গল্পেরা জোনাকি তে রীতা পাল (ছোট গল্প সিরিজ)

ফেরারী মন

আমার অবসর সময় বলতে এই দুপুরটুক। এই সময়টা আমার একান্তই নিজের। বেশ কিছুদিন শরৎবাবু পড়িনি। বারবার ইচ্ছে করে নায়িকাদের হারিয়ে দিত। তাই রাগ হয়েছিল শরৎবাবুর ওপর। বেশিদিন রাগ করে থাকাও যায় না। আবারও দ্বিতীয় খন্ডটা নিয়ে বসলাম। বইটা খুলতেই পোস্ট কার্ডে লেখা একটা চিঠি বেরিয়ে এলো। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল- এই চিঠিটা এখানে রেখেছি?
পঁচিশ বছর আগে লেখা একটা চিঠি! কি সুন্দর হাতের লেখা ছিল রণোদার। একেবারে মুক্তোর মত। তখন আমার বয়স সবে আঠারো। পার্বত্য নদীর মতো ছলাৎছল বয়ে চলেছি। আমার পাশের বাড়ির রিণি বৌদির ভাই হল রণদা। মাঝেমাঝেই দিদির কাছে আসতো। রণোদা তখন এম,এ র লাস্ট ইয়ার। একদিন দুপুরে জানলা দিয়ে রিণি বৌদি আমাকে ডাকলো ,“এই চৈতী,একবার এদিকে আয়।”
“আসছি।”
রিণি বৌদি বিলিতি আমড়া মেখেছে। একেবারে ফাটাফাটি। দু’জনে জমিয়ে আমড়া মাখা খাচ্ছি এমন সময় নিচে ডোর বেজে উঠলো। রিণি বৌদি বলল,“ চটপট নিচে যা তো,দেখ কে এসেছে?” আমি দোতালার ছাদ থেকে লাফাতে লাফাতে দরজা খুলতে এলাম নিচে। এসে দেখি একজন সুদর্শন পুরুষ দাঁড়িয়ে। রণোদা পাশ কাটিয়ে ঢুকতে যাবে তখনই দরজা আটকে বললাম, “ একি! আপনি কিছু না বলে ঢুকে যাচ্ছেন যে! আগে তো বলতে হবে আপনি কে?”
রণোদা একটু হেসে বলেছিল,“ না বললে ঢুকতে দেবে না বুঝি,চৈতী? দিদিকে বলো রণদা এসেছে।” আমি তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ালাম। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বললো,
“ দিদির কাছেই তোমার কথা শুনেছি।” রিণি বৌদি তখন ছাদ থেকে দোতালায় নেমে এসেছে। রিণি বৌদি ভাইকে দেখেই এক গাল হাসি হেসে বলল,“ কি রে,বাবা মা কেমন আছে? তুই ফ্রেশ হয়ে নে। আমি চা করে দিচ্ছি।” আমি মাথা নিচু করে পাশে এসে দাঁড়াতেই রিনি বৌদি বলল,“ আয়,তোর সাথে আলাপ করিয়ে দিই। আমার ভাই রণো। ও ইংলিশে এম এ করছে। জানিস,ও খুব সুন্দর কবিতা লেখে। ওর থেকে ইংরেজিটা দেখে নিতে পারিস।”
সেই প্রথম রণোদার সাথে আলাপ। রিণি বৌদির তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে। বর জাহাজে চাকরি করে। তাই অনেক দিন পর পর আসে। রিণি বৌদির বাপের বাড়ি বর্ধমানে। খুব ভালো গান করত। রণোদা এখানে আসলেই আমাদের খুব মজা হতো। আমি,বৌদি,রণোদা একসাথে অনেক জায়গায় গেছি। কত ঘুরেছি,বেরিয়েছি, সিনেমা দেখেছি,ফুচকা খেয়েছি। বেশ কাটছিল দিনগুলো – – – –
যতদিন যাচ্ছিল আমার মধ্যে একটা ইনফ্যাচুয়েশন কাজ করছিল। রণোদা আসলেই রিনি বৌদির বাড়ি দৌড়ে চলে যেতাম। অনেকদিন রণোদা না আসলে মন খারাপ হতো। যতদিন যাচ্ছিল আমি ওর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলাম। হয়তো কাঁচা বয়সের প্রেম। যদিও এটা একতরফা ছিল। রণোদার ভালোবাসাটা ছিল অন্যরকম। আর আমার হয়তো প্রথম প্রেম। রণদা এত সুন্দর করে কথা বলতো,কবিতা পড়তো,এমন ভাবে তাকাতো, যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবে।
রিণি বৌদির বর রিণি বৌদিকে নিয়ে মুম্বাই চলে যাবে। আবার কবে দেখা হবে কে জানে? যাবার সময় রণোদার দিকে তাকিয়ে বললাম,“ চিঠি লিখো।” রিনি বৌদি বলেছিল,“ লিখবো।” প্রথম প্রথম আমার খুব কান্না পেত। তারপর কলেজ খুলতেই পড়াশোনায় ডুব দিলাম। রিণি বৌদির ঠিকানা আমি জানতাম না তাই অনেক চিঠি লিখে ফেলে দিয়েছি। অপেক্ষায় থাকতাম। হয়তো রণোদা একটা চিঠি লিখবে। বছর তিনেক পর একটা চিঠি এলো রণোদার। তখন রণোদার ছবিটা খানিকটা ফিকে হয়ে এসেছে। তবুও পাহাড়ী নদীটা আবার বইতে লাগল। খোলা চিঠি-কেমন আছি? রিনি বৌদির ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। এইসব। শেষে,মন দিয়ে যেন পড়াশোনা করো। বারবার চিঠিটার এপিট ওপিট দেখছি,আর কিছু লেখা নেই!

একসময় কালের গর্ভে হারিয়ে গেছিল এই চিঠি। বছর পাঁচেক আগে এমনি এক দুপুরে ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠল। ধরতেই,ওপাশ থেকে ভেসে এলো,“কেমন আছো?”
“ চিনতে পারছি না! কে বলছেন?”
“ আবার কাল ফোন করব। দেখব,চিনতে পার কি না?”
পরপর ফোনটা আসতে লাগল। আগন্তুক এর সাথে সখ্যতা বাড়লো। হঠাৎই একদিন ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। আর কনো দিন ফোনটা আসে নি! আজও ল্যান্ড ফোনটা দেখলে মনের গোপনে অপেক্ষার রিংটোন বেজে ওঠে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।