সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড (ঊনচত্ত্বারিংশ পর্ব)

আমি অবাক হবো কি ? অবাক হবারও তো একটা পরিসীমা থাকে! শুধু সর্বত্যাগীই নন, সমস্ত রকম লৌকিক লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে যিনি নিজেকে সমাজের কাছে অপাংক্তেয় করে রেখেছেন, যৌনতাকে বন্দী করেছেন শেকলে, তাঁর অনুভবে এরকম একটা উদাহরণ এলো কীভাবে? তিনি কি কোনো প্রেমিক পুরুষ হয়ে কোনো প্রেমিক নারীর বক্ষসুধারস পান করেছেন? অথবা কেউ কি তাঁর সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন কখনো? তাহলে ইনি কি আশৈশব কঠোর ব্রহ্মচর্য্য পালন করেন নি? প্রেমে আঘাত পেয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছেন মানুষের সাধারণ আশা আকাঙ্খার ক্ষেত্র থেকে কঠোরতম সাধনক্ষেত্রে !
আর বাংলাভাষাটাই বা কী অপূর্ব ! মাতৃত্বের রূপ টানতে গিয়ে কি সুন্দরভাবেই না ব্যবহার করলেন বক্ষসুধা শব্দটিকে ! আমার কেমন যেন নিশ্চিত মনে হচ্ছে যে, ইনি শুধু শিক্ষিতই নন, জীবনকে ভোগ করতে গিয়ে ব্যর্থ একজন মানুষ, ভোগলিপ্সা ত্যাগ করে সাধনলিপ্সায় খুঁজে পেতে এসেছেন তাঁর পরম কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার আধারকে।
–” ম্যায়নে কেয়া বোলা থা তুমকো — যো হ্যায় উও দেখতা নেহি, বোলানা তুমকো ! শোচো, আউর গহেরা মে যাও, দেখোগে উসিকো ঢুন পাওগে যো কভী নজর মে নেহি আয়া…। ”
বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন সেই নাগা সন্ন্যাসী।
কথার ভেতর লক্ষ্য করিনি, কানাইদা এর ভেতরেই কখন ছিলিম সাজিয়ে অগ্নিসংযোগও ঘটিয়ে ফেলেছেন। একজন অন্ধ মানুষ যে কি অসীম তৎপরতায় ছিলিম সাজতে পারেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না !
কানাইদা নাগাবাবার সামনে ভূমির ওপর ছিলিমটাকে স্থাপন করলেন।
আওয়াজ উঠলো — ‘ জয় মা তারা, জয় গুরু বামদেব। ‘ আর সাথে সাথেই এক অগ্নিপুরুষ এক লহমার জন্য একটা লম্বা লাফ দিয়ে, ফের ছিলিমের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। আর একরাশ ধোঁয়ার মেঘ মাথার ওপরকার গাছের পাতার আলোর জানালা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা! এক জটিল ধাঁধার আবর্তে ঘুরতে লাগলাম। ভদ্রলোকের বাড়িয়ে ধরা হাতের থেকে কখন যে ছিলিম আমার হাতে এলো, আর আমিও ‘ জয় মা ত্তারা ‘ কানাইদা চমকে উঠলেন,
–” এ কি পদীপদাদা ! তুমি ফের… ! ”
আর তুমি ফের, আমি তখন জগতের ফেরে পড়েছি। প্রেমের ফেরে জগৎ ফেরে — কথাটা কি এটাই ছিলো, না কি একটু অন্যরকম? যা মরলে তাই থাক গে, এটাই সত্যি যে প্রেমের ফেরে জগৎ ফেরে। আর একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে ভদ্রলোক এমনি এমনি নাগা সন্ন্যাসী হন নি। সোনাদাকে মনে পড়ছে, তিনি বলেছিলেন , — ” শুধুমাত্র পুলিশের চোখে ধুলো দিতে আমার মতো কত মানুষ যে, সাধু সেজে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তার ইয়ত্তা নাই। ”
তাহলে ইনিও কি তাদেরই একজন? সাথে সাথেই মন বিদ্রোহ করে উঠলো। না, সেটা হতেই পারে না, ইনি প্রেমিক। অবশ্যই একজন মহান প্রেমিক, যিনি হয় প্রেমকে হত্যা করেছেন কিম্বা হত্যা হতে দেখেছেন, ইনি কখনোই একজন মানুষ হত্যাকারী নন।
হঠাৎ করে আমার মনে হলো, তাহলে ইনি যে কথাটা বলেছিলেন, যে যেটা দেখছি সেটা সত্য নয়, আর যেটা সত্য সেটা দৃষ্টির বাইরে, সেটা কি প্রেম? একটা জটিল ধাঁধার উত্তর যেন আমার সামনে উন্মোচিত হলো। আমি ভদ্রলোককে সে কথা বলতে যেতেই ফের তিনি কলকে শুদ্ধু হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। ওর মুখের দিকে তাকালাম, বন্ধ দু’চোখের পাতায় খেলে বেড়াচ্ছে এক পরম প্রশান্তি। আমি হাত বাড়িয়ে ছিলিমটাকে গ্রহণ করে, দু’হাত মুঠো করে ঠোঁটের মাঝে রাখলাম।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।