সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে রূপক সান্যাল (পর্ব – ৫)

দখল

মণীশের মনে পড়ে, কয়েক মাস আগের একটি রাতের দৃশ্য। প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি ফিরছিল সে। বাড়ির প্রায় কাছেই চলে এসেছিল, আচমকা লোডশেডিং হয়ে গেল। আর ঠিক তখনই ভারী কিছু একটা এসে আঘাত করলো তার দুই হাঁটুতে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো সে,পড়ে গেল। আর কিছু মনে নেই তার। জ্ঞান যখন ফিরলো তখন সে হাসপাতালে। পাদুটো কেটে বাদ দিতে হয়নি বটে, কিন্তু ওই পায়ে ভর দিয়ে সে আর দাঁড়াতে পারলো না।

আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় সৌমিলি। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। ঘরের মধ্যে মণীশ আর সৌমিলি। আজ তাদের ফুলশয্যা। আয়নায় নিজেকে দেখে সৌমিলি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, সাধ মিটিয়ে দেখে। কী এত দেখার আছে? সে তো রূপসী নয়, আকর্ষক কোনও উপাদান তো নেই তার চেহারায়। তবুও দেখে, দেখতেই থাকে। ড্রয়ার থেকে একটা ক্রিম নিয়ে দুই গালে আর হাতে ঘষে ঘষে মাখতে থাকে। মণীশের নাকে যায় সেই ক্রিমের সুগন্ধ। সে অনুভব করে কিন্তু উপভোগ করে না। বালিশে মাথা দিয়ে চোখ বুজে সে পড়ে থাকে বিছানায়।

একসময় সৌমিলি বলল, ‘কি গো, কিছু বলো।’

মণীশ চোখ খুলে একবার দেখে সৌমিলিকে, তারপর বোকার মত প্রশ্ন করে, ‘কী বলব?’

সৌমিলি এবার মণীশের কাছে এসে ওর সটান দুটো পায়ের ওপর মাথা রেখে চোখ বিস্ফারিত করে বলল, ‘ও মা, সে কী! ফুলশয্যার রাতে বউকে কী বলবে সেটা আমি বলে দেব?’

মণীশ একটা হাত রাখে সৌমিলির হাতের ওপর। কিন্তু সেই হাত রাখায় যেন কোন প্রাণের ছোঁয়া নেই, আর ভালোবাসার তো নয়ই। সৌমিলি অনেক কথা বলে যায়, মণীশ শুধু হুঁ-হাঁ করে যায়, কখনো দু’একটা কথা বলে। ফুলশয্যার রাতে মনের কিংবা শরীরের কোন খেলাতেই মণীশ ঠিকঠাক অংশ নিতে পারে না। যদিও এই নিয়ে কোন অনুযোগ করে না সৌমিলি, তার জয় অন্য জায়গায়। সে যে কোথায় জিতে গেছে সেটা শুধু সে’ই জানে, মণীশ শুধু ভেবেই যায়, কিছু বুঝতে পারে না।

মণীশের প্রায় অবশ দুটো পায়ে এখনো অল্প যন্ত্রণা আছে, ওষুধ এখনো চলছে। সেই ওষুধে ঘুম ঘুম পায়। একসময় মণীশ ঘুমিয়ে পড়লো। জেগে রইলো একা সৌমিলি। সে আবার আয়নার সামনে উঠে এলো। এবার নিজেকে দেখে একটু যেন চমকে ওঠে সে। একটু ভয়ও পায়। এতদিন যে সৌমিলকে চিনতো সে,সে তাহলে এত ভয়ংকর! নিজের কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পাবার জন্য সে এতদূর যেতে পারে?

আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবিকে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না সৌমিলি, সরে এসে দরজাটা আলতো করে ভেজিয়ে দিয়ে সে ব্যালকনিতে এসে বসে। এলোপাথারি ভাবতে থাকে। নিজেকেই প্রশ্ন করে, নিজেই উত্তর দেয়। কলেজ ডিঙিয়েই সোজা চাকরির দরজায় পৌঁছে গিয়েছিল সৌমিলি। পরপর তিন তিনটে চাকরি তার হাতে এলো। যখন চাকরির বাজার শূন্য খাঁ খাঁ,সৌমিলি তখন তিন তিনটি এ্যাপয়েণ্টমেন্ট লেটার হাতে নিয়ে মস্ত দ্বিধায় পড়েছিল,কোন চাকরিটা সে বেছে নেবে। কিছুটা ভাগ্য আর বাকিটা জোর করে, জীবনে এভাবেই সবকিছু অর্জন করে এসেছে সে। ‘হবে না’ বা ‘পাওয়া যাবে না’, এসব কথা শুনতে সে অভ্যস্ত নয়।

যাইহোক, সৌমিলি এখন কেন্দ্রীয় সরকারী চাকুরে। ভালো বেতন, হাতে যথেষ্ট টাকা। তার যা ইচ্ছে তা’ই কিনতে পারে নিজেই। এজন্য তাকে আর বাবা-মায়ের কাছে জেদ ধরতে হয়না,কান্নাকাটি করতে হয়না, না খেয়ে উপুর হয়ে শুয়ে থাকতে হয়না বিছানায়।

সৌমিলি বাবা-মায়ের যত্ন করে খুব। কোন অভাব নেই হারাধন দম্পতির, কোন দুঃখ নেই। মেয়ে দেখতে সুন্দর নয় বলে এতদিন যে গোপন গ্লানিটা ছিল মনের মধ্যে,সেটাও এখন উধাও। মেয়ের আর্থিক স্বচ্ছলতা বাপ-মায়ের বুক চওড়া আর মেরুদণ্ড সটান করে দিয়েছে।

কিন্তু সৌমিলি মানুষটা তো আর পাল্টায়নি। তার সেই ঈর্ষাকাতর আর প্রতিশোধপরায়ণ মন এখনো একইরকম আছে। অল্পদিনের মধ্যেই সে উপলব্ধি করে,এই পৃথিবীতে সবই কেনা যায়। বাড়ি-গাড়ি-গয়না তো বটেই,এমনকি চাকরিও কেনা যায়। প্রেম’ও কেনা যায়, বিয়ের ভালো পাত্র’ও। রাতে যখন সে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে,তখন তার ভেতরের একটা দুর্মুখ শয়তান তাকে কানে কানে বলে,‘তোকে কেউ ভালোবাসে না, বাসবেও না। তোর তো রূপ নেই। তোকে যারা ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়, তারা আসে টাকার লোভে,তোর ওই চাকরিটার লোভে। ওটা না থাকলে তুই জিরো,এক্কেবারে শূন্য…’

এইসব সাত-সতের ভাবতে ভাবতে সৌমিলি ব্যালকনিতে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে একসময়।

 

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।