T3 || ঈদ স্পেশালে || লিখেছেন রনি রেজা

মহারাজপুর

দাপুটে গরমকে হঁটিয়ে প্রকৃতিতে শীতের দখলদারি চলছে কেবল। এখনো জেঁকে বসতে পারেনি সেভাবে। সদ্য বিজয়ী চেয়ারম্যান-মেম্বারের মতোই নরম, কোমল আচরণ। মেপে মেপে সহনীয় পর্যায়ের শীতলতা দেয়। অসহ্য গরম থেকে মুক্তি দিয়েছে কিন্তু অনতিদূরে অপেক্ষয়মান হাঁড়কাপুনি যন্ত্রণা রেখেছে আড়ালে। বছরের এই সময়ে কিছুটা ফুরফুরে মেজাজে থাকে গ্রামবাসী। বন্যার সঙ্গে লড়াই করে মাত্র উঠেছে। পাট, কলাই, মসুরি তুলে বিক্রিও হয়ে গেছে। সামনে পেঁয়াজ লাগানোর ধুম পড়বে। খেঁজুর গাছ কাটা, আমন ধানের বীজ বোণা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজের হল্লা শুরু হবে দিন পনের যেতে না যেতেই। কেউ কেউ যাবে ইটের ভাটায় মাটি কাঁটার কাজে। তখন দম ফেলার ফুসরত পাওয়া যাবে না। বছর ঘুরে এই সময়টা এলেই আমোদ যেন উপচে পড়ে। গ্রামের নাম মহারাজপুর। অর্থ ভাঙলে দাঁড়ায় মহারাজার দেশ। এই সময়টাতে সে দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লুঙ্গি ছেড়ে জিন্স ধরে কিশোর-যুবকরা। মেয়েদের কাছে সালোয়ার-কামিজ প্রিয় হয়ে ওঠে। মধ্যবয়স্ক নারীরাও শাড়ি ছেড়ে ম্যাক্সি জাতীয় পোশাকে ঝোকে। একটু বয়স্ক পুরুষ যারা লুঙ্গী পরতেই পছন্দ করে; তাদের পোষাকেও দেখা যায় বিশেষ পরিবর্তন। পারিপাট্য। সবার মধ্যেই রাজকীয় ব্যাপার বিশেষ লক্ষ্যণীয়। প্রাকৃতিক আশীর্বাদও রয়েছে গ্রামের প্রতি। গ্রামের দক্ষিণ পাশে বিশাল ফসলের মাঠ। ধান, পাট, গম, ভুট্টা থেকে শুরু করে সব ধরণের ফসলই সেখানে ফলে। গ্রামবাসী পায় প্রাকৃতিক খাবার। গ্রামীণ আশীর্বাদপুষ্ট জীবন পুরোটাই উপভোগ করা যায় অনায়াসে। আবার শহুরে সুবিধারও কমতি নেই। বিদ্যুৎ, পাকা রাস্তা, ২৪ ঘণ্টা বাজার সুবিধা জীবন করেছে অনেক সহজ। গ্রামের ওপর দিয়ে গলাগলি ধরে বসে গেছে পাকা রাস্তা ও কুমার নদ। সব পেশার মানুষই রয়েছে এই গ্রামে। কামার, কুমার, পোদ্দার, ঠাকুর, সৈয়দ, খন্দকার, মোল্লাÑ সব শ্রেণির সহাবস্থান গ্রামকে করেছে আরো সমৃদ্ধ। রয়েছে স্কুল, মাদরাসা, মন্দির, পীরের মাজার, ঠাকুরের আশ্রম। বাস করে মুসলিম-হিন্দু মিলে মিশে। ধর্ম, মনে ভিন্ন হলেও জীবন-যাপনের ধরণ এক। খুব বেশি কাজের তাড়া নেই কারো। সবাই যেন কিছু না করেই ভালো থাকতে চায়। এই সময়ে গ্রামে ঢুকলেই দেখা মেলে এখানে-সেখানে গোল হয়ে গল্পে মাতছে তরুণ-বয়স্কদের দল, বাড়িতে বাড়িতে বউ-ঝি মিলে বসিয়েছে উঁকুন বাছার আসর। সঙ্গে ডালি ভর্তি গল্পের বাহার। তাবৎ দুনিয়ার কোনো বিষয়ই যেন মুক্তি পায় না সে আসর থেকে। দু’একজনের মত-বিরোধ হয় না তা নয়। দু’চারদিন কথা বলা, মুখ দেখা-দেখিও বন্ধ থাকে এ নিয়ে। আবার যা-তাই। শিশু-কিশোররাও তেমনই। স্কুলগামী কদাচিৎ। অধিকাংশই কাকডাকা ভোরে দাঁড়িয়া-বান্ধা, গোল্লাছুট, বৌ-টুবানি খেলায় মেতে ওঠে। আরেকটু বড়রা রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে যায় ক্রিকেটের ব্যাট-বল হাতে। যুবক-শ্রেণির কারণে ওরা মাঠে জায়গা পায় না। মাঝে-মধ্যে কোনো কোনো পথচারি খানিক বিরক্ত হয় বটে, তবে কেউ কিছু বলে না। বললে আর রেহাই নেই। কেউ কিছু বলল তো যেন বল্লার চাকে ঢিল ছুড়ল। এ গ্রামের ঐক্যের গল্প আশ-পাশের জেলাগুলোতেও মুখে মুখে ফেরে। কাইজ্যা, দাঙ্গা লাগলে কেউ পেরে ওঠে না এদের সঙ্গে। শোনা যায়Ñ ‘একবার পাশের সাত গ্রাম মিলে হামলা করেছিল মহারাজপুরে। তখন পুরুষ মানুষ খুব ছিল না গ্রামে। সবাই গিয়েছিল দূরের এক গ্রামে দাওয়াত খেতে। নিরুপায় হয়ে গ্রামে অবস্থিত শাহ গোলজারিয়া মাজারে সহযোগিতা চায় নারী-শিশুরা। মুহূর্তেই শত শত সাদা ঘোরায় সওয়ার হওয়া সৈন্য মাজার থেকে রওয়ানা হয় শত্রুর মোকাবেলায়। শত্রুপক্ষ সেই দৃশ্য দেখে পালিয়ে যায়।’ এরপর আর কখনো কেউ ওই গ্রামের সঙ্গে লড়ার সাহস করেনি। এখনো বুক চিতিয়ে সেই গল্প করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে শিশু-যুবা-বৃদ্ধ; সবাই। ঐক্যে এখনো আপোষহীন তারা। মুসলিম-হিন্দু মিলে মিশে থাকে। গ্রামের যে জায়গাটায় দুর্গাপূজার মেলা হয়, সেখানেই হয় ঈদের নামাজ। অন্য গ্রামের সঙ্গে কাইজ্যা বাঁধলে আব্দুল্লাহ আর বিষ্ণু কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে গ্রামের সবাই এক হয়ে। জয়ও ছিনিয়ে আনে সহজেই। কিন্তু এবার কিছুতেই পেরে উঠছে না। অপরিচিত এক মানুষের আগমনে ঘুম নষ্ট হয় গ্রামসুদ্ধ মানুষের। যেখানেই দু’টো মানুষের দেখা মেলে সেখানেই চলে নতুন আগন্তুককে নিয়ে গবেষণা। পাঁচ-ছয় বছরের বালক থেকে যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ; সবারই যেন মাথাব্যথার কারণ ওই আগন্তুক। শীতের শুরুকালে যখন সবাই আনন্দে মেতে থাকার কথা তখন চিন্তা করতে হচ্ছে ওই আগন্তুককে নিয়ে। সব যেন ওলট-পালট হয়ে যায়।
এক সকালে বাসে যেতে যেতে একটি সাইনবোর্ডে ‘মহারাজপুর’ নামটি দেখে টুপ করে নেমে পড়ে সে। নেমেই আনমনে হাঁটতে শুরু করে। চুলগুলো কিছুটা এলোমেলো, আবার ঠিক অগোছালোও নয়। পরনে জিন্স, টি-শার্ট। তেল চিটচিটে একটা চাদর বার বার ঝুলে পড়ছে আর মানুষটি টেনে তুলছে। যেন সঙ্গী হতে বড্ড নারাজ চাদরটি। খুব ওজন আছে চাদরটির এমনও নয়। পাতলা চাদরটির যতটুকু ওজন তার অর্ধেকই ময়লা জমে। কালো দাগে ঘেরা কোটরে বসা চোখজোড়া তার নির্ঘুম রাতের সাক্ষী। এমন অগোছালো একইসঙ্গে পরিপাটি মানুষ গ্রামে আগে কেউ কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না। কয়েকদিন মানুষটির আনা-গোনা লক্ষ্য করে গ্রামবাসী। প্রথমে কেউ আমলে না তুললেও ক্রমেই তাকে ঘিরে আলোচনা ঘনীভূত হয়। জমে ওঠে চায়ের দোকানের আড্ডা। যেন এতদিনে যুৎসই একটা প্রসঙ্গ পেয়েছে সবাই। কেউ বলে গোয়েন্দা, টোয়েন্দা হবে। যুক্তি হিসেবে দাঁড় করায়Ñ ‘মানুষটি অগোছালো হলেও আলাদা একটা ব্যাপার আছে। দাঁতগুলোও পরিষ্কার, চকচকে। কোথায় ঘুমায়, খায়, গোসল করে; কেউ জানে না। অথচ ঠিকই চুলে তেল, পোশাকে পারিপাট্য ব্যাপার রয়েছে। গোয়ান্দাদেরই এমন হয়।’ কিন্তু এ গ্রামে গোয়েন্দা আসবে কী কারণে? সে প্রশ্নও তোলে কেউ কেউ। পাল্টা যুক্তিতে বলেÑ দুই, চার, দশ বছরেও কোনো খুন-খারাবি হয়নি। এ গ্রামের সবাই শান্তিপ্রিয় মানুষ। এ গ্রামে গোয়েন্দা ঢোকার প্রশ্নই আসে না।’ দু’পক্ষের যুক্তিই শক্ত-পোক্ত। উপস্থিত দর্শকও তখন ভাগ হয়ে যায়। অমীমাংসিত আলোচনার ভেতর দিয়েই শেষ হয় আড্ডা। পরের দিন ফের শুরু। কিন্তু এভাবে তো সঠিক কিছু জানা যাবে না। মানুষটির সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু সে কিছুতেই মুখ খুলছে না। নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সঠিক কিছু বলে না। নাম জিজ্ঞেস করলেই বলেÑ ‘মানুষ। ঠিকানাÑ স্বর্গ সন্ধানী। স্বর্গের সন্ধানেই আপনাদের এখানে আশা।’ এতে সন্দেহটা আরো তীব্র হয়। কেউ কেউ থানা পুলিশে খবর দেয়ার পরামর্শ দিলেও মুরুব্বীরা বাদ-সাধে। যদি সত্যিই গোয়েন্দার লোক হয়ে থাকে তাহলে থানায় জানালে ঝামেলা বাড়বে। আবার অনেকে পাগল বলে উড়িয়ে দেয়। কয়েকদিন চলে এভাবেই। একটু একটু করে স্বাভাবিক হয় গ্রামের মানুষ। আগন্তুক মানুষটিও লক্ষ্য করে তাকে ঘিরে গ্রামবাসীর কৌতুহল। লক্ষ্য করে গ্রামবাসীর চাল-চলন, জীবন-যাপনের ধরণ। মাঝে-মধ্যে এর-ওর সঙ্গে গল্পও করতে দেখা যায় তাকে। ধীরে ধীরে বোঝা গেল লোকটির ভেতর অগাধ পাণ্ডিত্য রয়েছে। গ্রামের মানুষও তার আগমনে এখন আর বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজনবোধ করে না। বরং নানাজন নানাভাবে সহযোগিতা করে তাকে। গ্রামের পরিত্যক্ত পোস্ট অফিসের বারান্দায় তার একটা থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন একজন মেম্বার। ফের জমতে শুরু করে গল্পের আসর। এবার ওই আগন্তুকই বক্তা। Ñ ‘এতসব আপনি জানলেন ক্যামনে?’ এমন প্রশ্নে চুপ থাকে। লোকটা যেন রহস্য ছড়াতেই পছন্দ করে। এ-ও অভ্যাস হয়ে গেছে সবার। গল্প শুনে মনে হয় তিনি ইশ^রের দূত। বিশ^-ব্রহ্মাণ্ডের অনেক অজানা গল্প করেন তিনি। গল্প করেন মহারাজপুরের অনেক অজানা বিষয় নিয়েও। যা কখনো কেউ শোনেনি। বলার ধরণও বিশেষ আকর্শনীয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ বিরতি দিয়ে দিয়ে গলার স্বর পরিমিত উঁচু, নিচু করে গল্প করেন। অন্যদের গল্পও শোনেন বিশেষ মনোযোগে। গল্পের আসরে নতুন নতুন তথ্য দিয়ে প্রায়ই চমকে দেয় গ্রামবাসীকে। এবার জানালেনÑ মহারাজপুর গ্রামের প্রতি বিশেষ সুদৃষ্টি রয়েছে সৃষ্টিকর্তার। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় এ গ্রামে সব সময়ই কোনো না কোনো গুণীজন থাকেন। একজন চলে গেলে আরেকজন আসেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ বয়সের দূরত্ব দিয়ে দিয়ে তাদের জন্ম। বললেন ওই গ্রামে ঘুমিয়ে থাকা গোলজার শাহ (রহ.), চান খন্দকার, আজাহার মৌলভী, মাওলানা খলিলুর রহমান ছোটফা হুজুর (রহ.) থেকে শুরু করে হালের হাছান মাস্টার পর্যন্ত সবার কথাই বললেন। এদের কথা মোটামুটি সবাই জানেন। কিন্তু আগন্তুক মানুষটি শোনালেন আরো কিছু নতুন নাম। যাদের গুণী ভাবারই কোনো কারণ নেই। অতি সাধারণ মানুষগুলোকে কেন গুণী বলে সম্মান দেখাচ্ছেন তিনি তা ভেবেই সবার বিস্ময় উপচে পড়ে। এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। সবার কপালেই চিন্তার ভাঁজ দেখা দেয়। খানিক থেকে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটি উক্তি তুলে ধরে আগন্তুক মানুষটি বললেনÑ ‘যে দেশে গুণীজনের সম্মান করা হয় না, সে দেশে গুণীজনের জন্মই হয় না। মহারাজপুর গ্রামে গুণীজন জন্মের যে ধারাবাহিকতা তা হয়তো অচিরেই নষ্ট হয়ে যাবে। আসলে আপনারা গুণীজনকে সঠিকভাবে চিনতেই পারেন না। মূল্যানও করা হয় না স্বাভাবিকভাবেই। কিছু মানুষের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতাও লক্ষ্যণীয়। এসবের কারণেই হয়তো এ গ্রামে আর কোনো গুণীর জন্ম হবে না। আর এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, হিন্দু-মুসলিম; সবাইকে সমান সম্মান করতে হবে। কার মধ্যে কোন গুণ রয়েছে তা কেউ-ই বলতে পারেন না। সবার উপরে মানুষ সত্য; বিশ^াস করে সবার আগে মানুষের মূল্যায়ন জরুরি।’
কথাগুলো বলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে আগন্তুক। মুহূর্তেই দমকা হাওয়া বইতে থাকে। শুরু হয় ঝড়ো বাতাস। যে যার মতো ছুটে স্থান ত্যাগ করে। রাতে অঝরে ঝড়তে থাকে বৃষ্টি। যেন সব ধুয়ে নিচ্ছে প্রকৃতি। শুদ্ধ করে দিচ্ছে সব। নিজ নিজ বাড়িতে থেকেও সবাই স্পষ্ট শুনতে পায়, ওই আগন্তুকের কণ্ঠে ভেসে আসেÑ ‘আমার দায়িত্ব শেষ। মহারাজপুরের মাটি, বায়ু, প্রাণী, পতঙ্গ, প্রতিটি গাছ, কুমার নদের পানি, মাছ, প্রতিটি কচুরিপানা সাক্ষী; আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি। সমস্ত শুধরে নেয়ার দায়িত্ব এখন এই গ্রামের বাসিন্দাদেরই।’
ভোর হলেই সবাই ছুটে যায় আগন্তুকের বাসস্থল পরিত্যক্ত সেই পোস্ট অফিসের দিকে। সবাই দেখেÑ হাসিমুখে সটান বসে আছে আগন্তুক। গ্রামবাসীর প্রশ্নবানে এতটুকু জবাব নেই। কেউ একজন এগিয়ে স্পর্শ করতেই বোঝা যায়Ñ আগন্তুক চলে গেছে। গ্রামের জন্য রেখে গেছে তার দেহখানি। তিনি কোন ধর্মের অনুসারী তা-ও জানা যায়নি। তাই সমাধি করার উপায়ও পায়নি কেউ। সেভাবেই হাসিমাখা মুখে অভ্যর্থনা জানায় সকল আগন্তুককে। সেদিনের পর থেকে পুরনো হাজার মিথ-এর সঙ্গে যুক্ত হলো আরেকটি। শীতের আগমনী গল্প-আড্ডার আসরের আরেকটি উপাদান।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।