো লাগবে।

সাঁঝ-আভা

মাইথনকে, ছোট শহর বললে, তার নিরিবিলি পরিবেশটাকে, উপেক্ষা করা হয়। তবে, মেডিকেল সেন্টারে ডাক্তার নিয়মিত আসেন, বাজারে সব সরঞ্জাম সহজলভ্য, নাগরিক নিরাপত্তার প্রতি স্থানিয় প্রশাসন সজাগ – শহুরে সাচ্ছন্দ্য যথেষ্ট।
আসানসোল শহর থেকে, আড়াই-ঘন্টার পথ। আরো খানিকদূর গিয়ে, দক্ষিণ-পশ্চিমে, মাইথন ড্যাম। আসানসোল-চিত্তরঞ্জন হাইওয়ে অথবা এখন এস.এইচ-১৯ নামে পরিচিত, এই রাস্তা, এখানে খানিকটা দক্ষিণ-কাত হয়ে বরাকর নদী পার হয়েছে। পশ্চীমে ধানবাদ-মুখি এই রাস্তার উত্তর দিকে, কালানেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের পশ্চিম দিকে যে মেলা-প্রাঙ্গন, স্থানিয় মানুষের কাছে সুভাষ-মেলার মাঠ নামে পরিচিত। সেই মাঠের একপ্রান্তে, নিম আর আমগাছে ঘেরা ক্যাম্পাস – ‘সাঁঝ-আভা সিনিয়র হোম’।
ওল্ড এজ হোম নয় – কারণ এখানে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা সকলেই, অন্ততঃ আবেদনপত্রে, স্বেচ্ছায় এসেছেন, এমনই ঘোষণা করেছেন। সাধারণত, জীবন সঙ্গী বা সঙ্গীনি হারিয়ে, এখানে আশ্রয় নিয়েছেন, এখানকার সকল আবাসিকদের ক্ষেত্রে এমন নয়। পরিণত বয়সে সম্পর্কে বিচ্ছেদের কারণে, এই ‘সাঁঝ-আভা’তে আবাসিক হয়েছেন, এমন ও কয়েকজন আছেন। তাই, সমকালীন ভাষায়, এই হোমটা, অন্য ‘সেগমেন্টে’র। বেশীর ভাগ আবাসিক, কর্ম-জীবন শেষ করে, এসেছেন।
তিনতলা উঁচু, সাদা রঙের, সবুজ-কার্নিসের ভবনটার , খানিকটা, বড় রাস্তা থেকে দেখা যায়। প্রায় বিঘে-তিন জমিতে ব্যাপ্ত – চারিদিকে মাঝারি-উচ্চতার পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের উচ্চতা বেশী নয় বলে, একতলার ঘরের বারান্দাতে বসেও পশ্চিমে তাকালে বরাকর নদীর ঢেউয়ে, নৌকা দুলতে দেখা যায়, স্পষ্ট। সামনের গেটের দারোয়ান-গুমটি পার করে, শ’দুয়েক মিটার দূরে, নদীর বাঁধানো ঘাট। পাঁচিলের এপারে, নদীর দিকটাতে, বাঁধানো-মেঝে ও টালির চাল দিয়ে তৈরী, একটা ভিউয়িং গ্যালারি – আবাসিকদের খুব প্রিয়। ভবনের পিছনের দিকে ছাঁটা-ঘাসের উঠোন – তার উপর খান পনেরো বেতের চেয়ার, সাথে ছোট-ছোট বেতের টেবিল। সকাল ও বিকেলের চায়ের আড্ডা, এখানেই জমে ওঠে। আবাসিকদের, পরস্পর পরিচিতি ও দৈনন্দিন মিলন-প্রাঙ্গন ও বটে। আবাসিকদের, নিরুদ্বেগ, আলগা ও সহজ কথোপকথনের, বড় আদরের যায়গা, এই চা-খাবার-উঠোন। পশ্চিমের দুটো নিমগাছ, গ্রীষ্মের দুপুরেও ছায়া-স্নিগ্ধ করে রাখে এই উঠোনটাকে। প্রথামত, নতুন কোন আবাসিক এলে, বিকেলের চায়ের আড্ডায়, এই উঠোনেই, সকলে তাকে স্বাগত জানান।
আজ সকালেই, এই হোমের নোটিস বোর্ডে জানানো হয়েছে, রজত দত্তর কথা। তিনি আসছেন দূর্গাপুর থেকে, বছর তিন আগে কর্মবিরতি নিয়েছেন, ডি.পি.এল থেকে। জানা গেছে, থিয়েটার দেখা ও ভ্রমণের সখ আছে তাঁর। আর সকলের মতন, ব্রেকফাস্ট সেড়ে, রুমে যাবার সময়, লাউঞ্জের নোটিস বোর্ডে সূচনাটা পড়লেন শ্রীমতি মোহনা নাথ। অনেক বছর আগে, দূর্গাপুর ছেড়ে কলকাতা নিবাসি হয়েছিলেন তিনি। তাই ছেলেবেলার দূর্গাপুরের থেকে রজতবাবু আসছেন জেনে, অনেক স্মৃতি ভেসে উঠল যেন। অনেকদিনের পুরোন গীটারের তারে হাত বোলালে যেমন মনটা একটা সুরে বেজে ওঠে, তেমন। অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই মুচকি হেসে ফেললেন – হঠাৎ খেয়াল হল যখন, তড়িঘড়ি ঘরে চলে গেলেন।
বিকেলে চায়ের আসরে, হোম-সুপার, অশেষবাবু, আলাপ করিয়ে দিলেন, শ্রী রজত দত্তকে, সাঁঝ-আভার সকল আবাসিকের সাথে। সৌমকান্তি চেহারা, মাথার সব চুল সাদা, মিতভাষী ও বিনীত প্রকৃতির মানুষ, রজত দত্ত। জানালেন, মেয়ে থাকে নাগপুরে, ও ছেলে নিউজিল্যান্ডে। বছর চার আগে, পালামপুর বেড়াতে গিয়েছিলেন, সেখানে কার্ডিয়াক আ্যরেস্ট হয়ে, দেবলোকে গমন করেন তাঁর বিগতা স্ত্রী। ছেলে-মেয়েকে জানিয়ে, বাড়ি ভাড়া দিয়ে, চলে এসেছেন এখানে – বাকি জীবনটা একান্তে, অনেকটাই নিজের মতন থাকতে চান। উল্লেখ করলেন, কোন এক ভ্যাকেশনে, কারো কাছে শুনেছিলেন, এই ‘সাঁঝ-আভার’ কথা। জানতে চাইলেন আর কেউ দূর্গাপুর থেকে এসেছেন কিনা – হাত তুলে মোহনা নাথ বললেন, “আমিও বর্ন এন্ড ব্রট আপ ইন দূর্গাপুর”।
“বাহ্, তাহলে তো একজনকে পেয়েই গেলাম”, বলে স্মিত হাসলেন রজত দত্ত। “আপনার সাথে তাহলে অনেক স্মৃতি রোমন্থন করা যাবে, ছেলেবেলার গল্পগুলো, ভাগ করে নেওয়া, সহজ হবে হয়তো”।
“ছেলেবেলার গল্প তো এমনিতেই মন টানে”, বললেন পাশে বসে থাকা সুলেখা রায়, মোহনা নাথের, কক্ষ-সঙ্গী বা রুম-মেট। বলে আলাপ করলেন রজতবাবুর সাথে।
পরের দিন breakfast table এ, রজত দত্ত চায়ে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজে চোখ রেখেছেন, হঠাৎ সুলেখা রায় এসে বললেন, “একটু ছেলেবেলার গল্প হবে নাকি?”, বলে, হাতের কাপটা টেবিলে নামিয়ে, উল্টোদিকের চেয়ারে বসলেন। কিছুক্ষণ নিজের কথা বললেন, তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন, “আপনি বলছিলেন আপনার শুধু ভ্রমনের সখ্, ভ্রমনের স্মৃতিগুলো, লিখে বা এঁকে রাখেন না?”, “মানে স্মৃতি ধরে রাখার জন্য”।
“হ্যাঁ, ছবি তুলি, ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট”, রজতবাবু মুচকি হেসে, আবার বললেন, “ভালো লাগছে যে আমার ‘হবি’ আপনাকে এতটা ভাবিয়েছে – আপনার রুমমেটকে দেখছিনা যে”।
“মোহনার সকালটা একটু দেরীতে শুরু হয়, এই নটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট করে”, বললেন সুলেখা, “আমি আসলে মর্নিং-ওয়াক করে, ব্রেকফাস্ট করে, তারপর স্নান করি, অনেক বছরের অভ্যাস, আমার স্বামী সকাল আটটায় অফিসে বেড়োতেন, একসাথে ব্রেকফাস্ট করাটা পছন্দ করতেন, সেই থেকে-“।
“আপনারা থাকতেন কোথায়”?, জিগেস করলেন, রজত।
” ওর চাকরি জীবনটা কেটেছে টাটা স্টীলে, জামশেদপুর, তারপর, ওদের পৈতৃক-ভিটে, গড়িয়া, কলকাতা – এখন উঠি, পরে কথা হবে”, বলে উঠে পড়লেন সুলেখা।
বিকেলে, রজত দত্ত আর তার রুমমেট, সোমেন বোস, চা নিয়ে ভিউয়িং গ্যালারিতে অনেকটা সময় কাটালেন। কথা বলতে বলতে রজত দত্ত, পকেট থেকে বলপেন বার করে, একটা পেপার-ন্যাপকিনে স্কেচ করতে মগ্ন ।
সোমেনবাবু অভিভূত হয়ে বললেন, “আপনি তো বেড়ে আর্টিস্ট মশাই, এতদিন ধরে আমি এতজনকে এই ছাউনিতে এসে বসতে দেখছি, উদাস হতে দেখেছি অনেককে, কিন্তু এমন অসামান্য স্কেচ করতে কাউকে দেখিনি!”, বলে ভবনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দাঁড়ান আমি একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজ নিয়ে আসি, আপনার স্কেচ তো প্রিজার্ভ করতে হবে”‌।
কতক্ষণ কেটেছে, খেয়াল নেই রজতবাবুর, হয়তো অপেক্ষায় আছেন সূর্যটা আরো একটু ঢলবে, হঠাৎ “Old habits die hard, রাজা”, শুনে তাকিয়ে দেখলেন মোহনা নাথ হাসি মুখে চেয়ে আছেন।
এতটুকু বিস্ময় প্রকাশ না করে রজত বললেন, “তোমার ও তো সেই কথা বলার ঢঙ্ পাল্টায়নি!”
“মনি, তুমি সকালে সুলেখাদেবীকে পাঠিয়েছিলে, সিওর হবার জন্য আমি সেই রজত দত্ত কিনা – old habits die hard”!
মোহনা: বিকেলে মনে হল তুমি চিনতে পেরেছো আমাকে, তাই নিজে এলাম।
রজত: মাঝখান থেকে এতগুলো বছর কেটে গেল, কত মানুষ এলো-গেলো জীবনে, তারপরেও ফাঁক খুজে সঙ্গ পেতে এলে?
মোহনা: স্কেচ করতে পারো, সেটা সুলেখাকে বলে দিলে, আরো হয়তো ঘন্টা কয়েক আগে সঙ্গ দিতে আসতাম!
রজত: এতবছর পরে স্কেচ করা আবার শুরু করলাম, বোধহয় ইচ্ছে হল বলাটা ঠিক হবে – হয়তো চল্লিশ-বছর আগেকার দূর্গাপুরের বিকেল গুলো মনে পড়ল বলে।
মোহনা: তখন তো নাটকের রিহার্সালের ফাঁকে আমার সংলাপের কপির পিছনে আমার স্কেচ করতে – সেই স্কেচ দেখেই তো বাড়িতে বৌদি আন্দাজ করেছিল আর তারপর যতো গন্ডগোল।
রজত: গন্ডগোল কিসে – যদি আর দেখা না হত, তবেই না গন্ডগোল মানতাম!
মোহনা: রাজা, তুমি তো আমার যে দশ-বারোটা ছবি তুলেছিলে, সেগুলো আমাকে দিয়ে দিয়েছিলে! তার মানে বিচ্ছেদটা গ্রাহ্য ছিল তোমার কাছে?
রজত: নেগেটিভগুলো এখনো আমার কাছেই, মানে ফটোগ্রাফাররা যেটাকে অরিজিনাল ইম্প্রেশন বলে!
দূরে, সাঁঝ আকাশের আভায়, বরাকরের ঢেউয়ের মাথা ছুঁয়ে, বুক ভিজিয়ে আবার দিগন্তে পারি দিল কিছু গাঙচিল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।