শিক্ষক মহাশয়ের কাজটা কি ? ছাত্রকে পেটানো নয়, ছাত্রের কান মলে দেওয়া নয়, অপমান করা নয়, শিক্ষক মশায়ের কাজ মাত্র একটাই, তা হল, ছাত্রের ভিতরে আস্থা জুগিয়ে আত্মবিশ্বাস গড়ে দেওয়া। ছাত্রদের মধ্যে নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা ও ধ্যান ধারণা জাগিয়ে দেওয়া। তাহলে বাংলাভূমিতে এক খ্রিস্টান ইন্দো পর্তুগিজ অ্যাংলো শিক্ষক মহাশয়ের কথা বলি। তিনি হলেন ডিরোজিও। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর বাবা ফ্রান্সিস ডিরোজিও ছিলেন একজন খ্রিস্টান ইন্দো পর্তুগিজ চাকুরিজীবী। মা সোফিয়া জনসন ছিলেন ইংরেজ মহিলা। ছোটবেলায় ডিরোজিও ডেভিড ড্রামণ্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে পড়াশুনা করেছেন। তবে সে একেবারেই ছোটোবেলার পড়াশুনা। কিন্তু ড্রামণ্ডের সংস্পর্শে ডিরোজিওর মনের ভিতর জানলা দরজাগুলো খুলে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে হয়তো বলতেন, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল।
ডিরোজিও পড়াশুনায় বেশ ভাল ছিলেন। এতটাই ভাল, যে তাঁর পরীক্ষায় ফলপ্রকাশের খবর সে যুগে সংবাদপত্র পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে বের হত। চৌদ্দ বছর বয়সে ডিরোজিও পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে বাবার অফিসে কাজ করতে ঢোকেন। ওই বয়সেই পড়াশুনার পাট চুকিয়ে তিনি চলে যান ভাগলপুর। সেখানে তাঁর মামা বা কাকা, এইরকম কোনো এক খুব আপনজনের নীলকুঠি ছিল। সেখানেই কাজ করতেন তিনি। আর সেখানে ছিল গঙ্গানদী। নদীর কলকল শুনে ডিরোজিওর মনে কবিতা কল্পনালতা উঁকি দিল। সেই বয়সেই কবিতা লিখতে শুরু করেন ডিরোজিও, আর সেই কৈশোরের চনমনে টগবগে কবিতা বেরোতে থাকে ইণ্ডিয়া গেজেটে। সালটা মনে রেখো, ১৮২৫। তখন জন গ্রাণ্ট ছিলেন ইণ্ডিয়া গেজেটের সম্পাদক। ডিরোজিওর কলমের টগবগে ভাব দেখে তিনি খুব খুশি। কিশোর ডিরোজিওকে ইণ্ডিয়া গেজেটে অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর হিসেবে টেনে নেন। ইংরেজি ভাষায় ডিরোজিওর ভাল দখল ছিল। তারই জোরে ১৮২৬ সালের মে মাসে ডিরোজিও হিন্দু কলেজে ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। তখন তাঁর মাত্র সতেরো বছর বয়স। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের মনের মধ্যে যেন যুক্তি আর প্রশ্নের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন ডিরোজিও। ছাত্রদের তিনি শেখাতেন, প্রমাণ ও যুক্তি ছাড়া কোনো কিছুই বিশ্বাস করবে না। এই ছাত্ররা ইয়ং বেঙ্গল হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। ডিরোজিওর বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে রাধানাথ শিকদার , দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জি, প্যারীচাঁদ মিত্র , রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামতনু লাহিড়ী, এঁরা পরে খুব নাম করেছিলেন।
এই ছেলেরা মিলে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামে বিতর্ক সভা বা ডিবেটিং ক্লাব গড়ে তোলে। শিক্ষক ডিরোজিও ছিলেন ওঁদের পথপ্রদর্শক ও প্রথম সভাপতি। সালটা ছিল ১৮২৮।
যুক্তি ও প্রশ্নশীলতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও ডিরোজিও ছিলেন আসলে কবি। আর আদ্যন্ত স্বদেশপ্রেমী। “টু ইণ্ডিয়া- মাই নেটিভ ল্যাণ্ড” তাঁর বিখ্যাত কবিতা। অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এটা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু, সেই সময়ের হিন্দু সমাজের সমাজপতিরা ডিরোজিওর তীব্র ব্যক্তিত্বকে সহ্য করতে পারেন নি। ছাত্রদের তিনি নষ্ট করছেন, এই অভিযোগ তুলে সমাজপতিরা তাঁকে হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত করেন। তখন ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাস। ওই একই বছরে ২৬ ডিসেম্বর তারিখে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ডিরোজিও প্রয়াত হন। তখন তাঁর বাইশ বছর বয়স। ডিরোজিওর দীপশিখাকে ইয়ং বেঙ্গলরা মরতে দেননি। ডিরোজিও প্রয়াত হলে, তাঁরা ডেভিড হেয়ারকে সভাপতি করে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন চালিয়ে যেতে থাকেন।