কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া

বাবার প্রতিচ্ছায়া

করোনার থাবায়৷ হঠাৎ করে সারা বিশ্ব যেন থমকে দাঁড়িয়েছে৷ চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল৷ লক ডাইন৷ শাট ডাউন৷ প্রথম পর্যায়েতো বলা যায় কার্ফ্যু জারির মত অবস্থা৷ রাস্তা ঘাট৷ দোকান পাট৷ হাট বাজার৷ রিকসা, ভ্যান, বাস, ট্রেনসহ যোগাযোগের সবই প্রায় বন্ধ৷ এক অদৃশ্য ভাইরাসের ভয়ে নিস্তব্দ চারিদিক৷ ক’দিন আগে যে ব্যক্তিটা বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে নিজেকে বস্তবাদী-ইহলৌকিক দর্শনবাদী হিসেবে জাহির করতো৷ আজ সেই ব্যক্তিই সুন্নতি দাড়ি-পোষাক পরে নিজেকে ইসলামী দর্শনের অগ্রগামী সৈনিক হিসেবে প্রকাশ করছে৷ সন্দেহ আছে যে করোনা নির্মূলের অষুধ বের হবার পরও এ অবস্থানে থাকবে কি-না!

বিশ্ব জুড়ে করোনার করাল থাবায় মরছে মানুষ৷ কী করুণ মৃত্যু! শেষ কৃত্যে পাশে থাকছে না প্রিয় স্বজন৷ যাদের জন্য যন্ত্রের ন্যায় শুধু উপার্জন করে গেছে নিরন্তর৷ বৈধ অথবা অবৈধ উপায়ে৷ জীবনের শেষ লগ্নে প্রিয়জনকে কাছে না পেয়ে কত হৃদয়বিদারক কথা বলে গেল সমাজের সবচেয়ে ক্ষমতাধর আর বিত্তবান ব্যক্তি! ভাবতে অবাক লাগে এত সম্পদ কিংবা ক্ষমতা তার কোন কাজেই আসেনি৷ আঞ্জুমান মফিদিন কিংবা কিছু সাহসি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠণের গুটিকয়েক ব্যক্তি ছাড়া কেউ ছিলনা শেষ বিদায়ে৷
সন্তান জঙ্গলে ফেলে আসছে করোনায় আক্রান্ত পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন৷ কোন মৃত্যুই কাম্য নয়৷ কাম্য নয় মহামারী৷ কিন্ত তবুও কেন যেন সাদিক সাহেব এটাকে অবশ্যাম্ভাবী একটা বিষয় বলে মনে করেন৷ তার কাছে এটা একটা আশির্বাদ৷ বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষ যে নিজেই একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছে৷ মানবিক মূল্যবোধ আজ ভূলন্ঠিত৷ সমাজ, রাষ্ট্র তথা নিজেকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর এটাইতো সময়৷ মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতি যারা ভেবে এসেছিলেন নিজেদের স্বাস্থ্যসেবা কিংবা চিকিৎসা প্রয়োজন হলে বিদেশে যাবেন৷ তাই চিরকাল অবহেলিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আজ তাদের কাছে অন্ধের ষষ্ঠি৷ প্রচুর অর্থ ছিল৷ ক্ষমতা ছিল৷ হয়তো ভিআইপি পাসপোর্টও ছিল৷ কিন্ত পরিশেষে মরতে হয়েছে এখানেই৷ বেঁচে থাকার কী করুণ আর্তনাদ! কাজে লাগেনি৷
সাদিক সাহেবের কাছে জীবন মানে কিছু দায়বদ্ধতা৷ সামর্থ্য অনুসারে সকলে নিজ দায়িত্বটুকুই পালন করুক৷ তাতেই দেশ-সমাজ পাল্টে যাবে৷ আর মৃত্যু? এটা একদিন হবেই৷ ভয়ের কিছু নাই৷ বরং এটাকে গৌরবান্বিত করাটাই বড় কথা৷
সাদিক সাহেব একটা আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন৷ অফিস ঢাকায়৷ গুলশান এমবাসি পাড়ায়৷ রাশান এমবাসির পাশেই৷ দেশব্যাপি লক ডাউনের কারনে সকল স্ট্যাফকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে অফিস করার আদেশ করেন অফিস কর্তৃপক্ষ৷ যেহেতু ডোনার পার্ট৷ সেহেতু পার্টনার অর্গানাইজেশনের কার্যক্রমের রিপোর্টগুলো সামারাইজ করে হেড অফিসে পাঠাতে হবে৷ সপ্তাহে একদিন ভার্চুয়াল মিটিং হবে৷ এভাবেই চলছে অফিস৷ ভার্চুয়াল লাইফ৷
প্রথমদিকে ভালই লাগছিল৷ বাড়িতে শুয়ে বসে থাকা৷ পরিবারের সাথে একসাথে থাকা৷ আবার মাস ফুরোলে একগাদা বেতন৷ মন্দ কী! মনে হলো করোনা যেন মহা সুবিধা এনে দিয়েছে তাকে৷ যদিও অনেক কলিগ৷ অনেক বন্ধু-শুভাকাঙ্খি কর্মচ্যুত হয়ে পড়লো৷ ধীরে ধীরে হাহাকার বাড়ছে৷ এর শেষ কোথায় জানা নেই৷
নিজের বাড়ি মানে পৈত্রিকভাবে প্রাপ্ত একখন্ড জায়গায় একতলা একটা বাড়ি৷ অবশ্য শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত৷ বাসা নং-৫০, রোড নং-১৷ বাড়ি থেকে অফিস করা৷ এত সুবিধা৷ কিন্ত সাদিক সাহেবকে বিচলিত করে৷ ভাল লাগে না৷ আসলে এভাবে তিনি অভ্যস্থ নন৷ নিয়মানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলাবোধের ভেতরেই তার বসবাস৷ অফিসে যাওয়ার সময় নেই৷ পোষাক পরিচ্ছদের বিষয় নেই৷ কেমন যেন একটা অগোছালো জীবন৷ কোন চ্যালেঞ্জ নেই৷ নেই কোন থ্রিল৷
ইদানিং সাদিক সাহেব লক্ষ করছেন তিনি যেন বুড়িয়ে যাচ্ছেন৷ অফিসে কিংবা বাহিরে বের হতে হয়না৷ তাই প্রতিদিন দাড়ি শেভ করা, নিয়মিত চুল কাঁটা কিংবা হেয়ার কালারের প্রয়োজন পড়েনা৷ এতদিন একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মেয়েরাই শুধু সাজুগুজু করে৷ কিন্ত এখন বুঝতে পারছেন নিজেরা কম করেন না৷ নিজেটে পরিপাটি আর স্মার্ট রাখতে কত কৌশল আর প্রসাধন ব্যবহার করতে হতো তা তিনি টের পাচ্ছেন৷ সেলুনে যেতে না পারার কারণে চুল আর দাড়িগুলো যেমনি বড় হয়েছে৷ তেমনি হেয়ার কালার না করার কারণে সফেদ শুভ্র চুল-দাড়িতে নিজেকেই অচেনা মনে হয়৷ বেসিনের আয়নায় নিজেকে মনে হয় এক মধ্য বয়স্ক লোক৷
সাদিক সাহেবের বাবা সরকারী চাকুরে ছিলেন৷ অবসর নেয়ার আগেই তিনি মারা গেছেন৷ অনেক আগে৷ ২০০০ সালে৷ সুস্থ্য একটা মানুষ৷ রাতে ডাইনিং টেবিলে সকলে একসাথে গল্পগুজব করে খাওয়া-দাওয়া করলো৷ সোফায় বসে বিটিভির খবর দেখছিলেন৷ হঠাৎ শুধু একটা হিচকি দিয়ে পড়ে গেলেন৷ হাসপাতালে নেয়ার পথেই মারা গেলেন৷ অবিশ্বাস্য! বেদনাদায়ক৷ মানতে কষ্টকর হলেও এটাই বাস্তবতা৷ জীবন রেখা একেবারেই ঠুনকো৷ বাবার মৃত্যু কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলে দেয় তাদেরকে৷ তখন তিনি লেখাপড়া শেষ করে চাকরি খুঁজছিলেন৷ তার বয়স ছিল ঊনতিরিশ৷ আর বাবার বয়স পঞ্চাশ৷ মায়ের বয়স ছিল চুয়াল্লিশ৷ অর্থাৎ সাদিক সাহেবের সাথে তার বাবার বয়সের পার্থক্য হলো একুশ বছরের আর মায়ের সাথে পনেরো বছরের৷ অন্যদিকে বাবা-মার বয়সের পার্থক্য হলো ছয় বছরের৷ অর্থাৎ কুড়ি বছর বয়সি বাবা বিয়ে করেছিলেন চৌদ্দ বছর বয়সি মাকে৷ সে সময় এটাই স্বাভাবিক ছিল৷ কেননা বাল্য বিবাহ বলে কোন বিষয় ছিলনা৷
সময় পাল্টেছে৷ রুচির পরিবর্তন, শিক্ষা ব্যবস্থা বিশেষ করে নারী শিক্ষার উন্নয়ন, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইন প্রবর্তিত হলো৷ অর্থ উপার্জন আর ক্যারিয়ার সচেতনতা মানুষকে বিত্ত-বৈভব আর চাকরি নামক সোনার হরিণের পিছে এমন ভাবে ছোটাতে লাগলো যে সে নিজেই ভুলে বসলো নিজের সার্টিফিকেটের নয় সত্যিকারের বয়স৷ সে হোক নারী অথবা পুরুষ৷ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক সংসার জীবন থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকলো ভীষণভাবে৷ প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের অবাধ যৌণ সম্পর্ক স্থাপন করার বিধি বিধান থাকার পরেও তারা এত বিলম্বিত বিয়ে করেনা৷ কিংবা এত কম সন্তানও নেয়না৷
সাদিক সাহেব যখন বিয়ে করলেন তখন তার বয়স চল্লিশ৷ আর তার স্ত্রীর বয়স পঁচিশ৷ তাদের দুটো সন্তান৷ বড়টি মেয়ে৷ বয়স প্রায় নয়৷ আর ছোটটি ছেলে৷ বয়স চার৷
বাবা সরকারী চাকুরে ছিলেন৷ তাই তার মা পেনশন পান৷ বাড়ি ভাড়া পান৷ তা দিয়ে তিনি স্বচ্ছন্দে চলেন৷ সাদিক সাহেবের মত একজন মধ্য বয়স্ক সন্তানকে নিয়ে তাকে ভাবতে হয়না৷ সাদিক সাহেব অবশ্য মায়ের কাছ থেকে কোন টাকা নেন না৷ বরং নিজেই মাঝে মাঝে বাজার হাট করে দেন৷ মায়ের প্রতি দায়িত্ববোধ অস্বীকার করা কোন সন্তানের উচিৎ নয়৷
আজ কদিন ধরে কেন যেন আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে বড্ড বয়স্ক লাগে৷ একটু সময় ধরে নিজেকে গভীরভাবে লক্ষ্য করেন৷ আয়নায় ভেসে উঠা মুখটা নিজের বলে মনে হয়না৷ কিন্ত খুব চেনা চেনা লাগে৷ হঠাৎ মনে হয় এ মুখটা আর কারো নয়৷ বাবার৷ সাদিক সাহেব ভীত হন৷ চোখ সরিয়ে নেন আয়না থেকে৷
কদিন ধরে সাদিক সাহেব আয়না দেখেন না৷ এমনকি চুল আঁচরানোর সময়ও তিনি আয়নার সামনে দাঁড়ান না৷ কেননা ইদানিং তিনি প্রতিনিয়ত আয়নায় বাবার প্রতিচ্ছবি দেখেন৷
চুল-দাড়ি বড় আর সাদা রাখার কারণে প্রতিদিন মেয়ে রাগ করে৷ বলে বাবা তুমি শেভ করতো৷ চুল কালার করো৷ বিশ্রী লাগে! তুমি না করলে দেখবে ঘুমন্ত অবস্থায় আমি চুল-দাড়ি কেঁটে কলপ লাগিয়ে দেবো৷ তুমি টেরই পাবে না৷ তাছাড়া সামনে তোমার জন্মদিন৷
সাদিক সাহেব অভিভূত হয়৷ এই ছোট্ট মেয়েটা তার জন্মদিন মনে রেখেছে৷ একটা ভাল লাগা অনুভূতি শরীরে ছড়িয়ে পড়ে৷ তিনি জানেন তার প্রত্যেকটা জন্মদিনে স্ত্রী, ছেলে-মেয়েরা বিশাল আয়োজন করে৷ নিজের হাতে কেক বানানো৷ গিফট কেনা৷ সারপ্রাইজড দেয়া৷ তিনি ভীষণ এনজয় করেন৷ অন্যদিকে নিজের চরম ভুলটাও ধরতে পারে৷ বিয়েটা যদি সঠিক সময়ে করতে পারতেন৷ তাহলে এই সন্তানদের মমতাভরা মুখগুলো আরো বেশি বেশি দেখতে পারতেন৷

বাসা নং-৫০, রোড নং-১৷ আজ এ বাড়ির সামনে প্রচুর লোক সমাগম৷ ডেকোরেটর থেকে বিশাল সামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছে৷ তার নীচে অনেক চেয়ার৷ চেয়ারগুলো ফাঁকা নেই৷ সকলে শৃঙ্খলা আর পরিশালীনভাবে আসীন৷ একটু দূরে একটা জটলার ভেতর থেকে চার বছর বয়সী শিশুর নির্মল হাসির শব্দ উপস্থিত সকলকে ইমোশনাল করছে৷ শিশুটির এক হাতে জন্মদিনের কেক খন্ড অন্যহাতে গোলাপ জলের কনটেইনার৷ দুহাত নাড়াচ্ছে আর সেখান থেকে ছলাৎ ছলাৎ করে গোলাপ জল বেড়িয়ে বাবার গায়ে পড়ছে৷ তা দেখেই সে মজা পাচ্ছে৷ সে এখনো বুঝতে শেখেনি যে সামনে চিরতরে শুয়ে আছে তার বাবা৷ সাদিক সাহেবের আজ পঞ্চাশতম জন্মদিন৷

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।