সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে রূপক সান্যাল (পর্ব – ১)

দখল

বড়লোকের একমাত্র মেয়ে বাপ-মায়ের প্রশ্রয়ে বখে যায়, উশৃঙ্খল হয়ে যায়, এমন তো শোনা যায় প্রায়ই। কিন্তু অল্প আয়ের কোন বাবা-মা তাদের একমাত্র মেয়েকে আদর দেবে না, আব্দার রক্ষা করবে না, মেয়ে যা চায় সাধ্যমত তা-ই কিনে এনে দেবে না, এমন কথা কোথাও লেখা আছে?

সৌমিলি বাপ-মায়ের একমাত্র মেয়ে এবং হারাধন সরকার নেহাতই স্বল্প আয়ের মানুষ। কিন্তু সে তার মেয়েকে একটু বেশিই, যাকে বলে, লাই দিয়ে থাকে। সৌমিলি সেই অর্থে বখে যায়নি বটে, কিন্তু সে বড্ড জেদি আর একগুঁয়ে। বাবার প্রশ্রয়েই হোক, আর স্বভাবদোষেই হোক, তার যখন যেটা চাই তো চাই’ই। আর তার ভেতরে রয়েছে এক ঈর্ষাকাতর মন এবং ভয়ংকর এক প্রতিশোধপরায়নতা। ঈর্ষা আর প্রতিশোধস্পৃহা তাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার নমুনা আমরা পরে দেখবো। এখন বরং অন্য কথায় আসি।

বিয়ের প্রায় ষোল বছর পর সন্তান লাভ করার সৌভাগ্য হয় হারাধনের। এই দীর্ঘ অপ্রাপ্তির বছরগুলোতে কোথায় কোথায় যায়নি হারাধন দম্পতি? সাধু-সন্ত থেকে আরম্ভ করে তাবিজ-কবচ-মাদুলি-আংটি-পাথর ইত্যাদি, শহরের ডাক্তার থেকে আরম্ভ করে গ্রামের হাতুড়ে, হোমিয়োপ্যাথি থেকে আরম্ভ করে গাছগাছড়ার পাতা কিংবা শেকড়-বাটা, কিছুই বাদ দেয়নি তারা। তবে হারাধন-পত্নীর গর্ভাশয়টি ঠিক কী কারণে এই দীর্ঘ ষোলটি বছর ধরে মুখ ভার করে ছিলো, আর এতদিন পর ঠিক কিসেই বা তার মান ভাঙলো, এই সত্যটি সকলের কাছেই অজ্ঞাত রয়ে গেলো।

পিওনের পদে চাকরি করে হারাধন, সামান্য রোজগার। তবু তা’ই একরকম নিংড়ে এনে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ আর আবদার, দুটোই মিটিয়ে আসছিল সে। মেয়ের হাজার রকমের উদ্ভট বায়নাক্কা সামাল দিতে দিতে মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও মুখে কিছুই প্রকাশ করে না। তবে সবসময় একটা আতঙ্কে থাকে, এই বুঝি মেয়ে আবার নতুন কোন বায়না নিয়ে এলো। কিন্তু মেয়েটা লেখাপড়ায় বেশ এগিয়ে থেকেছে বরাবর। আর এই ব্যপারটাই হারাধনকে যেন বাড়তি একটা উত্সাহ দিয়ে এসেছে তার জীবনীশক্তিকে।

সন্তান লাভের প্রত্যাশা যখন ছেড়েই দিয়েছিলো হারাধন আর ঊর্মিলা, তখন তাদের কোল আলোকিত করে যেন চাঁদ হয়ে নেমে এসেছিলো সৌমিলি। এই অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির আনন্দে ওরা তখন নজরই করেনি যে, এই চাঁদের অন্দরমহলে কতটা খানাখন্দ আছে। লক্ষ্যই করেনি যে, মেয়ের গায়ের রঙ কালো না সাদা, নকটা উঁচু না চাপা।

এই বাপ-মায়ের কাছে তাদের মেয়ে একখন্ড হীরে, কিন্তু মেয়ে যত বড় হতে লাগলো বাপ-মা লক্ষ্য করতে লাগলো যে, মেয়ের কাছে কিন্তু শুধু বাবা-মা’ই যথেষ্ট নয়। হারাধন-দম্পতির দুনিয়াটা খুব ছোট, তাদের চাহিদাগুলোও ছোট ছোট। আর সেইসব চাহিদাও ওই মেয়েকে ঘিরেই। মেয়ে খুশি থাকলেই তারা খুশি।

কিন্তু সৌমিলির দুনিয়া তো অত ছোট নয়। তার ভাবনার পরিধি অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে থাকে তার পরিকল্পনাগুলোকে। সে মনে করে যে, সে অনেক কিছু পেতে পারে ইচ্ছে করলেই। আর যদি সেই পাবার পথে কোন বাধার সৃষ্টি হয় তবে বাধাটিকে উত্পাটিত করতে সে চেষ্টার খামতি রাখে না। সহজে যা হাতে আসে না, তাকে দখল করতে হয়, এই সাদা সত্যটাকে সে মাথার মধ্যে বসিয়ে নিয়েছে। হারাধন আর ঊর্মিলা দুজনেই অতি সাধারণ আর সহজ সরল মানুষ, কিন্তু তাদের কন্যারত্নটি মোটেই ততোটা নয়। কিন্তু নিজ সন্তানের মনের কুটিলতা নজর করার মতো দৃষ্টিশক্তি দুনিয়ার কোনও বাপ-মায়ের থাকে কি? হারাধন আর ঊর্মিলারও ছিলো না।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।